E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

দল নয়, নেতৃত্বে আসুক নৈতিকতা

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৩ ১৭:৪৪:২২
দল নয়, নেতৃত্বে আসুক নৈতিকতা

মীর আব্দুল আলীম


নীতির নামে নাটক চলছে দেশে। আমাদের চাই ‘ব্র্যান্ডেড নেতা’! আমরা কাকে ‘ভালো’ বলি? যিনি মানবিক? না যিনি দলের মুখপাত্র? এই প্রশ্নে আজ গোটা রাজনীতি জর্জরিত। ‘ভালো মানুষ’ এখন এক সঙ্কুচিত ধারণা-যা দলীয় স্বার্থে গড়া ছাঁচে তৈরি। নৈতিকতা এখন প্রেস রিলিজে বন্দি, সৎ নেতৃত্ব কেবল পোস্টারে। দেশের রাজনীতি যেন এক মঞ্চ, যেখানে ভালো হওয়ার মানে নেতার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ বলা। আর সত্য বললেই আপনি ‘দলের বাইরে’। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন তুলতেই হয়—রাষ্ট্রের নায়ক কি কেবল দলের দাস হবে, না কি আদর্শের ধারক? ভালো মানে কি কেবল পরিচিত মুখ, না কি সত্যিকারের জনসেবক? সময় এসেছে দল নয়, নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার। নয়তো নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সমাজ পর্যন্ত ঢেকে যাবে দলতন্ত্রের অন্ধকারে।

কেউ কাউকে ভালো বলছে না। এটাই এখন যেন জাতীয় স্লোগান। জামায়াত বলছে, ওরা ধর্মহীন, আর নতুন রাজনীতিকরা বলছে, ‘পুরোনোরা সব চোর’। বিএনপি বলছে আওয়ামী লীগ ভয়ংকর। আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপি খারাপ। অন্তবর্তীকালনি সরকারও ভালো না। গণমাধ্যমও বিভক্ত- কেউ কারও ভালো দেখে না। অথচ প্রত্যেকেই চায় দেশ ভালো থাকুক। কিন্তু দেশ কি দল দিয়ে চলে? না চলে নীতির ওপর। আর এই নীতির সংকট আজ আমাদের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। আমরা মুখে ভালো মানুষ খুঁজি, কিন্তু কাজে শুধু নিজের স্বার্থ দেখি। এখন প্রশ্ন- ভালো কে? প্রশ্ন যখন মৌলিক, উত্তরও মৌলিক হওয়া উচিত। তাই চলুন দেখি- এই ‘ভালো’র পেছনে কী লুকিয়ে আছে।

দল নয়, ভালো হোক নেতাদের নীতি। একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি কখনোই কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল হতে পারে না-রাষ্ট্র টিকে থাকে নীতিতে, আদর্শে, মানবিক মূল্যবোধে। কিন্তু আমরা এমন এক বিভ্রান্ত স্রোতে ভেসে চলেছি, যেখানে রাষ্ট্র মানে একটি দল, এবং দল মানে রাষ্ট্র। ক্ষমতায় থাকা মানেই যেন অপরাধের দায়মুক্তি, আর বিরোধী দলে থাকা মানেই রাজনীতির অপরাধী। এই সংকীর্ণ মানসিকতা আমাদের গণতন্ত্রকে করেছে দলবাজির খেলাঘর, আর রাষ্ট্রপরিচালনাকে পরিণত করেছে বিভাজনের কারখানায়। আজ আমাদের সবচেয়ে বড় অভাব এক দলহীন, আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্বের। এমন মানুষ, যিনি নিজের বিবেককে শাসকের থেকেও বড় ভাবেন। যিনি দলের নির্দেশ নয়, দেশের কল্যাণকে প্রাধান্য দেন। আমরা যদি প্রতিটি দল থেকে সৎ, জ্ঞানী, নীতিনিষ্ঠ মানুষদের আলাদা করে সমাজের সামনে তুলে ধরতে না পারি, তবে দল বদলালেও দেশের ভাগ্য বদলাবে না। নেতৃত্বের বদলে কেবল পোশাক বদল হবে, আর জনগণ কেবল দর্শক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখবে-নতুন মুখে পুরোনো নিপীড়ন।

‘ভালো’ মানেই কি আপনার দলের লোক না! আমরা আজ এমন এক মানসিক কাঠামোতে বাস করছি, যেখানে ‘ভালো মানুষ’ মানে কেবল সেই, যে আপনার রাজনৈতিক দলের সদস্য। আপনার দলের সমর্থক। আপনার নেতার গুণগান গায়। অথচ মানুষটি হতে পারে অত্যন্ত মানবিক, নিঃস্বার্থ, দয়ালু, ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার-কিন্তু আপনি তাকেই ‘ভালো’ বলতে রাজি নন, কারণ তিনি আপনার দলের না। এই মানসিকতা শুধু সংকীর্ণ নয়, তা আত্মবিনাশীও। যখন নীতির বদলে দলীয় পরিচয় দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার হয়, তখন আসলে মরে যায় বিবেক, সমাজ হারায় নিরপেক্ষ চিন্তার স্পন্দন। একজন সমাজকর্মী, একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, একজন সাহসী সাংবাদিক—যদি আপনার দলবিরোধী মত পোষণ করেন, তাহলে কি তার সমস্ত গুণ অচল হয়ে যাবে? এটিই হচ্ছে আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সবচেয়ে গভীর চিহ্ন। দলীয় রঙ যদি সত্য ও মিথ্যার বিচার নির্ধারণ করে, তাহলে ন্যায়বিচার নিছক একটি খেলনা মাত্র। ভালো মানুষ মানে দলদাস নয়—ভালো মানে বিবেকবান, ন্যায়ের পক্ষে, মানবিক ও নীতিনিষ্ঠ। সেই ভালো মানুষ যিনি দেশের জন্য ভাবেন, দলের সুবিধার জন্য নয়।

নিজের স্বার্থ আগে দেখলে কেউই ভালো না: ভালো মানুষ হবার মানে কেবল মুখে দেশপ্রেমের বুলি আওড়া নয়। একজন নেতা কিংবা কর্মীর মূল পরীক্ষা হয় যখন তার স্বার্থ বনাম দেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব আসে। আজকাল আমরা এমন এক রাজনীতির রীতি গড়ে তুলেছি, যেখানে ‘দেশসেবা’ কথাটি নিছক ফর্মালিটি। বড় বড় কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকে পদ, প্রজেক্ট, কমিশন, বিদেশ সফরের আয়োজন। দেশকে সামনে রেখে শুরু, নিজের নামে মঞ্চে সমাপ্তি—এই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা। এরা বলে, “জনগণের পাশে আছি”, কিন্তু কাজ করে নিজের ব্যবসা, নিজের নিরাপত্তা, নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্য। তারা বলে “সাধারণ মানুষের কথা বলি”, অথচ সেই সাধারণ মানুষের খাজনা, ঘুষ ও দুর্ভোগে নিজেদের প্রাসাদ গড়ে তোলে। যারা নিজের বিলাসী জীবনকে দেশের ওপরে রাখে, তারা কোনোভাবেই ভালো মানুষ হতে পারে না। সত্যিকারের ভালো মানুষ সে-ই, যে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ায়-শুধু প্রচারের জন্য নয়, অন্তর থেকে।

এ দেশের নেতারা কেন আয়নাবিহীন, আত্মসমালোচনাহীন: এই সমাজে আয়নার সবচেয়ে বেশি দরকার যাদের, নেতারা আজ আয়নাহীন। নেতা হোন বা জনপ্রতিনিধি-নিজের ভুল দেখা, নিজের দোষ খোঁজা, নিজের আচরণ পুনর্মূল্যায়ন করার মতো বিবেক আজ তাদের অনেকেরই নেই। তারা ভুল করলেও তা স্বীকার করেন না, বরং জনগণ না বুঝুক, সেটাই যেন তাদের জন্য আশীর্বাদ। তারা ভাবেন, “মানুষ যদি ভুল না ধরতে পারে, তাহলে দায় নেব কেন?” অথচ সভ্যতা তখনই এগোয়, যখন নেতৃত্ব নিজের ভুল স্বীকার করতে শেখে। নিজেকে প্রশ্ন করার সাহস যেদিন হারিয়ে যায়, সেদিন নেতৃত্ব হয়ে ওঠে অহঙ্কারের প্রতিমূর্তি। আত্মসমালোচনা আসলে দুর্বলতা নয়-এটি মহত্বের সূচনা। একজন সত্যিকার নেতা তার ভ্রান্তির দায় নেয়, সংশোধন করে, এবং নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালী হয়। যারা কেবল বাহির দেখে খুশি, ভিতরের পচন দেখতে চায় না-তারা জাতিকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, স্থায়ী উন্নয়ন নয়। এবং তাই আত্মসমালোচনাহীন নেতৃত্ব মানেই জবাবদিহিহীন শাসন-যা কোনো সমাজের জন্যই কল্যাণকর হতে পারে না।

দুর্নীতির মুখে নৈতিকতা দাঁড়াতে পারছে না একদম। যেখানে দুর্নীতি দেশের প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে বসতি গড়ে, সেখানে ‘ভালো মানুষ’ টিকে থাকার লড়াই যেন আত্মাহুতি। আজকের বাস্তবতায় দেখা যায়, একজন নীতিবান কর্মকর্তা সৎ থাকলে সে নিজ দলে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। ভালো নেতা দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে দলের ‘হাই কমান্ড’ তার ওপর রুষ্ট হয়। এমন বাস্তবতায় নৈতিক মানুষ নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত, দেশ বাঁচানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। নির্বাচনের সময় নৈতিকতার কথা বলা হয়, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে সেই শব্দটিই হারিয়ে যায় দলীয় লোভ, কমিশনের ভাগাভাগি আর চুক্তির বাজারে। ভালো মানুষ যেন ‘বোকা’, আর চালাক মানেই চতুর দুর্নীতিবাজ—এই দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।

পয়সা, পরিচয়, প্রতিপত্তি-তিন ‘প’ এখন রাজনীতির যোগ্যতার মানদণ্ড! আজ একজন মানুষ কতটা বড় নেতা হবেন, তা ঠিক হচ্ছে তার ব্যাংক ব্যালান্স, দলীয় ‘কানেকশন’ আর মিডিয়া প্রভাব দিয়ে। মানুষ ভালো কিনা, তার চারিত্রিক দৃঢ়তা কেমন—সেগুলো মূল্যায়নের ক্ষেত্রেই আসছে না। এখন দলগুলো এমন এমন নেতাদের ‘প্রজেক্ট’ করছে, যাদের কাছে মূল কথা—‘কে কত টাকা তুলতে পারবে’ বা ‘কে কত জনসভা ভরাতে পারবে’। ভালো মানুষকে এই নতুন যোগ্যতার মানদণ্ডে পরাজিত হতে হয়। কারণ তার পয়সা নেই, প্রভাব নেই, কেবল বিবেক আছে। কিন্তু রাজনীতি যদি সত্যিকার অর্থে দেশের সেবার জন্য হয়, তবে দরকার পয়সা নয়, প্রয়োজন হূদয়ের সাহস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সাহস এখন দলের গাইডলাইনে নেই।

বলতে কষ্ট হয় মিডিয়াও এখন ভালোকে আড়াল করে। মন্দলোকগুলো ফেরেস্তা বনে যায়। মিডিয়া এমন এক যন্ত্র হয়ে উঠেছে, যেখানে ভালো মানুষ খবরের পাতায় আসে না, আসে চমক, বিতর্ক, নাটক, ধামাকা! যার মুখে যত চটকদার বুলি, সে তত আলোচনায়। অথচ নিরবে, নিষ্ঠায়, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে কাজ করে, তার জন্য মিডিয়ার জায়গা নেই। আজ মিডিয়া ভালো মানুষকে ‘বোরিং’ ভাবে, আর উত্তেজক ভাষার নেতাকে বানিয়ে ফেলে হিরো। ভালো নেতৃত্বকে আলোয় আনতে হলে, মিডিয়াকে অবশ্যই মূল্যবোধের প্রশ্নে নতুন করে ভাবতে হবে। সমাজের সেরা মানুষরা মিডিয়ার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে-এটাই আমাদের গণতন্ত্রের সবচাইতে বড় ক্ষতি।

শিক্ষিতরা রাজনীতিতে আসতে চায় না-কারণ নীতি হারিয়ে গেছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকে। কারণ তারা দেখেছে—সততা মানে বোকামি, প্রশ্ন করা মানে বেয়াদবি, আর নৈতিকতা মানে উপেক্ষা। রাজনীতি যেহেতু আর নীতিনির্ভর নয়, তাই শিক্ষিত ও আদর্শবান তরুণেরা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এতে দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়—বুদ্ধিমত্তা আর নেতৃত্ব একসঙ্গে না থাকলে রাষ্ট্রে কেবল গৃহপালিত কর্মীবাহিনী তৈরি হয়, সত্যিকারের চিন্তাবিদ নয়। ভালো মানুষরা রাজনীতি থেকে সরে গেলে, রাজনীতিতে জায়গা করে নেয় সুবিধাবাদীরা। এবং একবার তারা আসন পেলে আর বের হয় না-বরং তারা আদর্শকে গলা টিপে মারে, যেন কেউ আর ভবিষ্যতে কথা না বলে।

রাজনীতি এখন পেশা, আদর্শ নয়। একসময় রাজনীতি ছিল ব্রত, আজ তা এক লাভজনক পেশা। যেখানে চাকরি মেলে, জমি মেলে, নিরাপত্তা মেলে—আর মেলে ‘অপারেট ইউনিট’ নামের চোরাকারবারি কাঠামো। সেবার জায়গায় এসেছে পাওনার হিসাব। ফলে ভালো মানুষ, যিনি কিছু না চেয়ে কেবল কাজ করতে চান-তিনি হয়ে ওঠেন ‘অদক্ষ’, ‘অহেলিত’, এবং অবশেষে-‘অপসারিত’। ভালো রাজনীতি করতে হলে এটিকে পেশা নয়, আবারও ব্রত বানাতে হবে। দল নয়, নীতিই হতে হবে মানুষের শক্তি। মনে রাখতে হবে ভালো মানুষদের জায়গা দিলে বদলে যাবে রাজনীতির রঙ। এই সমাজে এখনো অসংখ্য ভালো মানুষ আছে। যাঁরা চুপচাপ, প্রচারবিমুখ, কিন্তু মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। তাদের যদি রাজনীতিতে জায়গা দেওয়া হয়, তারা যদি নেতৃত্বে আসেন—তাহলে রাজনীতি থেকে দূর হবে দম্ভ, দুর্নীতি আর দলাদলি। সমাজ ফিরে পাবে সহমর্মিতা, নেতৃত্ব ফিরে পাবে বিবেক। সত্যিকারের ভালো মানুষদের দলে দলে ডেকে এনে যদি রাজনীতি সাজানো যায়, তবে এই রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াবে। দল নয়, নেতৃত্বের মূলে আসবে নীতি। গণতন্ত্রে ফিরে আসবে মানুষ এবং রাষ্ট্র হয়ে উঠবে জনতার।

শেষ কথা একটাই-রাষ্ট্র গঠনে দল নয়, দরকার আদর্শ। আদর্শবান নেতা। রাজনীতি যদি হয় কেবল ক্ষমতার সিঁড়ি, তবে ‘ভালো মানুষ’ কেবল দর্শক হয়ে যাবে, আর দল হয়ে উঠবে একচ্ছত্র দানব। তাই হচ্ছে এদেশে। আমাদের দরকার এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে নেতা নয়, নেতৃত্ব কথা বলে। যেখানে দল নয়, নৈতিকতাই হয় পরিচয়। সততা, মানবতা ও দেশপ্রেমে জেগে উঠতে হবে। দল নয়- দেশ আগে ভাবতে হবে। ভালোকে ভালো বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর সে জন্য ফেরেশতা দরকার নয়, দরকার ফেরেশতার মত একজন সৎ মানুষ, যিনি নিজের স্বার্থ নয়- দেখবেন দেশের স্বার্থ। ভালো কে? আপনি! যদি আপনি নিজেকে বদলাতে পারেন। দল নয়, নীতিই হউক মানুষের শক্তি।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test