E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস

একটি নীরব মহামারির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রতিরোধ

২০২৫ জুলাই ২৭ ১৭:২০:০৭
একটি নীরব মহামারির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রতিরোধ

ওয়াজেদুর রহমান কনক


বিশ্বে প্রতি বছর হেপাটাইটিসজনিত কারণে প্রায় ১১ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস-সম্পর্কিত লিভার সিরোসিস ও যকৃত ক্যানসার সবচেয়ে বড় কারণ। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে দীর্ঘমেয়াদে আক্রান্ত, অথচ এদের মধ্যে মাত্র ৯% ব্যক্তি জানেন যে তারা এই ভাইরাস বহন করছেন। বাংলাদেশে এ সমস্যা আরও মারাত্মক; ৮-১০ মিলিয়নের বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত এবং প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ এই রোগের জটিলতায় প্রাণ হারাচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালিত বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস (World Hepatitis Day) আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, হেপাটাইটিস কোনো নীরব ব্যাধি নয়—এটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ, যা সময়মতো সনাক্ত ও প্রতিরোধ না করলে এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস (World Hepatitis Day) প্রতি বছর ২৮ জুলাই বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস নয়, বরং বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এক সতর্ক সংকেত। দিনটি পালনের পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো হেপাটাইটিস সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, এর প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নির্মূল করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে রাষ্ট্র ও জনগণের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এই দিবসটি এমন একজন ব্যক্তির জন্মদিনে পালিত হয়, যিনি মানবজাতির জন্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কারের মাধ্যমে অসামান্য অবদান রেখেছেন—ড. বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ, যিনি ১৯৭৬ সালে এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

হেপাটাইটিস একটি যকৃতবাহিত রোগ যা প্রধানত পাঁচটি ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়—A, B, C, D ও E। এর মধ্যে হেপাটাইটিস B ও C বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২4 সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে দীর্ঘমেয়াদি আক্রান্ত। প্রতিবছর প্রায় ১.১ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিসজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ যকৃত ক্যানসার ও লিভার সিরোসিসের শিকার।

বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৯০% মানুষ জানেই না যে তারা এই ভাইরাস বহন করছেন। চিকিৎসার অভাব, দেরিতে শনাক্তকরণ এবং সচেতনতার অভাবের কারণে এদের অধিকাংশই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিল যে, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করা হবে—এই লক্ষ্য অর্জনে বহু দেশ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এখনো মাত্র ১২% আক্রান্ত ব্যক্তি হেপাটাইটিস সংক্রান্ত পরীক্ষার আওতায় এসেছেন এবং এর চেয়েও কম সংখ্যক চিকিৎসার আওতায় রয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হেপাটাইটিস একটি উদ্বেগজনক সমস্যা। বাংলাদেশ লিভার ফাউন্ডেশন, DGHS এবং WHO-এর যৌথ গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে আনুমানিক ৮-১০ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস বি আক্রান্তের হার ৫.৪% এবং হেপাটাইটিস সি আক্রান্তের হার প্রায় ১%। শহর ও গ্রামাঞ্চলের ব্যবধান এই রোগের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়, কারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা থেকে পিছিয়ে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ হেপাটাইটিস সম্পর্কিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো অজ্ঞতা, দেরিতে শনাক্তকরণ, চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা। অনেক ক্ষেত্রে রক্ত গ্রহণ, অপারেশন, দাঁতের চিকিৎসা বা কাচাঁ সিরিঞ্জ ব্যবহার হেপাটাইটিসের সংক্রমণের জন্য দায়ী।

এ রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো টিকা প্রদান। হেপাটাইটিস বি-এর প্রতিষেধক টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত এবং বাংলাদেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় শিশুরা এটি পাচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে টিকা গ্রহণের হার এখনো আশঙ্কাজনকভাবে কম। হেপাটাইটিস সি-এর জন্য এখনো কোনো কার্যকর টিকা নেই, তবে উচ্চমূল্যের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ (যেমন: সোফোসবুভির) ব্যবহারে এটি চিকিৎসাযোগ্য।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই নীরব ঘাতককে থামাতে হলে শুধু স্বাস্থ্যকর্মী বা সরকারি সংস্থার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। প্রয়োজন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার, স্ক্রিনিং ক্যাম্প, বিনামূল্যে পরীক্ষা, প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর কাছে টিকা সহজলভ্য করার উদ্যোগ এই দিবসের তাৎপর্যকে সফল করে তুলতে পারে।

একটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়, যে হারে COVID-19 নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সেই তুলনায় ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য প্রয়োজনীয় আগ্রহ বা রাজনৈতিক অঙ্গীকার এখনো অর্জিত হয়নি। অথচ হেপাটাইটিস দীর্ঘমেয়াদি মৃত্যু ও যকৃত জটিলতার অন্যতম প্রধান কারণ।

হেপাটাইটিস নিয়ে আমাদের ভাবনার সময় এখনই। এই দিনটি উপলক্ষে শুধুমাত্র শ্লোগান নয়, বরং যেন বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা ও প্রয়োগ শুরু হয়। প্রতিটি নাগরিককে নিজ উদ্যোগে রক্ত পরীক্ষা করানো, পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা, টিকা গ্রহণ করা এবং নিজের পরিবার ও সমাজকে সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস সেই দায়বদ্ধতারই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, হেপাটাইটিস এখন আর শুধুমাত্র একটি স্বাস্থ্য ইস্যু নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করার যে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল, বাস্তবতা বলছে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখনই দ্রুত এবং ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বর্তমানে বিশ্বে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৯৬ মিলিয়ন এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৫৮ মিলিয়ন মানুষ নিরবধি চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছেন। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো—প্রায় ১.৩৪ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর এই রোগে মারা যাচ্ছেন, যা এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো অন্যান্য সংক্রামক রোগের চেয়েও উচ্চতর।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, প্রতি ১০ জনের মধ্যে অন্তত ১ জন হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। অথচ এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষ এই রোগ সম্পর্কে সচেতন নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে হেপাটাইটিস বি টিকাদান কাভারেজ এখনো ২০% এর নিচে, যা জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি।

এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকা দেওয়া, সচেতনতা বাড়ানো, নিরাপদ রক্ত সংরক্ষণ ও বিতরণ নিশ্চিত করা, সঠিক স্যানিটেশন ও ক্লিনিক্যাল সরঞ্জাম ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

হেপাটাইটিস নির্মূলের পথে প্রতিটি দেশের প্রয়োজন নিজস্ব বাস্তবতাকে বুঝে প্রণীত নীতি, কার্যকর বাজেট বরাদ্দ এবং সর্বস্তরের মানুষকে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা। এই রোগ শনাক্তে সুলভ, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য টেস্ট পদ্ধতির বিস্তার এবং ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত না হলে হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াই অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

সুতরাং, বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের মূল শিক্ষা হলো—‘জানি, পরীক্ষা করি, চিকিৎসা নেই, রক্ষা করি’ এই চক্রটিকে কার্যকর করতে হবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি, তবে প্রতিটি দেরি আরও একটি প্রাণহানির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখনই উদ্যোগ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূল করার লক্ষ্য কেবল এক দূরাশাই থেকে যাবে।
বিশ্বে প্রতি বছর আনুমানিক ১১ লাখ মানুষ হেপাটাইটিসজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ। বর্তমানে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস বহন করছেন, অথচ এদের মধ্যে ৯০ শতাংশই জানেন না যে তারা আক্রান্ত। বাংলাদেশেও চিত্রটি উদ্বেগজনক—দেশে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত, এবং প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ এ রোগের জটিলতায় প্রাণ হারাচ্ছেন।

এই প্রেক্ষাপটে প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। দিনটি মূলত যকৃতের জন্য ভয়ানক এই ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। এই তারিখটি বেছে নেওয়া হয়েছে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ-এর জন্মদিন হিসেবে, যিনি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন এবং এর প্রতিষেধক টিকাও উদ্ভাবন করেন।

হেপাটাইটিস একটি সংক্রামক রোগ, যা প্রধানত পাঁচটি ভিন্ন ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয়—A, B, C, D ও E। এর মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সি সবচেয়ে মারাত্মক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৮৮৪,০০০ জন মানুষ মারা যান, যা এককভাবে এই রোগের ভয়াবহতা তুলে ধরে। অন্যদিকে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসেও প্রতি বছর প্রায় ৩৫০,০০০ জনের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের হার প্রায় ৫.৪% এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্তের হার প্রায় ১%। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে চিকিৎসা ও সচেতনতার ব্যবধান, অপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ, পুনর্ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন প্রভৃতি কারণে রোগটির বিস্তার ঘটে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৬ সালে ঘোষণা দেয় যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস নির্মূল করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান গতি বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, বহু দেশই এখনো এই লক্ষ্য অর্জনের সঠিক পথে নেই। ২০২৪ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল "We’re not waiting" — অর্থাৎ সময় নষ্ট না করে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা ও লিভার ফাউন্ডেশন সচেতনতামূলক প্রচার, বিনামূল্যে পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকে। গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ও আলোচনা প্রকাশিত হয়।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এই ভাইরাসজনিত নীরব ঘাতককে পরাজিত করতে হলে রাষ্ট্র, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রতিরোধই এই রোগের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। যথাসময়ে পরীক্ষা, টিকা গ্রহণ, নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিই পারে এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ থেকে আমাদের রক্ষা করতে। সময় এখনই—কারণ দেরি মানেই বিপদ আরও গভীরতর।

বিশ্বব্যাপী প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ এমন এক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা দীর্ঘদিন শরীরে নীরবে অবস্থান করে যকৃত ধ্বংস করছে। রোগটি হলো হেপাটাইটিস—ভাইরাসজনিত এক ধরনের যকৃতের প্রদাহ, যার ভয়াবহতা অনেক সময় ক্যানসার বা এইডসের মতো রোগকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালন করা হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস—এই ভয়াল নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিশ্বব্যাপী এক সচেতনতামূলক প্রয়াস।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিবছর এই রোগে ১১ লাখেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। শুধু হেপাটাইটিস বি ভাইরাসই বিশ্বব্যাপী ২৯৬ মিলিয়ন মানুষ বহন করছেন, যাদের বেশিরভাগই জানেন না যে তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত। আবার হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৫৮ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই চিকিৎসার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের অবস্থাও শঙ্কাজনক। দেশের বিভিন্ন গবেষণা ও স্বাস্থ্য রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিবছর এ রোগে প্রাণ হারান প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি টিকাদানের হার এখনো ২০ শতাংশের নিচে, যা জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি।

হেপাটাইটিস ভাইরাস পাঁচ প্রকার—A, B, C, D এবং E। এর মধ্যে বি ও সি প্রকার দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণের মাধ্যমে যকৃতের মারাত্মক ক্ষতি করে এবং লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের দিকে ঠেলে দেয়। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি এই ভাইরাস অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবার ও সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যদি না তিনি সময়মতো পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন।

এই রোগের সংক্রমণ ঘটে প্রধানত অসুরক্ষিত রক্ত সঞ্চালন, পুনর্ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, অনিরাপদ দাঁতের চিকিৎসা, জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে নবজাতকের শরীরে ভাইরাস প্রবেশ, এবং যৌন সংযোগের মাধ্যমে। জনসচেতনতার অভাব, নিরাপদ চিকিৎসা অভ্যাসের অভাব এবং রোগ শনাক্তকরণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা হেপাটাইটিসকে আরও মারাত্মক করে তুলছে।

তবে আশার কথা হলো—হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে কার্যকর টিকা রয়েছে, এবং হেপাটাইটিস সি বর্তমানে চিকিৎসাযোগ্য, যদিও তা বেশ ব্যয়বহুল। উন্নত দেশগুলোতে হেপাটাইটিস সি নির্মূলে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৬ সালে যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছিল—২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল—সেই লক্ষ্য অর্জনে সময়ের চেয়ে কাজের গতি অনেক পিছিয়ে। তাই ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল: “We’re not waiting”—অর্থাৎ সময় নষ্ট নয়, এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কিছু কার্যক্রম চললেও এখনও তা শহরকেন্দ্রিক এবং সীমিত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা, স্ক্রিনিং ব্যবস্থা, টিকা প্রদান, চিকিৎসা সহায়তা ও পরামর্শকেন্দ্র স্থাপন—এসব উদ্যোগ অনেকটাই অনুপস্থিত। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, রক্তব্যবস্থা নিরাপদ করা এবং জনগণকে উৎসাহিত করে রোগ পরীক্ষা করানো এখন সময়ের দাবি।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—হেপাটাইটিস শুধু এক ব্যক্তির সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ। একে রুখতে হলে দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ, সদিচ্ছা ও যথাযথ পরিকল্পনা। স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা, টেলিভিশনে সচেতনতামূলক প্রচার, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক কনটেন্ট ও সর্বোপরি সরকারি বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ভয়াল ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে হবে।

কারণ দেরি মানে মৃত্যু। আমরা যদি এখনই না জাগি, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি এক অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। সময় এখনই—জানি, পরীক্ষা করি, চিকিৎসা নেই, রক্ষা করি—এই চারটি ধাপে চললেই সম্ভব এই নীরব মহামারিকে রুখে দেওয়া।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৯ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test