E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নতুন পথে পুরনো দল

শাসনের প্রস্তুতি না থাকলে বিএনপির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

২০২৫ জুলাই ১০ ১৭:১৬:১৩
শাসনের প্রস্তুতি না থাকলে বিএনপির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

দিলীপ চন্দ


দীর্ঘ ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আবারও দেশের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ এবং সাম্প্রতিক আন্দোলন–সংগ্রামে তরুণদের সক্রিয়তা দলটির প্রতি নতুন করে আশাবাদ তৈরি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, দেশের পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে বাস্তব রাজনীতির বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির পথ ততটা সহজ নয়। দলটির সামনে একযোগে পাঁচটি মৌলিক সংকট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা এখনই সমাধান না হলে ভবিষ্যতে বিএনপির জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা, এমনকি রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

এই পাঁচটি সংকট হলো—জনপ্রিয়তা ব্যবস্থাপনা ও প্রত্যাশার চাপ, অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট, কাঠামোগত সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক বাস্তববাদ, শাসনের অভিজ্ঞতা ও গভর্নিং মেমরির অভাব এবং তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ ও অনিশ্চিত আনুগত্য।

১. জনপ্রিয়তা ব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত প্রত্যাশা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বড় বিকল্প শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই ‘বড় দল’ পরিচয় বিএনপির ওপর চাপও তৈরি করেছে। জনগণের আশাবাদ ও প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রত্যাশা এক জায়গায় গিয়ে দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আধুনিক রাজনৈতিক ভাষায় বললে, বিএনপি এখন একটি ‘ফাঁকা সংকেতবাহী চিহ্ন’ (Empty Signifier) হয়ে উঠেছে—যেখানে নানা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিস্থাপন করছে। ফলে দলের যেকোনো নেতার অপকর্ম বা দায়িত্বহীনতার দায়ও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘাড়ে এসে পড়ছে। গত ৯ মাসে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ৪ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী বহিষ্কার, এই সংকটেরই একটি প্রতিফলন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত সংখ্যক বহিষ্কারের পরও দলে কি সত্যিকারের নেতৃত্ব গড়ে উঠছে, না কি শুধু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই শুদ্ধি অভিযানের ঢাক বাজানো হচ্ছে?

২. নেতৃত্বে অস্থিরতা ও অভ্যন্তরীণ ব্লক রাজনীতি: ২০০৮ সালের পর থেকে টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে অংশ নেয়নি। যার ফলে মাঠপর্যায়ে কোন নেতা কতটা জনপ্রিয়, তা যাচাই করার সুযোগ নেই। দলের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট ‘ক্ষমতার ব্লক’ বা বলয়—যাদের দাবি তারা জনপ্রিয়, কিন্তু বাস্তবতা যাচাইয়ের কোনো ডাটাবেইস নেই।

ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আনুগত্য বা সম্পর্কের ভিত্তিতে, যা পরবর্তীতে পক্ষপাতিত্ব, দলীয় গঠনতন্ত্র ভঙ্গ এবং ভেতরের বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলছে। এই ব্লক রাজনীতি শুধু বিএনপির সাংগঠনিক ভারসাম্যকেই দুর্বল করছে না, বরং এটি দলের রাজনৈতিক বার্তার একতা এবং কৌশল নির্ধারণেও জটিলতা তৈরি করছে।

৩. সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক বাস্তববাদ বনাম আদর্শবাদ: বিএনপির তৃতীয় সংকটটি আরও কৌশলগত এবং সূক্ষ্ম। দলটি যদি সত্যি ক্ষমতায় যেতে চায়, তবে তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্কারে সম্মত হতে হবে—যেমন নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি।

কিন্তু অনেক সংস্কার প্রস্তাব এমন, যা বাস্তবায়ন করলে ভবিষ্যতের সরকার কাঠামোগতভাবে দুর্বল হতে পারে। আর এখানেই রাজনৈতিক বাস্তববাদ বনাম আদর্শবাদের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

একদিকে ইসলামপন্থী দলগুলোর মতামত রক্ষার বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সংস্কারে রাজি না হলে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ—এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় বিএনপি অনেক সময়েই কৌশলগত দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে।

ধরে নেওয়া যাক, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি বা চরমোনাই পীরের মতো ইসলামি ঘরানার দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে। সেক্ষেত্রে বিএনপি কি একা নির্বাচনে অংশ নেবে? আবার এই দলগুলো যদি নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়, তবে সরকার কি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে জোর প্রয়োগ করবে? এসব প্রশ্ন এখনো উত্তরহীন।

৪. গভর্নিং মেমরির অভাব ও বাস্তবতার পরিবর্তন: ২০০৬ সালের পর থেকে বিএনপি সরকারে নেই। ফলে তাদের ‘গভর্নিং মেমরি’ বা রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। অথচ একটি দক্ষ প্রশাসন গড়তে হলে দরকার পলিসি নির্ধারণে অভিজ্ঞ, প্রশাসনিক কাঠামো বোঝা ও বাস্তব পরিস্থিতিতে কাজ করতে জানা একটি টিম।

আওয়ামী লীগ যেখানে টানা শাসনের অভিজ্ঞতায় প্রশাসনিক দক্ষতা ও নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, সেখানে বিএনপির ভেতরে এখনো অনেক ক্ষেত্রেই ‘আগে যে ছিল, সে-ই থাকবে’ ধরনের মানসিকতা প্রবল। কিন্তু বাস্তবতা বদলেছে। প্রযুক্তি, রাজস্ব, নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক—সবকিছুই এখন অন্যভাবে পরিচালিত হয়। সেখানে পুরনো অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই অচল হয়ে পড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তবে তারা কীভাবে প্রশাসনিক দক্ষতা গড়ে তুলবে? নতুন করে কি একটি শাসন-পরিকাঠামো তৈরি করবে? নাকি পুরনো মুখ নিয়েই রাষ্ট্র চালাবে?

৫. তরুণদের ক্ষোভ ও ভবিষ্যৎ অনুগত্য: আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে অস্থির ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হলো তরুণ প্রজন্ম। জুলাই আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে তাদের সক্রিয়তা প্রমাণ করেছে—তারা শুধু ভোটার নয়, আন্দোলনের নেতৃত্বও দিতে পারে।

কিন্তু এই তরুণদের অনেকেই বিএনপির ভাষা, বার্তা বা কৌশলের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না। তারা চায় কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি, ন্যায়বিচার, পরিবেশ—যে বিষয়গুলোকে বিএনপি এখনো পুরোপুরি তার রাজনৈতিক ভাষায় রূপ দিতে পারেনি।

তরুণরা যা চায় তা পাচ্ছে না, আর যা পাচ্ছে তা চায় না—এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নিচ্ছে একধরনের ক্ষোভ। এই ক্ষোভই যদি বিএনপির বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়, তবে সেটি হবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপদ। বিশেষ করে যখন ইসলামপন্থী দলগুলোর অনলাইন সক্রিয়তা ও মাঠের উপস্থিতি সমানতালে বাড়ছে।

বিএনপি কী প্রস্তুত?

এই পাঁচটি সংকটের প্রতিটির মধ্যে রয়েছে নতুন সম্ভাবনারও দুয়ার। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক আধুনিকায়ন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, নেতৃত্বে স্বচ্ছতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা।

বিএনপি যদি সত্যি আগামী ১০ বছর দেশ শাসনের মতো জনম্যান্ডেট পেতে চায়, তবে শুধু রাজপথে নেমে নয়—দলের ভেতরে সংস্কার, কাঠামোগত প্রস্তুতি ও তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করার মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতাও দেখাতে হবে।

সর্বোপরি, বিএনপির সামনে এখন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্ন নয়—ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় টিকে থাকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক পরিপক্বতা অর্জনের চ্যালেঞ্জও।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test