E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস

অন্যকে সাহায্য করুন, নিজের হৃদয়ও পূর্ণ করুন

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৪ ১৮:৪৬:৩৬
অন্যকে সাহায্য করুন, নিজের হৃদয়ও পূর্ণ করুন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫। এ দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস হিসেবে। ১৯৯৭ সালের এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান মানবতার প্রতীক, নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত মহীয়সী নারী মাদার তেরেসা। তাঁকে স্মরণ করতেই জাতিসংঘ ২০১২ সালে ৫ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে।এই দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবতার কল্যাণে প্রতিদিন দায়িত্ব নিতে হবে। দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলাই দিবসটির মূল লক্ষ্য।

দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা

অনেকে প্রশ্ন করেন— “এসব দিবস পালনের কী দরকার? সমাজ কি এতে বদলায়?” বাস্তবে, এসব দিবস আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে, মানুষকে ভাবতে শেখায় এবং মানবিক দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন আমরা জন্মদিন বা মৃত্যুদিন পালন করি প্রিয়জনের স্মৃতিতে, তেমনি আন্তর্জাতিক দিবসগুলো বিশ্বমানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার বার্তা দেয়।এই দিবস মানুষকে অনুপ্রাণিত করে—দানের মাধ্যমে সমাজের দুর্বল, দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। একদিনের উদযাপন যথেষ্ট নয়; বরং প্রতিদিন দাতব্য ও সেবা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া আবশ্যক। এমন উদ্যোগ সমাজে পরিবর্তন আনে, মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা ও মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করে।

বিশ্বের অনেক দেশে এই দিবস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তির উদ্যোগে উদযাপিত হয়। যেমন স্কুলে শিশুদের মধ্যে দানের সচেতনতা বৃদ্ধি, কলেজে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম ও সামাজিক প্রচারণা চালানো হয়। এসব কর্মসূচি দরিদ্র, অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষের জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করে।

মাদার তেরেসা: মানবতার প্রতিমূর্তি

মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট বর্তমান উত্তর মেসিডোনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই ধর্মীয় জীবন ও মানবসেবায় অনুরাগী ছিলেন তিনি। ১৮ বছর বয়সে আয়ারল্যান্ডে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে ভারতে আসেন।১৯৪৮ সালে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের পর কলকাতার রাস্তায় অসহায়, ক্ষুধার্ত ও রোগাক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। ১৯৫০ সালে তিনি মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষ্য ছিল অসুস্থ, অনাথ ও অবহেলিত মানুষদের আশ্রয় ও সেবা দেওয়া। পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়।

প্রায় ৪৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।

মাদার তেরেসার জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়—দান মানে শুধু অর্থ নয়, বরং সময়, শ্রম, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা বিলিয়ে দেওয়া। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও উদারতা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে মানবতার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস ঘোষণার পটভূমি

২০১১ সালে হাঙ্গেরির সংসদ ও সরকার মাদার তেরেসার মৃত্যুদিবসকে আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস ঘোষণা করে। পরে জাতিসংঘ বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেয়। দিবসটির লক্ষ্য হলো—দান ও মানবসেবার গুরুত্ব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাতব্য কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা।জাতিসংঘ মনে করে, মানবতার কল্যাণে প্রতিদিনই এগিয়ে আসতে হবে। তাই এই দিবস কেবল স্মরণে রাখার জন্য নয়, বরং নতুন উদ্দীপনা, সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ জাগিয়ে দেওয়ার জন্য।

দান ও দাতব্য: ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ

বিশ্বের প্রায় সব ধর্মে দানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে: জাকাত, ফিতরা ও সদকা দরিদ্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে। কুরআন ও হাদিসে দানশীলতাকে ঈমানের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সনাতন ধর্মে: পুরাণ ও শাস্ত্রে দানকে মহৎ কর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। প্রাচীন গুরুকুল প্রথায়ও দানকে শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

বৌদ্ধ ধর্মে: দানকে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও আত্মার বিকাশের পথ হিসেবে ধরা হয়।

খ্রিস্ট ধর্মে: ভালোবাসা, সেবা ও দানকে ঈশ্বরের নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বলা হয়েছে।

সব ধর্মই দানকে শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও মানবতার জয় হিসেবে তুলে ধরে।

কেন দরকার দাতব্য?

আজকের বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশেও লাখো মানুষ অনাহার, অপুষ্টি ও চিকিৎসাহীনতায় ভুগছে। রাষ্ট্র একা সব সমস্যা সমাধান করতে পারে না। একজনের ক্ষুদ্র দানও অনেক সময় অন্যের জীবন বদলে দিতে পারে। একটি শিশুর পড়াশোনা, একজন রোগীর চিকিৎসা, অথবা একটি পরিবারের দুবেলা আহার—সবই সম্ভব ক্ষুদ্র দানের মাধ্যমে।দান মানুষের মধ্যে উদারতা, সহমর্মিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করে। এটি শুধু দাতা ও প্রাপককে নয়, সমগ্র সমাজকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবর্তিত করে।

দাতব্য কাজের বহুমাত্রিক গুরুত্ব

শিক্ষায় সহায়তা: দরিদ্র শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হয়।

স্বাস্থ্যসেবায় অবদান: অসহায় রোগীরা চিকিৎসা পায়।

সমাজ উন্নয়ন: কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে ওঠে।

মানবিক সম্পর্ক জোরদার: দান মানুষকে উদার ও সহমর্মী করে তোলে।

দান শুধুমাত্র আর্থিক নয়; এর মাধ্যমে মানসিক শান্তি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক মূল্যবোধও বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে দাতব্য কার্যক্রম

বাংলাদেশে দান ও দাতব্যের ঐতিহ্য বহু পুরনো। গ্রামীণ সমাজে ধনী কৃষকরা দরিদ্রদের সাহায্য করতেন। ব্যবসায়ীরা মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন করতেন। আজও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দাতব্য কাজে নিয়োজিত।এর মধ্যেই ২০২০ সাল থেকে জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস উপলক্ষে তারা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যেমন বিনামূল্যে স্বাস্থ্যপরীক্ষা, ওষুধ বিতরণ, শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম।

তরুণ প্রজন্ম ও দাতব্য

তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। যদি তারা মানবসেবায় এগিয়ে আসে, তবে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন দ্রুত ঘটবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলেছে, যারা দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

তাদের অংশগ্রহণ শুধু সমাজকেই সমৃদ্ধ করে না, বরং তাদের মধ্যে নৈতিক দায়িত্ব, নেতৃত্বগুণ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

ডিজিটাল দাতব্য উদ্যোগ

প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন দান কার্যক্রম আরও সহজ হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রাউডফান্ডিং সাইটের মাধ্যমে হাজারো মানুষ দ্রুত একত্রিত হয়ে অসহায়দের সাহায্য করতে পারছে। ডিজিটাল যুগে এই উদ্যোগ সমাজে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

অনলাইনে দান করার মাধ্যমে স্থান, সময় বা অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা প্রায় দূর হয়ে গেছে। ফলে দেশের যেকোনো প্রান্তের মানুষ অংশ নিতে পারছে।

আন্তর্জাতিক দাতব্য উদ্যোগের উদাহরণ

১. শিক্ষা সহায়তা: ভারতের ‘অকরাইড’ সংস্থা দরিদ্র শিশুদের জন্য বিদ্যালয় ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করে।

২. স্বাস্থ্যসেবা: আফ্রিকার ‘দ্য হেলথ চ্যারিটি’ অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করে।

৩. দুর্যোগে সাহায্য: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চ্যারিটি সংস্থা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষকে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরবরাহ করে।

৪. সামাজিক পুনর্বাসন: গৃহহীন ও অভাবী পরিবারের জন্য আবাসন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।এই উদাহরণগুলো দেখিয়ে দেয়, দাতব্য কার্যক্রম কেবল অর্থ দানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মানবিক সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনে।

জাতিসংঘের লক্ষ্য ও আমাদের দায়িত্ব

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক দাতব্য কার্যক্রম অপরিহার্য।আমাদের দায়িত্ব হলো—প্রত্যেকে সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের দুর্বল মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। ছোট্ট সাহায্যও অনেকের জীবনে আশার আলো জ্বালাতে পারে।

নতুন দাতব্য কার্যক্রমের প্রেরণা

১. পরিবেশ সচেতন দান: বৃক্ষরোপণ ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা।

২. প্রযুক্তি-ভিত্তিক দান: দরিদ্র শিশুদের জন্য কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও অনলাইন শিক্ষাসুবিধা প্রদান।

৩. সৃজনশীল উদ্যোগ: সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের মানবিক চেতনা বৃদ্ধি।

৪. স্থানীয় উদ্যোগ: কমিউনিটি হেলথ ও নিরাপত্তা প্রকল্পে সরাসরি অংশগ্রহণ।এই ধরনের কার্যক্রম শুধু অবলম্বনযোগ্য নয়, বরং সমাজকে আরও মানবিক ও সচেতন করে তুলতে সক্ষম।

পরিশেষে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস কেবল একটি দিন নয়, এটি মানবতার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রতীক। মাদার তেরেসার জীবন আমাদের শিখিয়েছে—দান মানে শুধুমাত্র অর্থ দেওয়া নয়, বরং নিজের সময়, শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে অন্যকে সাহায্য করা। আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার করা উচিত, সমাজ থেকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বঞ্চনা দূর করে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ক্ষুদ্র হোক বা বৃহৎ, প্রতিটি দানই মানবতার জয়গান, প্রতিটি উদ্যোগই অন্যের জীবনে আলো ফেলার এক সোনালী সুযোগ। দানের মাধ্যমে আমরা শুধু অন্যকে সহায়তা করি না, নিজের মন ও আত্মাকেও উন্নত করি। মানবকল্যাণের জন্য দান আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, যা সমাজে সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সহযোগিতার বন্ধনকে শক্তিশালী করে।

আজকের দিনে আমাদের মনে রাখতে হবে—একটি ছোট দানও অনেকের জীবন পরিবর্তন করতে পারে। তাই দানের প্রক্রিয়ায় অনাহুত স্বার্থ নয়, বরং নিঃস্বার্থ মানবিক ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। দান ও সহায়তার মাধ্যমে আমরা কেবল দারিদ্র্য হ্রাস করি না, বরং সমাজে ন্যায়, সমতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটাই। এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবতার সেবায় প্রতিটি প্রচেষ্টা মূল্যবান। প্রতিটি হাত, প্রতিটি হৃদয় যা সাহায্যের জন্য প্রসারিত হয়, সেটিই সত্যিকারের মানবিক জয়। আসুন, আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবসকে শুধু স্মরণীয় দিন নয়, বরং আমাদের মানবিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করি এবং প্রতিনিয়ত দান ও সহায়তার মাধ্যমে সমাজকে আরো মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধশালী করি।

লেখক : কলাম লেখক, গবেষক ও সংগঠক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test