E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বর্ষায় জলাবদ্ধতা: কারণ, প্রভাব ও টেকসই প্রতিকার

২০২৫ জুলাই ০৯ ১৯:১৮:৫৭
বর্ষায় জলাবদ্ধতা: কারণ, প্রভাব ও টেকসই প্রতিকার

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। প্রতি বছর বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে যা কৃষির জন্য যেমন আশীর্বাদ, তেমনি অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে হয়ে দাঁড়ায় অভিশাপ। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল কিংবা জেলা শহরগুলোতে বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত এক দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।

বর্ষায় জলাবদ্ধতার মূল কারণসমূহ

১. অপরিকল্পিত নগরায়ন : অধিকাংশ শহর ও নগর এলাকা বিনা পরিকল্পনায় সম্প্রসারণ লাভ করেছে। সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল-নালার সংরক্ষণ কিংবা জলাধার নির্ধারণ না করেই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নিকাশের কোন সঠিক পথ খুঁজে পায় না।

২. খাল ও জলাধারের দখল ও ভরাট : ঢাকা সহ বহু শহরের প্রাকৃতিক খাল, পুকুর ও নদীর মুখ দখল করে নির্মাণ কাজ চালানো হয়েছে। জলাধার ভরাটের ফলে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় বা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

৩. ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা : অধিকাংশ শহরের ড্রেনগুলো সরু, অপরিষ্কৃত ও পর্যাপ্ত সংখ্যক নয়। নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়ায় এগুলো ময়লা, প্লাস্টিক ও কাদামাটিতে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

৪. প্লাস্টিক বর্জ্য : অব্যবস্থাপনায় রাস্তা-ঘাটে ফেলা প্লাস্টিক, পলিথিন এবং অন্যান্য কঠিন বর্জ্য ড্রেনেজে আটকে পানির স্বাভাবিক চলাচল রোধ করে।

৫. বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন : বিগত দশকে বৃষ্টিপাতের আচরণে পরিবর্তন এসেছে। হঠাৎ অতি বৃষ্টিপাত এবং দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এই পরিবর্তনেও জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বাড়ছে।

জলাবদ্ধতার প্রভাব

১. জনদুর্ভোগ ও যানজট : বর্ষাকালে রাস্তা-ঘাটে হাঁটু বা কোমরসমান পানি জমে থাকে। অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী কিংবা রোগী সবাই পড়ে যায় চরম দুর্ভোগে। যান চলাচল বিঘ্নিত হয় এবং দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

২. স্বাস্থ্যঝুঁকি : দীর্ঘসময় জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয় মশা, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস। ফলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, পানিবাহিত রোগসহ নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন সাধারণ মানুষ।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি : জলাবদ্ধতা কৃষি, শিল্প ও ব্যবসার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং চিকিৎসা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ে।

৪. শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত : পানি জমে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায় বা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়। শহরাঞ্চলে বিশেষ করে বস্তির শিশুদের শিক্ষাজীবন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৫. পরিবেশগত বিপর্যয় : জলাবদ্ধতার ফলে শহরের মাটি ও পানি দূষিত হয়, জীববৈচিত্র্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ছত্রাক ও রোগজীবাণুর আধিক্য বাড়ে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় ও প্রতিকার

১. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন : নগর উন্নয়ন ও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলাবদ্ধতা রোধকে প্রাধান্য দিতে হবে। জলাধার ও খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

২. খাল-নালা পুনর্খনন ও সংরক্ষণ : বিভিন্ন শহরে প্রাকৃতিক খালগুলোকে পুনরায় খনন করতে হবে এবং দখলমুক্ত করতে হবে। এই খালগুলোকে ড্রেনেজ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সংযুক্ত করা যেতে পারে।

৩. আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা : মাটির নিচে সুপরিকল্পিত ও পর্যাপ্ত জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। ঝড়বৃষ্টি বা আকস্মিক বন্যার পানি দ্রুত সরিয়ে নিতে “স্মার্ট ড্রেনেজ সিস্টেম” চালু করা উচিত।

৪. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন : প্লাস্টিক ও কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থায় পড়ার আগেই তা আলাদা করে সংগ্রহ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাসে।

৫. সবুজায়ন ও জলাধার সংরক্ষণ : নগরে যত বেশি গাছ থাকবে, তত বেশি পানি শোষণ হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ ও পুকুর/দিঘির সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

৬. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ : বিল্ডিং কোডে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি ঘরোয়া ও শিল্প ব্যবহারে কাজে লাগার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনেও সহায়ক।

৭. প্রযুক্তিনির্ভর পূর্বাভাস ব্যবস্থা : আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের তথ্য আগাম সংগ্রহ করে জনসচেতনতা তৈরি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে “রেইন ফ্লাড মডেল” ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট এলাকায় সতর্কতা জারি করা যেতে পারে।

৮. জনগণের অংশগ্রহণ : শুধু সরকার নয়, জনগণকেও জলাবদ্ধতা নিরসনে দায়িত্ব নিতে হবে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার রাখা, আবর্জনা না ফেলা, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন গড়ে তোলার মতো সচেতন আচরণ জরুরি।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা : জলাবদ্ধতা কেবল পানি জমে থাকার সমস্যা নয়, এটি একটি সামগ্রিক উন্নয়নগত সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দিনে এই সংকট আরও তীব্র হতে পারে। তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে ঢাকা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খুলনা বা বরিশালের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করার জন্য টেকসই শহর পরিকল্পনার বিকল্প নেই।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্ষায় জলাবদ্ধতা এখন একটি মৌসুমি দুর্ভোগের চেয়ে অনেক বেশি। এটি জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি ও নাগরিক জীবনের ওপর এক ভয়াবহ চাপ। তবে কার্যকর পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ সচেতনতা ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব। চাই এমন একটি নগর যেখানে বর্ষার বৃষ্টিধারা হয়ে উঠবে শীতল প্রশান্তি, আর জলাবদ্ধতা হবে কেবল অতীতের এক দুর্বিষহ স্মৃতি।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test