E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ঐক্যের গল্প এবং আমাদের প্রতিশোধ

২০২৫ জুলাই ০৭ ১৭:৩৩:৪২
ঐক্যের গল্প এবং আমাদের প্রতিশোধ

রহিম আব্দুর রহিম


১৯৪৫ সাল, যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান। এক কিশোর তার মৃত ভাইয়ের সৎকারের জন্য কাঁধে  করে নিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ওই কিশোরকে লক্ষ্য করে এক আর্মি বললেন, ‘লাশটা কাঁধ থেকে ফেলে দাও, ওটা অনেক ভারী।’ কিশোর দৃঢ় স্বরে জবাব দিল, 'সে লাশ নয়,ভারীও নয়, সে আমার ভাই!' আর্মি অফিসারের কিছুক্ষণ সময় লাগে বিষয়টি বুঝতে। এরপর পুরো কাহিনীটি অনুধাবন করতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

ঘটনাটি নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র জাপানে। সেই থেকে ছবিটি হয়ে ওঠে দেশটির ঐক্যের প্রতীক। ভাইকে পিঠে তুলে নেওয়া কিশোরের ওই উক্তি হয়ে যায় জাপানের জাতীয় স্লোগান: 'সে বোঝা নয়, সে আমার ভাই অথবা বোন।' (He’s not a burden, he’s my brother or sister).' অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক প্রতীক,ভাস্কর্য আজ ধ্বংস! পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের মাঝে সভ্যতা ফিরেয়ে আনার মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর আর্দশ নেতা-নেত্রীরা। আবার যখনই এই নেতা-নেত্রীরা আর্দশচূত্য হয়ে দমন-পীড়নে প্রবেশ করেছে তখনই ছাত্রসমাজ জেগে উঠেছে। এরা নিপীড়ন নির্যাতনের পতন ঘটিয়েই রাজপথ ছেড়েছেন। ৫২ ভাষা-আন্দোলনের, ৬৭ গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বোপরি ২০২৪'র কোটা বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলঙ্গই যার সুস্পষ্ট ইতিহাস।

আমেরিকান আর্টিস্ট ফ্লোরেন্স স্কোভেল শিন বলেছিলেন, 'The game of life is a game of boomerangs. Our thoughts, deeds, and words return to us sooner or later with astounding accuracy (জীবনের খেলা হলো বুমেরাংয়ের খেলা। আমাদের চিন্তাভাবনা, কাজ এবং কথা শীঘ্র বা বিলম্বে আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক নির্ভুলতার সাথে ফিরে আসে)। সমস্যা হল ক্ষমতার মোহে থাকাবস্থায় এই কঠিন সত্যটি কেউ মানতে চায় না। তবে সময়ের কাঁটা যখন উল্টো অক্ষরেখায় ঘুরে তখন তারা হাড়ে হাড়ে টের পায়। আমরা নীতিকথা শোনতে চাই না, সত্য সুন্দর মানতে চাই না। তবে যে কোন উসকানিমূলক কর্মকান্ডে বিদ্যুৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করি না।

কোন গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সমাজ কখনও চায় না, আঘাতের বদলে আঘাত, হত্যার বদলে হত্যা,লুটপাটের বিরুদ্ধে লুটপাট, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি অর্থাৎ প্রতিশোধের অসভ্য মব ভায়োলেন্স। বিচার সবাই চায়, তবে অসভ্য মব ভায়োলেন্স কেউ সমর্থন যেমন করে না, তেমনি এই ধরণের কিছু হোক সেটাও চায় না। এরপর হচ্ছে। ব্যর্থরা নির্দ্বিধায় যুক্তি উপস্থাপন করছে, সেই আমলে হয়েছে, ওই আমলেও হয়েছে, এই আমলে যা হচ্ছে তা ক্ষোভের ফলশ্রুতি। সভ্য পৃথিবীর সকল প্রান্তে যখন আবিস্কার উদ্ভাবনীর প্রতিযেগিতার মহোৎসব, ঠিক সেই মূহুর্তে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনমানুষের ভেতরে বসবাসকারী একটি অংশ মব কালচারে নিমজ্জিত। আগেও শোনেছি, 'একটা একটা অমুক ধর, ধরে ধরে জবাই কর।' এখনও শোনছি, 'একটা একটা তমুক ধর,ধ রে ধরে জবাই কর।' একই ন্যারেটিভ এবং সিলসিলায় একই বয়ান, পার্থক্য শুধু সময়ের। এক সময় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যায়ের প্রতিবাদ কিংবা সত্য কথা বলা মাত্রই রাজাকার, জামাত শিবিরের দোসর হয়ে যেতো। আর এখন বললে হচ্ছে ফ্যাসিস্টদের দোসর! কত জগণ্য প্রতিশোধের এই সব গালাগালিজ।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মতই বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের আমলে সারাদেশে যেভাবে ভিত্তিহীন মামলায় গণগ্রেফতার চলছে, তাতে করে এই দেশটা মানবিক সমাজের বলে মনে হচ্ছে না। এতে করে একটি পলাতক দলের পক্ষে মানুষের সিম্পেথি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ও অভিযোগের ভিত্তিতেই এই সমস্ত মামলার বিচার হলে ফলাফল কি হবে তা খুবই স্পষ্ট। ২০২৪ এর আন্দোলনের ফলাফল ভোগ করার কথাছিল দেশের আপামর জনমানুষের।যেখানে থাকবে না অন্যায়, হবে না অত্যাচার,চাঁদাবাজী দখলদারিত্বের অবসান ঘটবে চিরতরে, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে শুধুমাত্র অপরাধীরা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন সর্বস্তরের জন-মানুষ। এই আন্দোলনই হতে পারতো সভ্য জাতি গঠনের সর্বশেষ পাথেয়। যা বাস্তবায়নে আন্দোলনের অংশীজনরা সৃষ্টি করতে পারতো নানা পথের, বহু মতের বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে গড়া রাজনৈতিক আদর্শ, মতাদর্শের মানব সমাজের প্রীতির দেশ। গড়ে তুলতে পারতেন প্রতিহিংসা,প্রতিশোধ বর্জিত দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের সহনশীল, সম্প্রীতি এবং মানবিক ঐক্যের সৃজনশীল জাতির নতুন দেশ। সকল আকাঙ্খার গুড়েবালি!

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test