E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রক্তের অপেক্ষা নয়, রক্ত হোক প্রস্তুত সবসময়

২০২৫ জুন ১৪ ১৭:৪০:০৮
রক্তের অপেক্ষা নয়, রক্ত হোক প্রস্তুত সবসময়

ওয়াজেদুর রহমান কনক


বিশ্ব রক্তদাতা দিবস প্রতি বছর ১৪ জুন তারিখে পালন করা হয়। এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য হলো রক্তদানের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং যারা স্বেচ্ছায় ও নিঃস্বার্থভাবে রক্ত দান করেন, তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। রক্তদান এক মহান মানবিক কাজ, যা কোনো ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক সময় একটি ব্যাগ রক্তই কারও জীবন ফিরিয়ে আনতে পারে।

এই দিবসটি ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট মুভমেন্ট, আন্তর্জাতিক রক্ত সঞ্চালন সংস্থা (ISBT), এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়। দিনটি বেছে নেওয়া হয় বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার–এর জন্মদিন হিসেবে। তিনি রক্তের গ্রুপ ব্যবস্থা (ABO Blood Group System) আবিষ্কার করেছিলেন এবং এর জন্য ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর এই আবিষ্কার রক্ত সঞ্চালনকে নিরাপদ করে তোলে এবং আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে একটি বিপ্লব ঘটায়।

প্রতি বছর বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য (theme) নির্ধারণ করা হয়, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয় নিয়মিত ও নিরাপদভাবে রক্ত দিতে। রক্তদান এমন একটি কাজ, যা স্বাস্থ্যবান মানুষ মাত্রই করতে পারেন, এবং এটি করতে সময়ও খুব কম লাগে। তবে এর প্রভাব হতে পারে একজন রোগীর পুরো জীবন বদলে দেওয়ার মতো।

বিশ্বের অনেক দেশে এই দিনটি উপলক্ষে রক্তদান কর্মসূচি, সচেতনতামূলক সেমিনার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রক্তদাতাদের সংবর্ধনা ইত্যাদি আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, হাসপাতাল এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে এই দিনটিকে গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও যুব সংগঠন তরুণদের রক্তদানে আগ্রহী করে তুলতে এদিনে বিশেষ আয়োজন করে থাকে।

রক্তদান শুধু একজন রোগীর উপকার করে না, বরং রক্তদাতার শরীরেও একধরনের স্বাস্থ্যসচেতনতা তৈরি করে। নিয়মিত রক্তদান করলে দেহে নতুন রক্ত কোষ তৈরি হয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং দাতার মনেও একটি আত্মতৃপ্তি জন্ম নেয়।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস তাই শুধু একটি স্মারক দিবস নয়, বরং এটি একটি জীবনমুখী আহ্বান—“আপনার রক্ত দিন, জীবন বাঁচান।”

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী উপলক্ষ। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রক্তের চাহিদা একটি স্থায়ী ও জটিল সমস্যা। প্রতিবছর হাজার হাজার রোগী দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, থ্যালাসেমিয়া, ক্যানসার কিংবা সন্তান জন্মদানকালীন জটিলতার কারণে রক্ত সংকটে ভোগেন। এই সংকট অনেক সময় প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ একটি সচেতন ও সক্রিয় সমাজ থাকলে রক্তের এই ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব।

বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষ মনে করেন, রক্তদানে শরীরের ক্ষতি হয় বা এতে দুর্বল হয়ে পড়া যায়। এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা সমাজে গভীরভাবে গেঁথে আছে, যা রক্তদানের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করে। এ ছাড়া, দেশের বেশিরভাগ রক্তদান এখনো আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের সীমায় আবদ্ধ। জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বাইরে দাঁড়িয়ে স্বজনদের রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে অনেক পরিবারকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে অনিরাপদ উৎস থেকে রক্ত সংগ্রহ করার ঝুঁকিও থেকে যায়।

এমন বাস্তবতায় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস একটি জনসচেতনতা তৈরির শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। এই দিনটির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় ও নিয়মিত রক্তদানের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও নানা সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তরুণদের মাঝে রক্তদানে উৎসাহ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। দেশে এখন অনেক তরুণ সংগঠন যেমন বাঁধন, সন্ধানী কিংবা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তরুণ শাখা এই কাজটি করে যাচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে। দিবসটি তাদের কর্মকাণ্ডের মর্যাদা দেয়, পাশাপাশি নতুন স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতেও ভূমিকা রাখে।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস রক্তদানের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় রক্ত দেন, তাকে আর শুধু একজন ‘দানকারী’ নয় বরং ‘জীবনদাতা’ হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে সামাজিকভাবে একটি ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে পড়ে যে, মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং জীবন রক্ষা করা একটি সম্মানের কাজ।

এ দিবস বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রক্তদানের নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনার সুযোগ তৈরি করে। নিরাপদ রক্তের নিশ্চয়তা, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, রক্ত পরীক্ষার প্রক্রিয়া, দাতার পরিচয় ও রেকর্ড রাখা ইত্যাদি বিষয়ে জনস্বাস্থ্য নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার উপযুক্ত সময় এটি।

সবশেষে বলা যায়, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস বাংলাদেশে শুধু একটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি সামাজিক আন্দোলনের উপলক্ষ। রক্তদানকে দায়িত্ব ও নৈতিকতা হিসেবে বিবেচনা করে এই দিবসটি সমাজে এমন একটি পরিবর্তন আনতে পারে, যেখানে “রক্তের জন্য অপেক্ষা” নয় বরং “রক্ত অপেক্ষায় আছে”—এই মানবিক কাঠামো গড়ে ওঠে।

প্রতিবছর ১৪ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। দিনটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বেচ্ছায় রক্তদানের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং যারা নিয়মিত ও নিঃস্বার্থভাবে রক্তদান করে আসছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। বাংলাদেশে এ দিবসটির তাৎপর্য দিন দিন বেড়ে চলেছে, কারণ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রক্তের ঘাটতি এখনো একটি মারাত্মক সমস্যা।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮–৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এই বিপুল চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৩৫–৪০ শতাংশ রক্তই স্বেচ্ছায় সংগ্রহ করা যায়। বাকি রক্ত সংগ্রহ করতে হয় রোগীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আর্থিক বিনিময়ে রক্তদাতা খুঁজে এনে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, এখনো দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন নয়। এই পরিসংখ্যান শুধু উদ্বেগজনক নয়, বরং একটি জাতির স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতি ১,০০০ জন মানুষের মধ্যে মাত্র ৬-৭ জন নিয়মিত রক্ত দেন, যেখানে উন্নত দেশগুলোতে এই হার ২০-৩০ জন পর্যন্ত। অর্থাৎ, রক্তদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। অথচ একটি সুস্থ-সবল মানুষ বছরে অন্তত তিনবার রক্ত দিতে পারেন এবং এতে কোনো ধরনের শারীরিক ক্ষতি হয় না। বরং, নিয়মিত রক্তদান করলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে, হেমোচ্রোমাটোসিস বা অতিরিক্ত আয়রনের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে থাকে।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার এবং প্রতিবছর প্রায় ৬-৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন। এছাড়াও ক্যানসার, কিডনি জটিলতা, দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার কিংবা মাতৃত্বকালীন জটিলতার কারণে প্রতিনিয়ত রক্তের প্রয়োজন পড়ে। অথচ রক্তের অভাবে অনেক রোগীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়, যা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য।

রক্তদানে মানুষের মাঝে এখনো নানা ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন রক্ত দিলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, কেউ আবার ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে বিরত থাকেন। অথচ ইসলামে রক্তদানকে জীবন রক্ষা করার একটি উত্তম সদকা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হাদীসে আছে, “যে ব্যক্তি একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাল, সে যেন পুরো মানবজাতিকে বাঁচাল।” (সূরা মায়েদা: ৩২)

বাংলাদেশে কয়েকটি সংগঠন রক্তদানে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ‘বাঁধন’, ‘সন্ধানী’, ‘ল্যাবএইড ব্লাড ব্যাংক’, ‘রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড সার্ভিস’ প্রভৃতি সংস্থা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ‘বাঁধন’-এর মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষের বেশি ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হয়। তবে তা চাহিদার তুলনায় এখনও অপর্যাপ্ত।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস আমাদের সামনে সুযোগ এনে দেয় সমাজে একটি মানবিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার—রক্ত দিন, জীবন বাঁচান। এই দিবসটি রক্তদানে উৎসাহিত করার পাশাপাশি একটি স্বাস্থ্যবান সমাজ গঠনের সহায়ক। প্রয়োজন শুধু সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের অংশগ্রহণ, ভয় না করে এগিয়ে আসা। তাহলেই আমরা গড়ে তুলতে পারি এক নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ, যেখানে রক্তের জন্য আর কোনো প্রাণ ঝরে পড়বে না।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test