E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধ: জাতির গর্ব, মর্যাদা ও চিরন্তন প্রেরণার ঐতিহাসিক প্রতীক

২০২৫ আগস্ট ১০ ১৭:৪৭:১৬
মুক্তিযুদ্ধ: জাতির গর্ব, মর্যাদা ও চিরন্তন প্রেরণার ঐতিহাসিক প্রতীক

আবীর আহাদ


বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক অনিবার্যতার ঐতিহাসিক প্রতীক। ১৯৭১ সালের এই সংগ্রাম কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতার লড়াই নয়; এটি ছিল হাজার বছরের বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকারের প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, যা আজও ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক ও ঐতিহাসিক সঠিকতা: ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। অর্থনৈতিক শোষণ, ভাষাগত বৈষম্য ও রাজনৈতিক দমননীতি ক্রমশ বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে ঠেলে দেয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় দমননীতি উপেক্ষা করে জাতি নিজের অধিকারের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির নকশা, যা বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণরায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

স্বাধীনতা ঘোষণা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা “অপারেশন সার্চলাইট” নামে বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এর প্রতিবাদে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক, যিনি সে সময় ঢাকার ওয়ারলেস, রেডিও ও টেলিভিশনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর Witness to Surrender (Karachi, Oxford University Press, 1977, p.75)-এ লিখেছেন:

> When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through a wavelength close to that of official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like a prerecorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People's Republic of Bangladesh.

অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে শেখ মুজিবকে “পাকিস্তানের শত্রু” আখ্যা দেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ তোলেন। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাতিল করা হয়।

গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা: প্রাভদা ও বিভিন্নআন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং ২ লাখেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন। এসব তথ্য মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি: বাংলাদেশের সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ হিসেবে “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা”কে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অতএব, মুক্তিযুদ্ধ কেবল ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আগে ভুটান ও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বহু দেশ আমাদের স্বীকৃতি প্রদান করে।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করে—যদিও মার্কিন বিরোধিতা ও চীনের ভেটোর কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, সাইমন ড্রিং, ডেভিড লুশাক, মার্ক টালির মতো বিদেশি বিশ্বখ্যাত সাংবাদিকরা তাঁদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠনে বড় ভূমিকা রাখেন।

অবমূল্যায়ন ও সাময়িক হতাশা: স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা, বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও পৈশাচিক অপমান, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও রাজাকারদের পুনঃপ্রবেশ, এসব ঘটনায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা গভীরভাবে হতাশ হন। তাঁদের কারও কারও মুখে শোনা যায়: “মুক্তিযুদ্ধ করা ঠিক হয়নি।”

তবে ইতিহাস প্রমাণ করে, এটি মুহূর্তের আবেগ ও ক্ষোভের প্রকাশ; মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক সঠিকতা এতে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি।

রাজাকার-আলবদরদের অপরাধ ও বিচারের ধারা: মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর, রাজাকার ও আল শামসরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হয়ে গণহত্যা ও ধর্ষণে জড়িত ছিল।

১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইন এবং ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বহু মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এটি জাতিকে মনে করিয়ে দেয়—মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের সাথে আপস নয়, ন্যায়বিচারই ইতিহাসের দাবি।

ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার: আজ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও প্রেরণা কাজ করছে। শিক্ষা, নারীর অধিকার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি—সব ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা আমাদের অনুপ্রেরণা।

কিছু মুক্তিযোদ্ধার হতাশা যতই থাকুক, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও মর্যাদা চিরকাল অম্লান থাকবে। সংবিধান, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ইতিহাস প্রমাণ করে—মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ন্যায্য, সময়োপযোগী ও অবশ্যম্ভাবী সংগ্রাম।

আমরা ভুলে যাব না—আমরা বীরের জাতি, মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরি। সাময়িক হতাশার মেঘ কেটে যাবে, আর মুক্তিযুদ্ধের সূর্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের পথ দেখাবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১০ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test