E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মৃত্যুর মিছিল শেষ হবে কবে?

২০২৫ জুলাই ১২ ১৭:৫৭:৪৩
মৃত্যুর মিছিল শেষ হবে কবে?

দিলীপ কুমার চন্দ


“আজও খুন, আজও ধর্ষণ, আজও লুটপাট”—এ যেন এখন আমাদের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। বাংলাদেশের জনজীবন আজ এমন এক চরম অনিশ্চয়তা ও ভয়ের মধ্যে বন্দী, যেখানে প্রতিদিন পত্রিকার শিরোনাম হয় হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক দমন, নারী নির্যাতন, বা সন্ত্রাসী তাণ্ডবের খবর। মানুষ যেন একটি মৃত্যুর মিছিলে দাঁড়িয়ে, যার শেষ কোথায় কেউ জানে না।

এই পরিস্থিতি শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, এটি একটি সমাজের ভেতরে বসবাস করা কোটি মানুষের নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন এখন একটাই—এ মৃত্যুর মিছিল কবে থামবে?

প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু, কমছে মানবতা

জাতীয় দৈনিকগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে গড়ে প্রতিদিন ১৫ জনের বেশি মানুষ খুন হয়েছে (রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সন্ত্রাসজনিত কারণে)। প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন ৯-১০ জন নারী ও শিশু, যার অনেকগুলো ঘটনায় বিচার হয়নি। প্রতিমাসে ২০০টির বেশি লুটপাট ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে, অনেকসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত শতাধিক, ধ্বংস হয়েছে বাড়িঘর, দোকান, উপাসনালয়।

এই মৃত্যুর পেছনে দায়ী কে বা কারা?

১. দায়মুক্তির সংস্কৃতি: বিচারহীনতা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাধি। খুন বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও বিচার হয় না, বা হয় অনেক দেরিতে। অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা পায়।

২. রাজনীতির সহিংস রূপ: ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আজ রাজনীতি সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করতে রাস্তায়, সভায়, এমনকি বাসা বাড়িতে হামলা চালানো হচ্ছে।

৩. দুর্বল প্রশাসন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় দলীয়করণ, ঘুষ, ভয় বা রাজনৈতিক চাপে অনেকেই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে অপরাধীর সাহস বাড়ছে।

৪. সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক শূন্যতা: পরিবারে, স্কুলে, সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করছে।

গত এক বছরে কিছু ভয়ংকর ঘটনার সংক্ষিপ্ত চিত্র

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়। ৫ নভেম্বর ২০২৪, নোয়াখালীতে গণধর্ষণের পর কিশোরীর আত্মহত্যা শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২ জন নিহত হন। ২৬ মার্চ ২০২৫, রংপুরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ১৫ জুন ২০২৫, ফরিদপুর বাজারে চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

জনমনে কী প্রভাব ফেলছে এই পরিস্থিতি?

নিরাপত্তাহীনতা: নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা এখন রাতে একা ঘরে থাকতে ভয় পান।

মানসিক চাপ: আতঙ্ক, বিষণ্নতা ও অনিশ্চয়তায় মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

আস্থা হারানো: রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার ওপর মানুষের বিশ্বাস দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: প্রতিবেশী–স্বজনদের ওপরও সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে।

কীভাবে থামানো যাবে এই মৃত্যুর মিছিল?

১. নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার: সব রাজনৈতিক, সামাজিক, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দ্রুত তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। "জিরো টলারেন্স" নীতিকে কাগজে নয়, বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।

২. রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও শুদ্ধি অভিযান: দলীয় স্বার্থে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। শুদ্ধি অভিযানে দলীয় দোষীদেরও বাদ দেওয়া যাবে না।

৩. প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া: পুলিশ ও প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

৪. সুশিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা ও মানবিকতা ভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে। সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়তে হবে শৈশব থেকেই।

৫. গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করা: সত্য প্রকাশে বাধা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও নাগরিক আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রতিটি খবরে এখন রক্ত, কান্না ও শোক। যে মৃত্যু প্রতিদিন আমাদের চারপাশে ঘটছে—তা যেন আর কেবল সংখ্যার হিসাব নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবেকহীনতার প্রতিচ্ছবি।

এ মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে দরকার সাহসী সিদ্ধান্ত, স্বচ্ছ নেতৃত্ব এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। নইলে আমাদের সন্তানরাও এই রক্তাক্ত অভিশাপের ভার বয়ে বেড়াবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test