E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পলাশীর শিক্ষা, আগামী পথচলা

২০২৫ জুন ২৩ ১৭:৪৬:৩০
পলাশীর শিক্ষা, আগামী পথচলা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ সোমবার ২৩ জুন, উপমহাদেশের ইতিহাসে এক শোকাবহ ও কলঙ্কিত দিন ২০২৫। ১৭৫৭ সালের এই দিনে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও স্থানীয় গাদ্দারদের হাত ধরে পরাজিত হন। এই পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সূচনা ঘটে। শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষের প্রায় দুইশো বছরের দাসত্বের শুরুও এই দিন থেকেই।

সিরাজউদ্দৌলার উত্থান

নবাব আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন দূরদর্শী, স্বাধীনচেতা ও সাহসী শাসক। সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের অনিয়মিত বাণিজ্য, দুর্গ নির্মাণ, কর ফাঁকি এবং রাজ্যদ্রোহী তৎপরতায় বিরক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে ইংরেজদের চাপে ফেলেন। কিন্তু এটাই ছিল ইংরেজদের জন্য অজুহাত, যার মাধ্যমে তারা চক্রান্তের সূচনা করে।

ষড়যন্ত্রের জাল: বিশ্বাসঘাতকতার কালো অধ্যায়

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝতে পারে সরাসরি যুদ্ধ নয়, বরং ভিতর থেকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে নবাবকে। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, ধনকুবের জগৎশেঠ, আমিরচাঁদ, রাজবল্লভসহ অনেকেই লোভ, ক্ষমতার আশায় ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিল লর্ড ক্লাইভ, যিনি চতুরভাবে সবাইকে অর্থ ও প্রতিশ্রুতির জালে জড়িয়ে ফেলেন।

পলাশীর যুদ্ধ: একটি পরিকল্পিত পরাজয়

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, নদীয়া জেলার পলাশীর আমবাগানে সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ — পলাশীর যুদ্ধ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনা সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার, যেখানে ইংরেজদের সেনা ছিল মাত্র ৩ হাজার। তবুও নবাবের পরাজয় ঘটে। কেন?

কারণ, নবাবের সেনাবাহিনীর প্রধান অংশ ছিল বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের নেতৃত্বে, যিনি যুদ্ধের সময় কোনো সাহায্য না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত সেনাপতিরা বীরত্বের সঙ্গে লড়লেও শেষ পর্যন্ত তারা ইংরেজদের গোলার আঘাতে ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় পরাজিত হন।

সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরিণতি

পরাজয়ের পর সিরাজউদ্দৌলা পালিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়েন। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। নবাব সিরাজকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের মৃত্যু ঘটে এবং ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা হয়।

পলাশীর ফলাফল: উপনিবেশবাদের সূচনা

পলাশীর যুদ্ধ শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি ছিল উপমহাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিসমাপ্তি। মীর জাফর নবাব হলেও প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ইংরেজদের হাতে। পরবর্তীতে মীর জাফরকেও সরিয়ে তাদের পুতুল নবাব বসানো হয়। ব্রিটিশরা দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে সমগ্র ভারতবর্ষকে। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি—সবই ধ্বংস করে দেয় শাসকদের লুণ্ঠন ও শোষণের নীতিতে।

অর্থনীতির ধ্বংসযজ্ঞ

বাংলা একসময় ছিল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল। মসলিন, চামড়া, কাঁচামাল, রেশম ও ধান উৎপাদনে অগ্রণী ছিল এই ভূখণ্ড। কিন্তু ব্রিটিশরা কেবল লুটপাটে মনোযোগ দেয়। কৃষকদের থেকে জোর করে খাজনা আদায়, শিল্পীদের কর্মহীন করা, স্থানীয় শিল্প-হস্তশিল্প ধ্বংস করে তারা নিজেদের পণ্যের বাজার তৈরি করে। ফলে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

সংস্কৃতির উপর আঘাত

ব্রিটিশরা শুধু অর্থনীতিতেই আঘাত করেনি, আঘাত করেছে সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থার উপরেও। বাংলা ও আরবি-ফারসি ভাষা শিক্ষা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েম করা হয়। এর ফলে স্থানীয় মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পলাশী দিবস পালন: প্রতিরোধের প্রতীক

পলাশী দিবস শুধু ইতিহাসের একটি ঘটনা নয়, এটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। ২৩ জুন আমাদের মনে করিয়ে দেয় কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমার অযোগ্য লোভ, এবং বিদেশি শক্তির প্রতি দুর্বলতা একটি জাতির স্বাধীনতাকে গিলে ফেলতে পারে। এই দিনটি আমাদের এক আত্মজিজ্ঞাসার দিন— আমরা কী আবারও সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে দেব?

আজকের তরুণ প্রজন্মের উচিত পলাশী দিবসের শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করে দেশপ্রেম, একতা ও আত্মনির্ভরতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পলাশীর গুরুত্ব

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, সুবিধাবাদিতা ও বিদেশ নির্ভরতা যে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তা যেন নতুন কোনো পলাশী তৈরি না করে। আজও যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ না হই, ইতিহাসের শিক্ষা না নেই, তবে আমাদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন পলাশী দিবস আমাদের শিক্ষা দেয়-বিশ্বাসঘাতকতা একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে, বিদেশি শক্তির দাসত্ব কখনো উন্নয়ন নয় ঐক্য ও দেশপ্রেম ছাড়া কোনো জাতি টিকে থাকতে পারে না। তাই, আসুন, ২৩ জুন “পলাশী দিবস” উপলক্ষে আমরা প্রতিজ্ঞা করি—এই ভূমিকে আর কোনো মীর জাফরের হাতে তুলে দেব না। নিজেদের ইতিহাস জানব, শিখব এবং নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করব।

পলাশীর যুদ্ধ শুধু অতীত নয়, এটি আমাদের আজকের পথচলার জন্য এক শক্ত শিক্ষা। একটি স্বাধীন জাতি কিভাবে ধীরে ধীরে পরাধীন হয়ে পড়ে—তা আমরা পলাশীর মধ্য দিয়ে দেখেছি। ইতিহাসকে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ আরও শক্তিশালী হয়, এবং স্বাধীনতা হয় টেকসই।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test