E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মাহেরীন চৌধুরী: শিশুদের বাঁচাতে নিজেকে উৎসর্গ করা আলোকিত নক্ষত্র

২০২৫ জুলাই ২২ ১৯:০৩:১৭
মাহেরীন চৌধুরী: শিশুদের বাঁচাতে নিজেকে উৎসর্গ করা আলোকিত নক্ষত্র

ওয়াজেদুর রহমান কনক


মাহেরীন চৌধুরী—একটি নাম, যা আজ শুধু একটি নাম নয়, এটি একটি গল্প, একটি বাতিঘর, একটি উজ্জ্বল প্রদীপশিখা, যা নিভে গেলেও তার আলো হাজারো হৃদয়ে ছড়িয়ে যাবে অনন্তকাল। ঢাকার উত্তরার শান্ত দুপুর হঠাৎই রক্তাক্ত হলো যখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান গর্জন করতে করতে আছড়ে পড়ল কোমলমতি শিশুদের স্কুল ভবনের ওপর। হাহাকার, ধোঁয়া আর দগ্ধ মানুষের আর্তনাদ ছাপিয়ে তখনও একজন মানুষের মন ভেঙে পড়েনি—তিনি মাহেরীন চৌধুরী।

কে এই মাহেরীন? তিনি তো সাধারণ এক শিক্ষিকা—শিশুদের হাত ধরে অ, আ, ক, খ শেখানো এক নির্ভীক অভিভাবক। কিন্তু বিপদের মুখোমুখি হয়ে যিনি নিজের ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের বুকের ভেতর আগলে রাখলেন, তাদের মৃত্যু থেকে ছিনিয়ে আনলেন—তিনি আর কেবল একজন শিক্ষিকা নন, তিনি এই সমাজের শুদ্ধতম সাহসের প্রতীক।

ধোঁয়া আর আগুনে যখন চারপাশ অন্ধকার, মৃত্যু যখন নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছিল বারবার, তখন মাহেরীন চৌধুরী পেছনে তাকাননি। তিনি ভয় পাননি—তখন তার চোখে ছিল কেবল মায়ের চোখ, সন্তানের জন্য এক বুক মমতার আগুন। তিনি ছুটেছেন, ছোট ছোট হাতগুলোকে শক্ত করে ধরে বলেছেন, “চলো, তোমরা বাঁচবে, কিছু হবে না।” আর নিজের জীবন? সে জীবন তিনি তুচ্ছ করে দিয়েছিলেন, কারণ তার কাছে তার সন্তানরা আগে।

কতজন পারে এমন? কতজন পারে জীবন আর মৃত্যু দুহাত ভরে মাপতে মাপতে বেছে নিতে অন্যের জীবন? মাহেরীন পারেন, তাই তিনি অমর হয়ে গেলেন। শেষ শিশুটি বের করে দিতে দিতে যখন ভবনের ভাঙা অংশ তাকে গিলে খেল, তখনও হয়তো তিনি ভাবছিলেন, “আরেকটা বাচ্চা বাকি আছে কি না?” জ্বলন্ত দেয়ালে আটকে গিয়েও হয়তো তার ঠোঁটের ফাঁকে ছিল প্রার্থনা—“হে আল্লাহ, আমার সন্তানদের তুমি বাঁচিয়ে রেখো।”

লাইফ সাপোর্টে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন মাহেরীন চৌধুরী। ৮০ ভাগ দগ্ধ শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যেও তিনি ছিলেন এক নির্ভীক যোদ্ধা। কে বলতে পারে, হয়তো সে বেডের পাশে থাকা ছোট ছেলেমেয়েদের ছবি আর তাদের কচি মুখগুলোই তাকে শেষ মুহূর্ত অবধি বাঁচার শক্তি জুগিয়েছে—যদিও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে, তবু তার ত্যাগের কাছে মৃত্যুও যেন মাথা নত করেছে।

নীলফামারীর জলঢাকার এই মেয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ। তিনি ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি—এক গর্বিত পরিচয়, কিন্তু তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি নিজ হাতে গড়ে নিয়েছেন: তিনি এমন একজন মানুষ, যার বুকের ভেতর মানুষের জন্য ভালোবাসা ছিল সীমাহীন।

আজ তার জন্য কান্না থামছে না তার শিক্ষার্থীদের, থামছে না সহকর্মীদের, থামছে না দেশের কোটি মানুষের হৃদয়। কতজন বাবা-মা এই ক্ষণে ছেলের-মেয়ের হাত ধরে কাঁপা গলায় বলছেন, “বাবা, তোমার এই শিক্ষিকা তোমাদের জন্য কী করেছেন, জানো?” একজন মানুষ কতটা মহান হলে এমনভাবে নিজের জীবন দিতে পারেন? একজন মানুষ কতটা নির্ভীক হলে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ২০টি প্রাণ বাঁচিয়ে দিতে পারেন?

আমরা শোকাহত, আমরা গর্বিতও। কারণ এই দেশে মাহেরীন চৌধুরীর মতো মানুষ জন্মেছেন—যিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, বীরত্ব কোনো পোশাকের গায়ে লেখা থাকে না, বীরত্ব থাকে অন্তরের গভীরে। একজন শিক্ষিকা যে একজন সৈনিকের চেয়েও বড় হতে পারেন, তা আজ আর কোনো বইয়ে লিখে শেখাতে হবে না—মাহেরীন চৌধুরীর গল্পই যথেষ্ট।

আল্লাহ তার ত্যাগকে কবুল করুন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন। তার মা-বাবা, স্বজনদের বুকের শূন্যতাকে তিনি তার সাহস আর ভালোবাসার অমর কাহিনিতে পূর্ণ করে গেছেন। এই সমাজের প্রতিটি স্কুল-কলেজের দেয়ালে আজ থেকে আরও একটি নাম লেখা থাকবে—শহীদ শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী।

যেখানেই থাকো, নক্ষত্র হয়ে আলো দিও আমাদের। আমাদের বাচ্চারা যেন তোমার মতো সাহস শিখে, দায়িত্ব শিখে, ভালোবাসতে শিখে মানুষের জন্য। তুমি অমর, মাহেরীন। তোমার নাম, তোমার সাহস, তোমার ত্যাগ আমাদের বুকের ভেতর পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকবে—ভয়হীন, নির্ভীক, অমলিন।

শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, অশ্রু আর প্রার্থনা—সব তোমার জন্য, আমাদের মাহেরীন চৌধুরী।

ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিয় শিক্ষিকা, নীলফামারীর জলঢাকার বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের এ্যাডহক কমিটির সম্মানিত সভাপতি, জলঢাকার গর্বিত সন্তান মাহেরীন চৌধুরী গতকাল এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। দুঃখজনকভাবে, তিনি শেষ পর্যন্ত সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

মাহেরীন চৌধুরী ছিলেন এক অসাধারণ সাহসী নারী। ৮০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়েও তিনি নিজের দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার সাথে ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থীর প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন। আগুন আর ধোঁয়ার ভেতর নিজ জীবনের পরোয়া না করে তিনি আতঙ্কিত শিশুদের একে একে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে থাকেন। তার এই আত্মত্যাগে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী প্রাণে বেঁচে যায়।

তার সহকর্মী, শিক্ষার্থী এবং পুরো নীলফামারী আজ শোকাহত। এমন বিরল সাহস আর ভালোবাসা চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। এক অভিভাবক জানিয়েছেন, ‘ম্যাডামের জন্যই আজ আমাদের সন্তানরা বেঁচে আছে।’ তার এই অসামান্য বীরত্ব আমাদের হৃদয়ে চিরকাল অম্লান থাকবে।

সরকার ইতিমধ্যেই এ দুর্ঘটনায় একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। মানুষের জন্য জীবন দিয়ে যাওয়া মানুষের সর্বোচ্চ গুণের প্রকাশ। মাহেরীন চৌধুরী তা বাস্তবে প্রমাণ করে গেছেন। তার আত্মা শান্তি পাক। মহান আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।

মাহেরীন চৌধুরীর ত্যাগ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলো ছড়িয়ে যাবে — এক সাহসিনী শিক্ষিকার অবিস্মরণীয় গল্প হয়ে। মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে, যা অল্প সময়ে সমস্ত জাতির হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগের গল্প ঠিক তেমনই এক ঘটনা। এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের বীরত্ব আর মানবিকতা এক অদৃশ্য আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে শত হৃদয়ে। মাহেরীন চৌধুরী তেমনই একজন, যিনি নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছেন সহপাঠ আর শিক্ষকতার জগতে এক অমলিন নক্ষত্র।

২১ জুলাইয়ের দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় চারদিক যখন বিভীষিকাময়, তখন তিনি হয়ে উঠেছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য শেষ ভরসা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরাসরি আছড়ে পড়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি সেকশনের একটি ভবনের ওপর। তখন ক্লাস চলছিল, ছোট ছোট বাচ্চারা ভয় আর কান্নায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ধোঁয়া, আগুন আর আতঙ্কের সেই ভয়াবহ ক্ষণে কেউ বাঁচার জন্য ছুটেছে বাইরে, কেউ প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার করেছে, আবার কেউ অসহায় হয়ে পড়েছে ধোঁয়ার ঘেরাটোপে।

ঠিক তখনই মাহেরীন চৌধুরী কোনো দ্বিধা না রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাদের রক্ষায়। তিনি বুঝেছিলেন, হয়তো আর ফিরতে পারবেন না, তবু পিছপা হননি। একজন মমতাময়ী শিক্ষিকার মনের মধ্যে তখন শুধুই বাচ্চাগুলোর মুখ ভাসছিল। তিনি একে একে অন্তত ২০ জন শিশুকে মৃত্যুর মুখ থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে বের করে এনেছেন। আগুন, ধোঁয়া, ভাঙা দেয়াল—সবকিছুকে উপেক্ষা করে তিনি দাঁড়িয়ে থেকেছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাশে। যাদের তিনি হয়তো কখনো মায়ের মতোই আগলে রাখতেন ক্লাসরুমে, তাদের জন্যই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গেছেন।

শেষবারের মতো আরেকটি শিশুকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে ফিরতে পারেননি মাহেরীন চৌধুরী। ভবনের একটি অংশ হঠাৎ ধসে পড়লে তিনি আটকে যান ধ্বংসস্তূপে। শরীরের আশি ভাগ পুড়ে গিয়েছিল, দগ্ধ দেহে লড়াই করেছিলেন হাসপাতালে, লাইফ সাপোর্টে শুয়েও যেন লড়ে গেছেন আরও কিছু বাচ্চাকে বাঁচানোর মতোই। জীবনের শেষ মুহূর্তেও যেন তার কণ্ঠে ছিল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ থাকার প্রার্থনা।

মাহেরীন চৌধুরী শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক অনন্য বীর। জলঢাকার সন্তান, নীলফামারীর গর্ব-এই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি হয়ে গেছেন মানবিকতার এক অক্ষয় চিহ্ন। এই জাতি হয়তো বহু নায়ক দেখেছে, কিন্তু এমন এক মানুষ, যিনি নিজের প্রাণ দিয়ে ২০ শিশুর জীবন রক্ষা করেছেন—তার উদাহরণ বিরল।

আজ তার পরিবার শোকাহত, তার শিক্ষার্থীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তার সহকর্মীরা শূন্যতার ভারে নিঃশব্দ। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক হয়তো এক দিনের, কিন্তু মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগের গল্প বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অভিভাবকেরা চোখের জল মুছে বলছেন, “আমার সন্তান বেঁচে আছে ওনার জন্য।” উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, “মাহেরীন ম্যাডামের বীরত্ব না থাকলে এই দুর্ঘটনা আরও ভয়াবহ হতো।”

একজন মানুষ যখন মানুষের জন্য বাঁচেন, তখনই তিনি অমর হয়ে ওঠেন। নক্ষত্র ঝরে পড়ে, কিন্তু তার আলো থাকে ছড়িয়ে আকাশ জুড়ে। মাহেরীন চৌধুরীর সাহস, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ এই দেশের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তার এই আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষকতা কোনো চাকরি নয়—এটি এক মহান ব্রত, এক অকৃত্রিম দায়িত্ব।

এই দেশ, এই সমাজ কখনো ভুলবে না মাহেরীন চৌধুরীর নাম। তার ত্যাগ আমাদের মনে সাহস জোগাবে, অন্ধকারে আলো দেখাবে। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন। তার রেখে যাওয়া মানবিকতার আলোয় নতুন প্রজন্ম শিখুক বীরত্ব আর সহমর্মিতা।

আমরা শোকাহত, আমরা কৃতজ্ঞ, আমরা গর্বিত।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test