E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

অহংকার ক্ষণস্থায়ী, বিনয় চিরস্থায়ী

২০২৫ আগস্ট ২৮ ১৭:৫৯:৪৩
অহংকার ক্ষণস্থায়ী, বিনয় চিরস্থায়ী

মীর আব্দুল আলীম


মানুষের হাতে আসলে কিছুই থাকে না। জন্মের সময় আমরা আসি শূন্য হাতে, আর বিদায়ও নেই একইভাবে শূন্য হাতে। এই পৃথিবীর মাঝখানে যে অল্প ক’দিনের সফর, সেটিই আমরা নানা রঙে সাজাই-কখনো টাকা পয়সা দিয়ে, কখনো ক্ষমতা দিয়ে, কখনো পদবী-ডিগ্রির অহংকার দিয়ে। অথচ এগুলো আসলে একটা বালুর ঘর। এক ঝড় এলেই সব ভেঙে যায়। তবু মানুষ ভুলে যায় এই সত্য। ধনী গরিবকে তুচ্ছ করে, শিক্ষিত অশিক্ষিতকে অবজ্ঞা করে, ক্ষমতাবান অসহায়কে অপমান করে। অথচ যে অহংকারে ভর করে মানুষ অন্যকে ছোট করে, তার কোনো ভিত্তিই নেই। কারণ অর্থ, ক্ষমতা, সম্মান-এসবই ক্ষণস্থায়ী। মুহূর্তে চলে যেতে পারে। মানুষের প্রকৃত পরিচয় একটাই-তার মানবিকতা। যে মানুষ মাটির মতো সরল, বিনয়ী, সবার পাশে দাঁড়ায়, ভেদাভেদ ভুলে অন্যকে আপন করে নেয়-কেবল তার নামই টিকে থাকে মানুষের মনে। মৃত্যুর পরও তার স্মৃতি বেঁচে থাকে ভালোবাসার ভিতরে। তাই আমাদের প্রয়োজন অহংকার ভাঙা, মাটির মানুষ হয়ে থাকা।

অহংকার মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। অহংকার মানুষকে অস্থায়ী আনন্দ দিলেও আসলে এটি এক আত্মবিধ্বংসী ফাঁদ। কেউ ধনী হলে ভাবে-“আমি সবার চেয়ে বড়”, কেউ শিক্ষিত হলে ভাবে-“আমার ছাড়া কেউ কিছু জানে না”, কেউ ক্ষমতাবান হলে ভাবে-“আমাকেই সবাই মানতে বাধ্য।” অথচ এ সবই ভ্রান্ত ধারণা। অহংকার মানুষকে ভেতরে ভেতরে ফাঁপা করে তোলে। যে মানুষ অহংকার করে, সে অন্যকে ছোট করে দেখে। অন্যদের সঙ্গে সঠিকভাবে মিশতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে তার চারপাশের মানুষ দূরে সরে যায়। সে হয়তো বাহ্যিকভাবে ভীষণ শক্তিশালী, কিন্তু অন্তরে একাকীত্বে ভোগে। অন্যদিকে বিনয় মানুষকে প্রকৃত শক্তি দেয়। বিনয়ী মানুষ সহজেই সবার হৃদয় জয় করে নেয়। তার সঙ্গে সবাই থাকতে ভালোবাসে। কারণ সে অন্যকে হেয় করে না, বরং সম্মান দেয়। মনোবিজ্ঞানও বলে-অহংকার মানুষকে সাময়িক আত্মতৃপ্তি দিলেও ভেতরে ভেতরে তাকে শূন্য করে দেয়। বিপরীতে, বিনয় আত্মাকে পূর্ণ করে। তাই অহংকার আসলে সুখের শত্রু। যে বিনয়ী, সে-ই প্রকৃত সুখী।

আমাদের জন্ম শূন্য হাতে, মৃত্যুতে সব কিছু ছেড়ে যেতে হয়। অথচ জীবনের মাঝের সময়টুকুতে আমরা সামান্য সম্পদ পেয়ে গর্ব করি। ধরুন, কোনো ধনী ব্যবসায়ী হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তার পাশে কোটি টাকা জমা আছে, কিন্তু তিনি জানেন, সেই টাকা দিয়ে আর এক মিনিটও কিনতে পারবেন না। আবার কোনো ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, তার পদবী তাকে রক্ষা করতে পারছে না। এই সত্য বুঝতে পারলেই অহংকার ভাঙে। মৃত্যু সবাইকে সমান করে ফেলে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ক্ষমতাবান-অসহায় সবাই মাটির নিচে একইভাবে শায়িত হয়। তাই আমাদের অহংকার নয়, বিনয়ের শিক্ষা নিতে হবে। অন্যকে সম্মান দিতে হবে। মনে রাখতে হবে- মৃত্যুর পর কেবল কর্মই টিকে থাকে। টাকা, সম্মান, সৌন্দর্য-সব হারিয়ে যায়। কিন্তু ভালো কাজ, অন্যের প্রতি ভালো ব্যবহার অমর হয়ে থাকে মানুষের মনে।

অর্থের অহংকার ভঙ্গুরতা ও ভ্রান্তি! অর্থকে আমরা অনেকেই শক্তি মনে করি। অথচ অর্থ হলো নদীর স্রোতের মতো। আজ একদিকে আছে, কাল অন্যদিকে চলে যায়। ধনী হওয়ার মধ্যে দোষ নেই, কিন্তু অর্থ নিয়ে অহংকার করা মারাত্মক ভুল। ধনী মানুষ যদি অর্থ দিয়ে গরিবকে সাহায্য করে, তবে সে প্রকৃত অর্থেই ধনী। কিন্তু যদি সে দরিদ্রকে অবজ্ঞা করে, তবে সেই অর্থই একদিন তার পতনের কারণ হয়। কারণ সমাজ টিকে থাকে সহযোগিতা দিয়ে, অহংকার দিয়ে নয়। অর্থের অহংকার মানুষকে অমানবিক করে তোলে। তখন সে গরিবের কষ্ট দেখে না, ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দিতে চায় না। অথচ প্রকৃত মহত্ব হলো-অর্থ দিয়ে অহংকার না করা, বরং মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা।

জ্ঞান ও ডিগ্রির অহংকার করা মোটেও ঠিক নয়। শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী ও সহনশীল করার জন্য, কিন্তু অনেক সময় আমরা দেখি ডিগ্রির অহংকার মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। অনেকে ভাবে-“আমার এত বড় ডিগ্রি, তাই আমি অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ।” অথচ প্রকৃত জ্ঞানীরা জানেন-“যত জানি, ততই বুঝি কত অজানা।” এই উপলব্ধি যত গভীর হয়, ততই মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং অন্যকে সম্মান করতে শেখে। তাই যে মানুষ শিক্ষা নিয়ে অহংকার করে, সে আসলে অর্ধশিক্ষিত। তাকে মূর্খ বললেও অত্যুক্তি হবে না, কারণ তার শিক্ষা আলোর পরিবর্তে অন্ধকার ডেকে আনে। প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে বিনম্র করা, মানবিক করা এবং সমাজে আলো ছড়ানো। একজন সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ নিজের জ্ঞান দিয়ে অন্যকে ছোট করেন না, বরং সবার কাছ থেকে শিখতে থাকেন। যেমন সক্রেটিস বলেছিলেন-“আমি শুধু এটুকুই জানি যে আমি কিছুই জানি না।” এই বিনয়ের ভেতরেই আছে জ্ঞানের আসল সৌন্দর্য। যে শিক্ষা মানুষকে কেবল অহংকারী করে তোলে, সেটি শিক্ষা নয়, বরং অর্ধসত্য। ইতিহাসে দেখা যায়, সত্যিকারের জ্ঞানীরা সবসময় বিনয়ী ছিলেন। তাঁরা কখনো নিজেদের জ্ঞানকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেননি। বরং তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও শিখতে লজ্জা পাননি। রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন কিংবা আল-বিরুনী তাঁদের প্রকৃত শক্তি ছিল এই বিনয়। তাই আমরা যদি সত্যিকারের জ্ঞানী হতে চাই, তবে প্রথম শিখতে হবে বিনয়।

ধর্মীয় অহংকার আসলে আধ্যাত্মিক বিকৃতির একটি রূপ। ধর্মের আসল শিক্ষা হলো বিনয়, ভ্রাতৃত্ব ও মানবিকতা। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখি, কেউ তার ধর্মীয় আচার বা অনুশীলন নিয়ে অহংকার করে বসে। সে ভাবে “আমি অন্যদের চেয়ে বেশি ধার্মিক, তাই আমি শ্রেষ্ঠ।” অথচ এই ধারণাই ধর্মের মূল আত্মাকে কলুষিত করে। কারণ ধর্ম কখনো অন্যকে ছোট করতে শেখায় না, বরং মানুষকে সমান চোখে দেখতে শেখায়। প্রকৃত ধার্মিক মানুষ জানেন- অহংকারই সবচেয়ে বড় পাপ। কোরআন, বাইবেল বা গীতাসব ধর্মগ্রন্থেই অহংকারকে শয়তানি প্রবৃত্তি বলা হয়েছে। যখন কেউ বলে “আমি অন্যদের থেকে উত্তম,” তখনই সে ধর্ম থেকে দূরে সরে যায়। ধর্মের মর্মকথা হলো বিনয়, সহানুভূতি ও আত্মশুদ্ধি। তাই যে মানুষ ধর্ম নিয়ে অহংকার করে, সে আসলে ধর্মের মূল শিক্ষা ভুলে যায়। ইতিহাসে আমরা দেখি, প্রকৃত ধার্মিকরা সবসময় ছিলেন বিনয়ী ও মানবিক। নবী-রাসূলরা, সাধু-সন্তরা, মহাপুরুষরা কখনো নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করেননি। তাঁরা সাধারণ মানুষের কষ্টকে নিজের কষ্ট ভেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের কাছে ধর্ম মানে ছিল মানবপ্রেম, করুণা আর বিনয়। তাই ধর্মকে যদি সত্যিকারভাবে ধারণ করতে চাই, তবে আমাদের অহংকার ভাঙতে হবে, অন্যকে সমানভাবে গ্রহণ করতে হবে। ধর্মের প্রকৃত আলো তখনই আমাদের জীবনে জ্বলবে, যখন আমরা বিনয়ের পথ ধরে হাঁটব।

মাটির মানুষ হয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। মাটির মানুষ মানে হলো সহজ-সরল, বিনম্র ও প্রকৃত অর্থে মানবিক মানুষ। যিনি জানেন, জীবনের শুরু যেমন মাটিতে, শেষও তেমনি মাটির সঙ্গেই। ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, পদবী, খ্যাতি সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। আজ তিনি সমাজে ধনী বা ক্ষমতাবান হলেও একদিন মৃত্যুর পর তাকে মাটির কাছেই ফিরে যেতে হবে। সেই সত্য উপলব্ধি করলেই অহংকার জায়গা করে নিতে পারে না। মাটির মানুষ হওয়া মানে অন্যকে ছোট না করে আপন করে নেওয়া। যে মানুষ জীবনে বিনয় চর্চা করেন, তিনি আশেপাশের মানুষকে সহজভাবে গ্রহণ করতে শেখেন। সমাজে তখন কোনো দেয়াল দাঁড়ায় না, বরং সম্পর্কের সেতু তৈরি হয়। গ্রামে যেমন সহজ-সরল মানুষরা একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়, তেমনি শহুরে জীবনে সেই অভ্যাস হারাতে বসেছে। অথচ প্রকৃত শান্তি লুকিয়ে আছে এই মাটির মানুষ হয়ে থাকার মধ্যেই। মাটির মানুষ হতে পারলে আমাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় ভালোবাসা, সমাজে আসে শান্তি। তখন আমরা উপলব্ধি করতে শিখি যে সম্পদ বা ক্ষমতা নয়, প্রকৃত মূল্য হলো মানবিকতা। মানুষের প্রকৃত শক্তি অহংকারে নয়, বিনয়ে।

ধনী-গরিব ভেদাভেদ একধরনের সামাজিক রোগ। আজকের সমাজে ধনী-গরিব ভেদাভেদ একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও ধনী ও গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। ধনীরা অনেক সময় নিজেদের ক্ষমতা ও সম্পদের কারণে গরিবকে অবজ্ঞা করে। অথচ সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো টিকিয়ে রাখার মূল ভরসা হলো শ্রমজীবী মানুষ। গরিবের শ্রম ছাড়া কারখানা চলে না, জমিতে ফসল হয় না, রাস্তাঘাট নির্মাণ হয় না। ইতিহাস সাক্ষী- যখন বৈষম্য অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখনই বিপ্লব ঘটে। ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল শাসক শ্রেণির বিলাসিতা ও সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবও বৈষম্যের কারণে বিস্ফোরিত হয়েছিল। অর্থাৎ ধনী-গরিব বিভেদ শুধু সমাজকে দুর্বলই করে না, রাষ্ট্রকেও ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। ধনী-গরিব ভেদাভেদ সমাজে ঘৃণা, হীনমন্যতা ও বিদ্বেষ তৈরি করে। অথচ সহযোগিতার ভিত্তিতে উভয় শ্রেণি মিলে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে। ধনীরা যদি সাহায্য করেন, গরিবেরা যদি আত্মসম্মান বজায় রেখে নিজের শ্রমকে মর্যাদা দেন, তবে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ধর্মও শেখায়-মানুষের প্রকৃত মূল্য কর্ম ও চরিত্র দিয়ে মাপা হয়, অর্থ দিয়ে নয়। তাই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া সমাজে শান্তি আসবে না।

অসম্মানের ভাষা হলো একধরনের অমানবিকতা। কাউকে অবজ্ঞা করে বা অসম্মানজনক ভাষায় কথা বলা সবচেয়ে বড় অমানবিকতা। কথার আঘাত শারীরিক আঘাতের চেয়েও বেশি গভীর হতে পারে, কারণ তা মানুষের আত্মসম্মানকে আহত করে। একজন মানুষ হয়তো দরিদ্র, হয়তো সামাজিকভাবে প্রভাবশালী নন, কিন্তু তাঁর প্রতি সম্মান হারালে সমাজে বিভেদ জন্ম নেয়। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা সমাজে-যেখানে অসম্মান দেখা দেয়, সেখানে সম্পর্ক ভাঙতে শুরু করে। ছোট ছোট অবজ্ঞার শব্দ সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে, ভালোবাসাকে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে যে মানুষ অন্যকে সম্মান করতে জানে, সে নিজেই হয়ে ওঠে প্রকৃত বড় মানুষ। সম্মানের ভাষা মানুষের হৃদয় জয় করে নিতে পারে। একজন শিক্ষক যদি ছাত্রকে সম্মান দেন, তবে সেই ছাত্র সারা জীবন তাকে শ্রদ্ধা করবে। একজন নেতা যদি সাধারণ মানুষকে সম্মান দেন, তবে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টিকে থাকবে। তাই অসম্মান নয়, সম্মানই মানবিকতার মূলভিত্তি।

বিনয়ের শক্তি হলো সম্মান অর্জনের পথ। অনেকের ধারণা বিনয় মানেই দুর্বলতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো—বিনয়ই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। একজন বিনয়ী মানুষ কখনো অন্যকে আঘাত করেন না, তিনি সবার মনে জায়গা করে নিতে পারেন। তাঁর ভদ্র আচরণ মানুষকে আকৃষ্ট করে, তাঁর পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। অহংকারী মানুষ হয়তো সাময়িকভাবে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা অর্জন করতে পারে না। ভয় কখনো স্থায়ী হয় না, একসময় মুছে যায়। কিন্তু ভালোবাসা থেকে যায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষকে একত্রিত করে। আর ভালোবাসা অর্জনের একমাত্র পথ হলো বিনয়। ইতিহাসে আমরা দেখি-যারা বিনয়ী ছিলেন, তাঁরাই মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। মহান ব্যক্তিত্বরা সবসময় বলতেন, বিনয় ছাড়া প্রকৃত সম্মান পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিনয়কে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, কারণ এটি সমাজে শান্তি ও সম্মান প্রতিষ্ঠার প্রকৃত পথ।

ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের জন্য অতিব জরুরী। ইতিহাস আমাদের শেখায়-অহংকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। মিশরের ফেরাউন তার ক্ষমতার অহংকারে মানুষকে দাস বানিয়েছিল, কিন্তু তার রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে। রোমান সম্রাটরা নিজেদের দেবতার সমান মনে করত, অথচ রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেছে। সমসাময়িক অনেক শাসকও অহংকারের কারণে পতিত হয়েছেন। ক্ষমতার নেশায় যারা মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, জনগণ একসময় তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসে কারো কারো নাম আজও ঘৃণার প্রতীক হয়ে আছে, কারণ তারা বিনয় হারিয়েছিল। অন্যদিকে, যারা বিনয় ও মানবিকতা চর্চা করেছেন, তাদের নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ইতিহাস তাই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়-অহংকার ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু বিনয় চিরস্থায়ী।

সমাজে শান্তি স্থাপনের উপায় কি? অহংকার সমাজে অশান্তি ডেকে আনে। ধনী-গরিব বিভাজন, ক্ষমতার দম্ভ, অবজ্ঞার ভাষা এসব মানুষকে একে অপরের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সমাজে তখন অবিশ্বাস বাড়ে, হিংসা জন্ম নেয়, একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা হারিয়ে যায়। যদি আমরা প্রকৃত অর্থে সমাজে শান্তি চাই, তবে অহংকার ভাঙতে হবে। সবাইকে সমান চোখে দেখতে হবে, একে অপরকে সম্মান দিতে হবে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহর-গ্রাম সব বিভাজন ভুলে মানুষের মধ্যে সমতা আনতে হবে। শান্তির সমাজ গড়তে হলে দরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ যদি মানুষের পাশে দাঁড়ায়, যদি সহযোগিতা ও ভালোবাসা চর্চা করে, তবে সমাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শান্তি জন্ম নেবে। আর সেই শান্তিই হবে স্থায়ী শান্তি।

পরিবারে অহংকারের প্রভাব পরে চরমভাবে। অহংকার শুধু সমাজকে নয়, পরিবারকেও ভাঙতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি অহংকার ঢুকে পড়ে, তবে ভালোবাসা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। একসময় সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়, পারস্পরিক বোঝাপড়া নষ্ট হয়। ভাই-বোন, বাবা-ছেলে, মা-মেয়ের সম্পর্কেও অহংকার ফাটল ধরায়। অল্প কিছু কারণে তৈরি হওয়া বিরোধ যদি অহংকারের কারণে বেড়ে ওঠে, তবে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যায়। অথচ পরিবারই হলো জীবনের প্রথম আশ্রয়স্থল, যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া উচিত। পরিবারকে শক্ত ও সুন্দর রাখতে চাইলে অহংকার দূরে রাখতে হবে। সম্মান ও ভালোবাসার চর্চা করতে হবে। ছোটখাটো ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে আপন করে নিতে হবে। পরিবারে যদি শান্তি থাকে, তবে সেই শান্তি সমাজেও ছড়িয়ে পড়বে।

শেষ কথা হলো- মানুষের জীবনে যা কিছু আছে-অর্থ, সম্মান, ক্ষমতা, সৌন্দর্য সবই সাময়িক। এগুলো একদিন হারিয়ে যাবে। মৃত্যুর পর কেউই এসব সঙ্গে নিতে পারবে না। কেবল থেকে যাবে বিনয়, মানবিকতা ও ভালোবাসা। অহংকার মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়, কিন্তু বিনয় মানুষকে কাছাকাছি আনে। তাই আমাদের জীবন সাজাতে হবে বিনয়ে। ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে, সবাইকে সমান চোখে দেখে আমরা যদি মাটির মানুষ হয়ে থাকতে পারি, তবে সমাজে প্রকৃত শান্তি আসবে।

মনে রাখতে হবে- মৃত্যু সবাইকে সমান করে দেয়। কিন্তু জীবনে যদি আমরা বিনয়ের অনুশীলন করতে পারি, তবে মৃত্যুর পরও থেকে যাবে আমাদের নাম; মানুষের মনে, ভালোবাসার স্মৃতিতে। এটাই প্রকৃত অর্থে মানুষের জয়।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৮ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test