E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

গানের শিক্ষক নিয়োগে বাধা হচ্ছে উগ্রবাদীরা

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৮ ১৭:৪৮:২৪
গানের শিক্ষক নিয়োগে বাধা হচ্ছে উগ্রবাদীরা

মারুফ হাসান ভূঞা


ব্যাঙের ছাতার মতো দেশের বৃহৎ দুর্নীতিবাজ, মাফিয়াদের দখল করা জমি, বাসা বাড়িতে হাজার হাজার মাদ্রাসা করবার পরও মনের আকুতি পরিপূর্ণ হয়নি ধর্ম ব্যবসায়ীদের। চালু করেছে পুরোনো বিধ্বংসী মডেলের বয়ান, এই বয়ান দিয়ে দিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, এখনো করে চলছে। সংগীত শিক্ষক বাদ দেওয়ার পূর্বে সংগীত কী? কেন? কিভাবে বাংলাতে এসেছে বুঝতে হলে যে ধর্ম চর্চা করেন, সে ধর্মের গতিপথটা দেখুন।

ইসলাম প্রচারের কাজে সুফি-আউলিয়ারা মধ্য এশিয়া ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ধরে এদেশের মানুষের নিকট ধর্ম নিয়ে আসে। এদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব বা বোঝাপড়ার জায়গাটা ছিল সংগীত, গান। সংগীতের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্মকে অন্তরে গেঁথেছেন। সার্বক্ষণিক গানের শব্দ, অর্থকে গাইতে গাইতে মহান ঈশ্বরকে অন্তরে আবিষ্কার করেন। সুযোগ পেলে আপনারা যারা ধর্মীয় দল সংসদীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সংগীত চর্চা করেন, সে সংগীত না। ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার সংগীত চর্চা করতেন তখনকার মানুষ। দিনের দাওয়াত দিতে আসা সুফিরা এই বাংলার লোকসংগীতের সুর ও কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে মুর্শিদি ও মারফতি ধারার গান রচনা করেন। এই গানে সৃষ্টিকর্তাকে 'মুর্শিদ' বা 'গুরু' হিসেবে কল্পনা করে তাঁর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রকাশ করার শিক্ষা দিতেন। এই গানগুলো বাংলার বাউল ও বৈষ্ণব ভাবধারার সাথে ইসলামের একেশ্বরবাদকে সাধারণ মানুষের অন্তরে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করতো। মসজিদে নিয়ে যেতো।

সামা মাহফিলের মাধ্যমে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, নিজামুদ্দিন আউলিয়ারা গান গেয়ে গেয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে ইসলামের প্রেম ও শান্তির বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। এছাড়া মুর্শিদি, মারফতি, জারি, শরিয়তি ও হামদ-নাত - গানের মধ্যে দিয়ে এদেশে ইসলামের অবয়ব মণ্ডল গড়ে উঠেছিল, সৃষ্টি হয়েছিল। এদেশের মানুষ সে গানকে আরো নানাভাবে ফুটিয়ে তোলে। কাজী নজরুল এসে মানবতা, সাম্যের গান লিখেছেন; হাসন রাজা, লালনরা ছাড়িয়ে গেছেন মানুষ থেকে মানুষে। বহু জাত, বহু ধর্মের মানুষকে মিলিত করেছেন শব্দ, ছন্দের তালে। সে তালে উজ্জীবিত হয়ে মানুষরা এদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে।

সে গান মাওলানা সাহেব! যে গান শিক্ষা, সুর শিক্ষা বাদ দিতে চাচ্ছেন। এই গানে মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা ভাসানীরা লড়াই করতেন। মাওলানা সাহেবরা বহু বাতিল, হারাম, কাতল করছেন এবার থামেন। মাদ্রাসা ব্যবসা সে ব্রিটিশ আমল থেকে করে আসছেন। এখন তো আপনাদের ব্যবসার পার্টনার হচ্ছে মার্কিনীরা। ক'দিন পর আপনাদের মাদ্রাসাগুলোতে "স্ট্যাচু অফ লিবার্টি" নির্মাণ করতেও ভুল করবেন না। কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দেবো না। আমরা এদেশের মাদ্রাসাকে মার্কিনিদের হাত থেকে রক্ষা করতে চাই। মার্কিনীদের প্রজেক্ট আমরা এদেশে চলতে দেবো না।

সুতরাং গানের শিক্ষক বাতিল নিয়ে যে ধরনের অরাজকতা, সহিংসতা ঘটাতে চাচ্ছেন, সেটা থেকে বের হয়ে আসুন। এসব কুৎসিত কর্মকাণ্ড ধর্মকে ব্যবহার করে করবেন না। ধর্ম দিয়ে রাজনীতি, ব্যবসা বাদ দিন। স্কুলে গানের শিক্ষক থাকবেই থাকবে। কোনোভাবে যদি মব ভায়োলেন্স কিংবা সহিংসতা, সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে বাতিল করতে চাই তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের বহু আশা-স্বপ্ন ছিল শিক্ষা সংস্কার কমিশন হবে, একটা গণতান্ত্রিক শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষা পদ্ধতি আমরা পাবো। একটা বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার ইতি ঘটবে। কিন্তু আমরা দেখলাম তথাকথিত এই একই ধর্ম ব্যবসায়ী গ্রুপের ইন্ধনে সে শিক্ষা সংস্কার কমিশন অন্যায্যভাবে বাতিল করা হয়েছিল। অথচ সে সংস্কার কমিশন আদৌ পুনঃগঠন হয়নি।

সংগীতের চর্চা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের বিকাশে প্রচণ্ড সহায়তা করে। এটি তাদের মনোযোগ, শৃঙ্খলা এবং গাণিতিক দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। দেহের ইন্দ্রিয়গুলো ঠিকভাবে কাজ করে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান, গণিত ও সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীতের মতো শিল্পকলার স্থান সংকুচিত হয়ে আসে, সেই ব্যবস্থা কেবল দাস তৈরি করে, পরিপূর্ণ মানুষ নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব রক্ষার চর্চায় শিক্ষার্থীদের গড়ে ওঠা ছাড়া মানুষ হওয়াটাই কঠিন। স্কুলে কেবল গানের শিক্ষক নয়, স্কুলে সিনেমার শিক্ষক, যৌন শিক্ষার শিক্ষক, নাচের শিক্ষক, ছবি আঁকার শিক্ষকও নিয়োগ দিতে হবে। উন্মুক্ত শিক্ষার আয়োজন তৈরি করতে হবে স্কুলগুলোতে। দেশের সমস্ত প্রাইমারি স্কুলে দিনে দিনে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। এটা একটা প্রজেক্ট যাতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ করা যায়।

গত কয়েক বছরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে তড়িৎ গতিতে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। হাজার হাজার প্রাইভেট মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল করা হয়েছে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে। আর এসবের সাথে তথাকথিত ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী নানাভাবে যুক্ত। এরা মূলত বিদেশিদের সার্ভ করার তাগিদে এসব এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে।

লেখক : লেখক ও প্রাবন্ধিক।

পাঠকের মতামত:

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test