E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রক্তাক্ত গোপালগঞ্জ 

গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু : দায় কার?

২০২৫ জুলাই ১৮ ০০:০৫:০৯
গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু : দায় কার?

দিলীপ কুমার চন্দ : ২০২৫ সালের ১৫ জুলাই, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক ঐক্য (এনসিপি)-এর ঘোষিত পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। এনসিপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিচারহীনতা ও পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে এই পদযাত্রা আহ্বান করেছিল। তবে, পদযাত্রা শুরুর আগেই একাধিক এলাকায় প্রশাসনের বাধা, পুলিশি চেকপোস্ট, ও গোয়েন্দা নজরদারি দেখা যায়।

দুপুরের পর পদযাত্রা গোপালগঞ্জ সদর পৌর ভবনের সামনে পৌঁছালে হঠাৎ করে শুরু হয় সহিংসতা। পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস এবং পাল্টা প্রতিরোধে বিক্ষোভকারীদের লাঠিচার্জের ঘটনায় প্রাণ হারান অন্তত ৭ জন সাধারণ মানুষ। আহত হয়েছেন ৪০ জনের বেশি।

নিহত ও আহতদের পরিচয়
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহতদের অধিকাংশই সাধারণ পথচারী বা পাশ্ববর্তী দোকানদার ছিলেন, যারা রাজনৈতিক এই ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। আহতদের মধ্যে একজন স্কুলছাত্রী ও এক বৃদ্ধও রয়েছেন, যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহতদের একজনের নাম মোঃ শহিদুল ইসলাম (৪৫), যিনি ছিলেন একজন রিকশাচালক। তিনি বাজারে যাত্রী নামিয়ে ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে মারা যান। সালমা আক্তার (১৬) নামের একজন ছাত্রী, কাঁদানে গ্যাসের আঘাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে, বর্তমানে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

প্রশাসনের ভূমিকা ও প্রশ্নবিদ্ধ নীরবতা
ঘটনার পরপরই প্রশাসন দাবি করে, “এনসিপির পদযাত্রা ছিল অবৈধ এবং অনুমতি ব্যতীত সংগঠিত, তাই জননিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে।” কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, পুলিশের প্রতিক্রিয়া ছিল অতিমাত্রায় সহিংস ও অপ্রয়োজনীয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ হওয়ার পরও পুলিশ সাধারণ জনগণের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। এই চিত্র গণমাধ্যমে ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

এনসিপি ও নাগরিক সমাজ কী বলছে?
এনসিপির মুখপাত্র ড. আরিফুল হক বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার মাধ্যমে সরকারের দমননীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের কণ্ঠ রোধ করতে সাধারণ মানুষকে নিশানা করেছে।”

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়,

“নিহতদের মাঝে যে সাধারণ নিরীহ পথচারীরা ছিলেন, এটি প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সহিংসতা ঘটিয়েছে।”

কে নেবে এই হত্যার দায়?

এই প্রশ্ন এখন সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে।

সরকার বলছে, “বিক্ষোভ ছিল উসকানিমূলক”

পুলিশ বলছে, “আমরা আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েছিলাম”

এনসিপি বলছে, “সরকার সাধারণ মানুষকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে”

তবে এ কথাও সত্য, প্রাণহানি যাদের হয়েছে, তারা রাষ্ট্রের নাগরিক। তারা কোনো রাজনৈতিক পক্ষের নয়, তারা এই দেশের সাধারণ মানুষ। সে কারণে প্রশ্নটা এখন খুব জোরালোভাবে উঠে আসছে— এই হত্যার দায় কে নেবে? কে দেবে নিহত পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ, ন্যায়বিচার আর দায়ীদের শাস্তি?

তদন্ত ও ভবিষ্যৎ করণীয়
ঘটনার পর সরকার একটি এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যা বিরোধী দলসহ নাগরিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। তারা চাচ্ছে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের পর্যবেক্ষণ।

একজন সাবেক বিচারপতির মতে, “এটি একটি স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় বর্বরতার উদাহরণ। যদি তদন্ত সুষ্ঠুভাবে না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে জনগণের রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা আরও কমবে।”

গোপালগঞ্জের পদযাত্রা রক্তাক্ত হয়েছে। নিহত হয়েছেন নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। এই মৃত্যু কোনো সংখ্যার খেলা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, মানবিকতা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। এ মুহূর্তে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

এই মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের, কারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব।

(ডিসি/এএস/জুলাই ১৮, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test