E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পৃথিবীর সুরক্ষা: ওজোন স্তর রক্ষার বিশ্বব্যাপী আহ্বান

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৫ ১৭:৫৪:০৮
পৃথিবীর সুরক্ষা: ওজোন স্তর রক্ষার বিশ্বব্যাপী আহ্বান

ওয়াজেদুর রহমান কনক


ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবসের মূল বার্তা হলো পৃথিবীর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়া ও আমাদের বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা করা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানবজাতি এবং পরিবেশের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারার ছোট ছোট পরিবর্তনও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। দিবসটি শুধুমাত্র ওজোন স্তর রক্ষার বৈজ্ঞানিক প্রয়াসকে স্মরণ করায় না, বরং বিশ্বজুড়ে মানুষের দায়িত্ববোধ, সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগের গুরুত্বকেও তুলে ধরে। এর মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি যে পরিবেশ সংরক্ষণ কেবল সরকারের বা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের সচেতন পদক্ষেপের ফলেই পৃথিবীকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। বিশ্বজুড়ে প্রতিটি উদযাপন এই বার্তা প্রচার করে যে—ওজোন স্তর রক্ষা মানে জীবনের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও বৈশ্বিক পরিবেশের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবসকে বিভিন্নভাবে উদযাপন করা হয়, যা সেই দেশের সামাজিক, শিক্ষামূলক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে দিবসটি সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ সংস্থাগুলোর উদ্যোগে পালন করা হয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সচেতনতা কর্মশালা, আলোচনা সভা এবং বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের ওজোন স্তরের গুরুত্ব, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা এবং পরিবেশ বান্ধব জীবনধারার ওপর জোর দেওয়া হয়। এছাড়া পরিবেশবাদী সংস্থা ও গবেষকরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতা প্রচার করেন এবং বিভিন্ন অনলাইন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা হয়।

ইউরোপের অনেক দেশে দিবসটি সরকারের সহযোগিতায় পালিত হয়। ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও জার্মানিতে বিশেষ থিম নির্ধারণ করে নাগরিকদের মধ্যে ওজোন সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝানো হয়। বিভিন্ন শহরে র‍্যালি, সাইকেল রাইড, বৃক্ষরোপণ অভিযান এবং বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষামূলক নাটক, কমিক, ভিডিও ও কাজের বই বিতরণ করা হয়।

আসিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে দিবসটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ সংস্থা এবং সরকারী দফতরের উদ্যোগে পালন করা হয়। জাপানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশেষভাবে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞান প্রদর্শনী, লেকচার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়, যেখানে ছাত্ররা ওজোন স্তরের ক্ষতি এবং পুনরুদ্ধারের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় অংশ নেয়। চীনে সরকারি মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতা প্রচারের পাশাপাশি উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও শিল্প ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারের প্রচার করা হয়।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলো, যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও চিলি, দিবসটিকে সামাজিক ও পরিবেশ সচেতনতার সঙ্গে সংযুক্ত করে উদযাপন করে। সেখানে স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে ওজোন স্তর সংরক্ষণের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে পরিবেশবান্ধব জীবনধারায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আর্জেন্টিনায় পরিবেশবাদী সংস্থা ও সরকারি দফতর মিলিতভাবে বনায়ন অভিযান, শহুরে উদ্যান পরিচর্যা এবং শিক্ষামূলক প্রচারণা চালায়।

বাংলাদেশেও প্রতিটি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর সরকারি দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ সংস্থা এবং সামাজিক সংগঠনগুলো মিলিতভাবে দিবসটি পালন করে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য র‍্যালি, পোস্টার প্রদর্শনী এবং সচেতনতা কর্মশালা আয়োজিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষক ও পরিবেশবিদদের লেকচার ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ওজোন স্তরের গুরুত্ব, তার ক্ষতি এবং পুনরুদ্ধারের উপায় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। সামাজিক ও অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের সচেতন করা হয় এবং পরিবেশ বান্ধব জীবনধারার জন্য উদ্ভুদ্ধ করা হয়।

বিশ্বের দেশে দেশে এই দিবসের উদযাপন প্রমাণ করে যে, ওজোন স্তর সংরক্ষণ কেবল একটি বৈজ্ঞানিক বা পরিবেশগত বিষয় নয়, এটি আন্তর্জাতিক সচেতনতা, শিক্ষা এবং নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীর জন্য একটি সাধারণ দায়িত্ব হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবস, বা আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস, প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। ১৯৮৭ সালের এই দিনে জাতিসংঘের উদ্যোগে মন্ট্রিল প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ওজোন স্তর ধ্বংসকারী রাসায়নিক পদার্থ—বিশেষত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC)—এর উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক চুক্তি। এই প্রোটোকলকে বৈশ্বিক পরিবেশ সুরক্ষার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল আন্তর্জাতিক সহযোগিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যাতে ওজোন স্তর সংরক্ষণ ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।

ওজোন স্তর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত এবং এটি সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি (UV-B) রশ্মির প্রায় ৯৭–৯৯ শতাংশ শোষণ করে। এর সুরক্ষামূলক ভূমিকা ছাড়া মানবজীবন ও পরিবেশ ঝুঁকির মুখে পড়ত। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৯৮০-এর দশকে অ্যান্টার্কটিকার ওপরে বিশালাকার ওজোন গর্ত তৈরি হয়েছিল, যা মানবসৃষ্ট রাসায়নিক নিঃসরণের ফলাফল। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ত্বকের ক্যান্সার, চোখের ছানি, এবং কৃষি ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ওজোন স্তর ক্ষয় অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন নতুন ত্বক ক্যান্সারের রোগী শনাক্ত হতে পারত।

মন্ট্রিল প্রোটোকলের সাফল্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক অনন্য উদাহরণ। বিশ্বব্যাপী ১৯৮টি দেশ প্রোটোকলে স্বাক্ষর করেছে এবং এর ফলে CFC ও অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। নাসার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে স্ট্রাটোস্ফিয়ারিক ক্লোরিনের ঘনত্ব ১১ শতাংশ কমেছে এবং অ্যান্টার্কটিকার ওজোন গর্ত ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে ২০৬৬ সালের মধ্যে ওজোন স্তর ১৯৮০-এর দশকের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।

এই দিবসটি শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্যের স্মারক নয়, এটি পরিবেশ সুরক্ষায় মানুষের সম্মিলিত দায়িত্বের প্রতীকও বটে। প্রতি বছর জাতিসংঘ একটি বিশেষ থিম নির্ধারণ করে—যেমন “মন্ট্রিল প্রোটোকল: আমাদের পরিবেশের জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স” বা “গ্লোবাল কো-অপারেশন প্রোটেক্টিং লাইফ অন আর্থ”—যার মাধ্যমে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষক ও সাধারণ মানুষকে ওজোন স্তর সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝানো হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিনার, র‍্যালি, প্রদর্শনী, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রদর্শন এবং সচেতনতামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কতটা কার্যকর হতে পারে। ওজোন স্তর রক্ষার লড়াই দেখিয়েছে, সময়মতো ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে পরিবেশগত সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। এটি জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নের মতো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবসের প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের অবস্থান ভূপৃষ্ঠের নিচু অঞ্চলে হওয়ায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি অনুভূত হয়। গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন এবং অতিবেগুনি রশ্মির কারণে ত্বক ক্যান্সার, চোখের ছানি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে। তাছাড়া কৃষি নির্ভর অর্থনীতি এবং নদীভিত্তিক বাস্তুতন্ত্রে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ফসল উৎপাদন ও সামুদ্রিক জীবনেও প্রভাব পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে যে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বৃদ্ধি পেলে পাট, ধান ও সবজির মতো প্রধান ফসলের উৎপাদনশীলতা কমতে পারে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি জটিল চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।

দিবসটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে কাজ করে। সরকারি দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ সংস্থা ও সামাজিক সংগঠনগুলো মিলিতভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে। স্কুল ও কলেজে র‍্যালি, পোস্টার প্রদর্শনী, সচেতনতা কর্মশালা এবং শিক্ষামূলক আলোচনা সভার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওজোন স্তরের গুরুত্ব ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষক ও পরিবেশবিদদের লেকচার ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ওজোন স্তরের ক্ষতি, তার প্রভাব এবং পুনরুদ্ধারের উপায় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়।

সামাজিক ও অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পণ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রচার করা হয়। এটি শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের দিকেই নয়, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। বাংলাদেশের জন্য এই দিবস একটি স্মরণীয় বার্তা বহন করে যে, বৈশ্বিক উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করলে দেশও পরিবেশগত সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম। এছাড়া এটি দেশের যুব সমাজকে উৎসাহিত করে পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য।

এই প্রেক্ষাপটে ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবস বাংলাদেশের জন্য শুধুমাত্র একটি আন্তর্জাতিক উদযাপন নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা, যা আমাদের শেখায় যে পরিবেশ রক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা একসাথে চালানো হলে দেশের স্থায়িত্ব, জনস্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test