E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

জীবন সুন্দর, আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে হাত বাড়াই

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৯ ১৮:৫৯:১০
জীবন সুন্দর, আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে হাত বাড়াই

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। ২০০৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা -এর যৌথ উদ্যোগে এই দিবসের সূচনা হয়। এর লক্ষ্য হলো সমাজে আত্মহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।

আত্মহত্যা আজকের যুগে একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি। WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারান, অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করছেন। ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এটি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও আত্মহত্যার হার ক্রমশ বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক।

আত্মহত্যার কারণসমূহ

আত্মহত্যার পেছনে নানা জটিল সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক কারণ থাকে। নিচে প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:

* মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা :- বিষণ্নতা, উদ্বেগ, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক অসুস্থতা আত্মহত্যার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।

* চাপ ও হতাশা :- পরীক্ষায় ব্যর্থতা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, বা পেশাগত চাপ অনেককে চরম হতাশায় ঠেলে দেয়।

* পারিবারিক কলহ ও সম্পর্ক ভাঙন:- স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, পারিবারিক অশান্তি বা প্রেমে ব্যর্থতা আত্মহত্যার অন্যতম কারণ।

* সামাজিক অবহেলা ও একাকিত্ব :- সমাজে অবহেলিত হওয়া, বন্ধুহীন জীবন বা দীর্ঘ সময় একা থাকার ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়।

* মাদকাসক্তি:- মাদক গ্রহণ মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা আকস্মিক আত্মহত্যার ঝুঁকি তৈরি করে।

* শারীরিক অসুস্থতা :- দীর্ঘস্থায়ী বা অচিকিৎসাযোগ্য রোগ যেমন—ক্যান্সার, কিডনি রোগ, পক্ষাঘাতগ্রস্ততা ইত্যাদি অনেককে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে বাধ্য করে।

* সামাজিক কলঙ্ক :- ব্যর্থতা, ধর্ষণের শিকার হওয়া, যৌন হয়রানি, যৌন অভিমুখ নিয়ে উপহাস—এসব সামাজিক কলঙ্ক অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।

* অর্থনৈতিক সমস্যা :- দারিদ্র্য, ঋণের বোঝা বা আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ আত্মহত্যাকে শেষ সমাধান মনে করেন।

* সাইবার বুলিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপ :- আজকের ডিজিটাল যুগে অনলাইনে ট্রল, হুমকি, মানসিক হয়রানি অনেক কিশোর-কিশোরীকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

* তাৎক্ষণিক আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা :- রাগ, অপমান, আকস্মিক দুঃখ বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অনেকে হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসেন।

আত্মহত্যার প্রকারভেদ

১. উদ্দেশ্যভিত্তিক আত্মহত্যা

* আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা :-যখন ব্যক্তি পরিবার, সমাজ বা ধর্মীয় বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং একাকীত্বে ভুগতে থাকে। * পরার্থক আত্মহত্যা :- সমাজ, ধর্ম বা গোষ্ঠীর স্বার্থে আত্মাহুতি দেওয়া। যেমন—যুদ্ধে আত্মবলিদান। * বিধিবদ্ধ আত্মহত্যা :- অতিরিক্ত দমন, শোষণ বা নিয়ন্ত্রণের কারণে আত্মহত্যা করা। যেমন—কারাগারে বন্দিদের আত্মহত্যা। * অসংগঠিত আত্মহত্যা :- অর্থনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতার কারণে যখন মানুষ হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করে।

২. পদ্ধতিভিত্তিক আত্মহত্যা

* বিষপান * ফাঁস লাগানো * আগুনে পুড়ে মৃত্যু * উচ্চ স্থান থেকে ঝাঁপ দেওয়া * অস্ত্র বা ধারালো বস্তু ব্যবহার
* নদী বা পানিতে ঝাঁপ দেওয়া

৩. মানসিক অবস্থাভিত্তিক আত্মহত্যা

* হঠাৎ আবেগপ্রসূত আত্মহত্যা :- ক্ষণিকের আবেগে সিদ্ধান্ত। * পরিকল্পিত আত্মহত্যা :- দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা করে করা। * চেষ্টাকৃত আত্মহত্যা :- সফল হয়নি, কিন্তু প্রচেষ্টা ছিল।

৪. বয়সভিত্তিক আত্মহত্যা

* শিশু ও কিশোর আত্মহত্যা * তরুণ আত্মহত্যা * প্রাপ্তবয়স্ক আত্মহত্যা * বয়স্ক আত্মহত্যা

৫. সামাজিক পরিস্থিতিভিত্তিক আত্মহত্যা

* দাম্পত্য কলহজনিত আত্মহত্যা * অর্থনৈতিক সংকটজনিত আত্মহত্যা * প্রেমঘটিত আত্মহত্যা * পরীক্ষার ফলাফল বা শিক্ষাজনিত আত্মহত্যা * পেশাগত চাপ বা চাকরি হারানোজনিত আত্মহত্যা

আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

১. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা :- বিষণ্নতা বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানের ব্যবস্থা করা জরুরি।

২. সচেতনতা বৃদ্ধি :- স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।

৩. পারিবারিক সহযোগিতা :- পরিবারকে হতে হবে সহানুভূতিশীল ও সহায়ক। সমস্যায় পড়া সদস্যকে শোনা, বোঝা ও পাশে দাঁড়ানো আত্মহত্যার ঝুঁকি কমায়।

৪. আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখানো:- রাগ, হতাশা, দুঃখ সামলানোর কৌশল শিখতে হবে। বা মানসিক প্রশিক্ষণ কাজে আসে।

৫. সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি :- বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা একাকিত্ব দূর করে, আত্মহত্যার ঝুঁকি কমায়।

৬. মাদক থেকে দূরে থাকা :- মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাই মাদকবিরোধী প্রচারণা বাড়ানো উচিত।

৭. ঝুঁকিপূর্ণ উপকরণ নিয়ন্ত্রণ :- কীটনাশক, আগ্নেয়াস্ত্র বা আত্মহত্যার জন্য ব্যবহৃত বস্তু সহজলভ্য না করা।

৮. যুব সমাজকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া:- ক্যারিয়ার গাইডেন্স, চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা জরুরি।

৯. আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন :- আত্মহত্যা প্রতিরোধে জাতীয় নীতি, হেল্পলাইন নম্বর এবং জরুরি মনোসামাজিক সাপোর্ট সেন্টার থাকা উচিত।

১০. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা :- ধর্মীয় শিক্ষায় জীবনকে মূল্যবান ও আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ হিসেবে তুলে ধরা আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সাম্প্রতিক চিত্র

বাংলাদেশে আত্মহত্যা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০–১৪,০০০ জন মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারাচ্ছেন। এটি সড়ক দুর্ঘটনার পর মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই প্রবণতা আরও উদ্বেগজনক। ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের প্রায় ৪.৪% এবং মেয়েদের প্রায় ৫.৮% আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক অস্থিরতা, মানসিক চাপ এবং সম্পর্কের সমস্যা এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের ৩৪টি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়— সারা জীবনে আত্মহত্যার চিন্তা: ২৪.২% গত এক বছরে আত্মহত্যার চিন্তা: ১৫% গত এক মাসে আত্মহত্যার চিন্তা: ৬.৭% সারা জীবনে আত্মহত্যার পরিকল্পনা: ৫.৬% গত এক বছরে পরিকল্পনা: ৫.২% সারা জীবনে আত্মহত্যার চেষ্টা: ৭% গত এক বছরে চেষ্টা: ৩.৯% এটি প্রমাণ করে যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, সামাজিক সমর্থন ও সহজলভ্য সেবা না থাকলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তাই পরিবার, স্কুল, সমাজ এবং সরকারের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে হোমিওপ্যাথি

আত্মহত্যার মূল কারণ সাধারণত গভীর হতাশা, একাকীত্ব, মানসিক চাপ এবং আত্মমর্যাদাহীনতা। এই অবস্থায় ব্যক্তি মানসিকভাবে অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং জীবনের প্রতি আগ্রহহীন হয়ে পড়ে। হোমিওপ্যাথি এই পরিস্থিতিতে মনকে শান্ত ও স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক প্রাকৃতিক পদ্ধতি। এটি মূল চিকিৎসার বিকল্প নয়, বরং মানসিক সমর্থনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রোগীর মানসিক ও শারীরিক লক্ষণ অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচন করেন। ইগনেশিয়া, নাট্রাম মিউরিয়াটিকাম, আর্সেনিক এল্ব, পালসেটিলা,সিপিয়া, কনভালারিয়া,ভেরাট্রাম অ্যালবাম যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তির মানসিক অবস্থা আলাদা, ঔষধ নিজে নিজে নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সঠিক ডোজ, সময় এবং ঔষধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। হোমিওপ্যাথি মূল চিকিৎসার বিকল্প , তবে এটি মানসিক স্থিতিশীলতা, উদ্বেগ প্রশমন এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে কার্যকর। নিয়মিত পরামর্শ ও সহায়তার মাধ্যমে একজন মানুষ হতাশা কমিয়ে আত্মসম্মান এবং জীবনের আনন্দ ফিরে পেতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব—যদি আমরা সকলে সচেতন হই, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করি এবং একে অপরের পাশে দাঁড়াই। প্রতিটি জীবনই অমূল্য। আজকের সমাজে মানসিক চাপ, পারিবারিক সমস্যা, একাকীত্ব ও হতাশা অনেকের জীবনকে বিপর্যস্ত করতে পারে। তবে সচেতনতা ও সহানুভূতির মাধ্যমে আমরা এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারি। পরিবার, বন্ধু ও সমাজকে আরও সহানুভূতিশীল ও সমর্থনশীল করে তোলা জরুরি, যাতে হতাশা বা মানসিক দুর্বলতার শিকার কেউ একা না থাকে। শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও সামাজিক সমর্থন একত্রে আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। হতাশার পরিবর্তে আশা, সহানুভূতি ও সমর্থনের আলোয় বাঁচার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি জীবন বাঁচানো মানে পুরো মানবজাতিকে বাঁচানো। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো জীবনকে মূল্য দেওয়া ও আশা সৃষ্টি করা।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test