E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ডাকসুর ছাত্ররাজনীতি থেকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন : অনিশ্চয়তার ঘনঘটা

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১০ ১৯:০৭:০০
ডাকসুর ছাত্ররাজনীতি থেকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন : অনিশ্চয়তার ঘনঘটা

মীর আব্দুল আলীম


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে ইতিহাস আবারও নতুন মোড় নিল। ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অপ্রত্যাশিত জয় যেন শুধু ছাত্ররাজনীতির নয়, গোটা জাতীয় রাজনীতিরও সঙ্কেত। ঠিক এ সময়েই ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে, যেখানে ক্ষমতাসীনদের দাপট আর বিরোধীদের প্রত্যাশা মিলেমিশে তৈরি করছে অনিশ্চয়তার দিগন্ত। এর মধ্যেই উঠেছে পিয়ার পদ্ধতির দাবি যা বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার খেলায় নয়, বরং ভোটের আসল অংশীদারিত্বে গণতন্ত্রের মানদণ্ড গড়তে হবে। তিনটি বিষয় আলাদা মনে হলেও, আসলে এগুলো একসুত্রে বাঁধা বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে হাঁটবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে এখন খোঁজার পালা। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি বহুবার জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নব্বইয়ের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল ছাত্রসমাজ। তাই আজ ডাকসুর এই পরিবর্তন শুধু একটি শিক্ষাঙ্গনের ঘটনা নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির দিকদর্শনও বটে।

ছাত্ররাজনীতির নতুন অঙ্ক: ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের উত্থান বাংলাদেশে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মতো প্রভাবশালী সংগঠনগুলো এত বছর ধরে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ডাকসুকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার ফলাফল দেখিয়ে দিল, তরুণ প্রজন্ম আর কেবল পুরোনো মুখ ও স্লোগান দিয়ে তুষ্ট হতে চাইছে না। অনেক শিক্ষার্থী ভোট দিল শিবিরকে কেবল মতাদর্শের কারণে নয়, বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিকল্প খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতার কারণে। এটি এক ধরনের ‘প্রতিবাদী ভোট’, যা বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।

প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের ধাক্কা: ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সবসময় ডাকসুর মতো সংগঠনকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার প্রদর্শনী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের প্রথম ডাকসু নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সব ক্ষেত্রেই এই দুই সংগঠন একচ্ছত্র আধিপত্য করেছে। কিন্তু এখন শিবিরের উত্থান তাদের জন্য বড় ধাক্কা। প্রশ্ন উঠছে, কেন এত বছর ক্ষমতা ভোগ করার পরও তারা তরুণ সমাজকে ধরে রাখতে পারল না? এটি মূলত ব্যর্থতার ফল যেখানে ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থেকেছে, অথচ শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যাকে উপেক্ষা করেছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে পিয়ার পদ্ধতির প্রশ্ন: প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা ‘পিয়ার পদ্ধতি’ বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বহুদিন ধরেই আলোচনায় আছে। ভারত, নেপাল, জার্মানি অন্য অনেক দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হয়। বাংলাদেশে বারবার অভিযোগ উঠেছে বড় দুই দলের বাইরে ছোট দলগুলোর কোনো অস্তিত্ব টিকে থাকে না। ডাকসুর ফলাফল সেই দাবিকে নতুন করে সামনে এনেছে। তরুণরা মনে করছে, ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হলে অন্তত সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথ খুলবে।

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সংশয়: বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস বিতর্কে ভরা। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ অভিযোগ সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ এখন ভোটের প্রতি আস্থাহীন। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মনে তীব্র সংশয়। মানুষ ভাবছে, এবার কি সত্যিই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, নাকি আবারও ক্ষমতার দাপটে একতরফা ফল বেরিয়ে আসবে? ভোটকেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা সবকিছু মিলিয়েই এখন জাতির সামনে এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

ছাত্রশিবিরের বার্তা: শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ভোট দিয়ে আসলে একটি বড় বার্তা দিয়েছে তারা পুরোনো শক্তিগুলির প্রতি আস্থা হারিয়েছে। অনেকে বলছে, এটি মতাদর্শের ভোট নয়, বরং পরিবর্তনের ডাক। এই প্রবণতা যদি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়, তবে দুই বড় দলের প্রভাব ক্রমশ ভেঙে পড়বে। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে বিকল্প খুঁজছে, তা ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে।

বড় রাজনৈতিক দল আর ক্ষমতাসীনদের চিন্তা: শিবিরের উত্থান ক্ষমতাসীনদের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। কারণ তারা জানে, শিক্ষাঙ্গনের বাতাসই একদিন জাতীয় রাজনীতির ঝড়ে রূপ নেয়। ১৯৮০-এর দশকে এরশাদের পতনের সময় যেমন ছাত্রদের আন্দোলন বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এখন যদি তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ বাড়তে থাকে, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে আগামী বছরগুলোতেও সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

বিরোধীদের উল্লাস: বিরোধীরা শিবিরের সাফল্যকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার শুরু করেছে। তারা দাবি করছে এটি জনতার পরিবর্তনের ইচ্ছার প্রতিফলন। ডাকসুর নির্বাচনে শিবিরকে ভোট দেওয়া অনেকটা ‘প্রতীকী বিদ্রোহ’, যা জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিরোধীদের ভাষ্য যদি শিক্ষার্থীরা এভাবে আস্থা হারিয়ে বিকল্পকে বেছে নিতে পারে, তবে সাধারণ মানুষও ফেব্রুয়ারিতে একই পথে হাঁটতে পারে হয়তে।

প্রশাসনের ভূমিকা: বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডাকসুর ভোটেও সেই অভিযোগ থেকে রেহাই মেলেনি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যদি প্রশাসন সঠিকভাবে পরিচালনা না করে, তবে তার বৈধতা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রশাসনের উপর জনগণের আস্থা ফেরানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রশাসন যদি কোনো দলের পক্ষ নেয়, তবে নির্বাচন যতই অংশগ্রহণমূলক হোক না কেন, তা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

তরুণ প্রজন্মের হতাশা: বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ তরুণ, এবং এরা মূলত চাকরি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার চায়। কিন্তু বারবার নির্বাচনে বিতর্কের কারণে তারা হতাশ হয়েছে। ডাকসুর ফলাফল অনেকটা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম। তরুণরা বিকল্প শক্তিকে ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল তারা পুরোনো রাজনীতির ব্যর্থতায় ক্লান্ত। এই হতাশা যদি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বড় আকার ধারণ করে, তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন শক্তি জন্ম নিতেও পারে।

পিয়ার পদ্ধতি না এলে সংকট: বাংলাদেশে বর্তমানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতি চালু আছে। এতে যে দল এক ভোট বেশি পায়, সেই দল পুরো আসন জিতে যায়। এর ফলে অনেক সময় ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হয় না। যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা লাখ লাখ ভোট পেলেও আসন পেল হাতে গোনা। তরুণরা মনে করছে এই অন্যায় পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে পিয়ার পদ্ধতি জরুরি। নইলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলও বিতর্কিত হবে এবং সংকট আরও গভীর হবে।

আন্তর্জাতিক নজরদারি: বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে সবসময় নজর রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, জাতিসংঘও বারবার স্বচ্ছ নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে। ডাকসুর নির্বাচনের ফল আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার খোরাক। প্রশ্ন উঠছে যদি শিক্ষার্থীরা বিকল্পকে বেছে নিতে পারে, তবে ফেব্রুয়ারিতে ভোটাররা কী করবে? আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে যদি নির্বাচন নিয়ে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

অর্থনীতি ও অস্থিরতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই চাপে। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভের পতন সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। এর মধ্যে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা যোগ হয়, তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাবে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যদি সহিংসতা ছড়ায়, তবে সেই দৃশ্য পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি প্রবল।

রাস্তায় উত্তাপ: বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই রাস্তায় উত্তাপ। নির্বাচন এলেই সমাবেশ, মিছিল, অবরোধ, হরতাল শুরু হয়। এতে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাকসুর ফলাফল বিরোধী শিবিরকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। তারা রাস্তায় শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোও পাল্টা কর্মসূচি দেবে। ফলে ফেব্রুয়ারির আগে দেশজুড়ে উত্তেজনা বেড়ে সহিংসতার আশঙ্কা বহুগুণ বাড়বে।

পথ কোন দিকে?

শেষ প্রশ্ন একটাই- বাংলাদেশ সামনে কোন পথে হাঁটবে? ডাকসুর নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম স্পষ্ট করে বলেছেতারা পরিবর্তন চায়। এখন জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই বার্তা শুনবে? নাকি আবারও পুরোনো দখলদার রাজনীতির পুনরাবৃত্তি হবে? ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। যদি এই নির্বাচনও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে বাংলাদেশ আবারও অনিশ্চয়তা, বৈধতার সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপে ডুবে যাবে।

শেষ কথা: ডাকসুর ফল কেবল ক্যাম্পাসের ভোট নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির আগাম ইঙ্গিত। তরুণরা যে পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছে, তা উপেক্ষা করলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ইতিহাস সাক্ষী, ছাত্ররাজনীতি বহুবার জাতীয় আন্দোলনের সূচনা করেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এই তিনটি ইস্যু আলাদা হলেও, মূল প্রশ্ন আসলে একটাই বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে?

লেখক :সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test