E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবস: সচেতনতার আহ্বান

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৯ ১৮:২৩:০২
বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবস: সচেতনতার আহ্বান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় শনিবার “বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবস” পালিত হয়। দিবসটির উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ, প্রকৃতি ও মানবসমাজকে সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাখা। দূষণ, আবর্জনা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ কেবল প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে না, বরং এটি মানবস্বাস্থ্য, সামাজিক জীবন ও অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর পরিচ্ছন্নতা শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়; এটি একটি সভ্য সমাজ, উন্নত জাতি এবং টেকসই পৃথিবী গঠনের মূল শর্ত। পরিবেশ দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জটিলতা ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ভয়াবহতায় বিশ্ব যখন হুমকির মুখে, তখন পরিচ্ছন্নতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় শনিবার বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবস (World Cleanup Day) পালন করা হয়। এ দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পৃথিবী আমাদের সবার, তাই এটিকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও সবার।

দিবসটির সূচনা ও ইতিহাস

বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবসের সূচনা হয় এস্তোনিয়ায় (Estonia) ২০০৮ সালে। সে বছর ৩ লাখেরও বেশি মানুষ মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় ১০ হাজার টনের বেশি বর্জ্য পরিষ্কার করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আন্দোলনটির নাম ছিল “Let’s Do It”। পরে এটি আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং আজকের দিনে এসে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক পরিসরে “World Cleanup Day” ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তাঘাট, নদী-খাল, পার্ক, বনভূমি, সমুদ্র সৈকত এবং জনসমাগমস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। জাতিসংঘও পরিচ্ছন্নতা আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে এই দিবসকে উৎসাহিত করেছে।

দিবস পালনের উদ্দেশ্য

বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবসের মূল লক্ষ্য হলো—

১. মানুষকে বর্জ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা।

২. প্লাস্টিক দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত আবর্জনা কমানো।

৩. পরিবেশ সংরক্ষণে বৈশ্বিক ঐক্য গড়ে তোলা।

৪. সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করা।

৫. পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করা।

পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব

১. স্বাস্থ্য সুরক্ষায়: আবর্জনা ও ময়লা-আবর্জনা থেকে জীবাণু, মশা, মাছি, ইঁদুর প্রভৃতি রোগবাহী জীব জন্ম নেয়। এর ফলে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডসহ নানা মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এ ধরনের রোগ প্রতিরোধ করে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

২. পরিবেশ রক্ষায়: প্রকৃতি আমাদের জীবনের অবলম্বন। মাটি, পানি ও বায়ু যদি দূষিত হয়, তবে মানবজীবনও বিপন্ন হয়। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা মানে হলো পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা।

৩. নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধে: পরিচ্ছন্নতা একটি সভ্য সমাজের পরিচায়ক। ব্যক্তি ও সমাজ পরিচ্ছন্ন হলে সেটি জাতির সামগ্রিক উন্নতির প্রতিফলন ঘটায়।

৪. অর্থনৈতিক দিক: অপরিচ্ছন্ন শহর বা দেশ পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে পড়ে। বিপরীতে পরিচ্ছন্ন নগরী পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বর্তমান বিশ্বে পরিচ্ছন্নতার চ্যালেঞ্জ

১. প্লাস্টিক দূষণ: বিশ্বে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়। এর বড় অংশই ব্যবহারের পর পরিবেশে পড়ে থেকে মাটি ও জল দূষণ করে। সমুদ্রের প্লাস্টিক বর্জ্য ২০৫০ সালের মধ্যে মাছের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে—জাতিসংঘের এমন পূর্বাভাস রয়েছে।

২. নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি: দ্রুত নগরায়ণের ফলে বর্জ্য উৎপাদন বহুগুণ বেড়েছে, অথচ সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে।

৩. অজ্ঞতা ও উদাসীনতা: অনেকেই এখনো জানেন না সঠিকভাবে বর্জ্য ফেলার পদ্ধতি, আবার অনেকে জেনেও উদাসীন।

৪. সরকারি অবকাঠামোর অভাব: পর্যাপ্ত ডাস্টবিন, রিসাইক্লিং সেন্টার ও বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা আরও বাড়ছে।

৫. সমুদ্র দূষণ: নদী ও ড্রেন হয়ে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে গিয়ে জমা হয়। এতে সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ছে। গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হয়।

বাংলাদেশে পরিচ্ছন্নতা আন্দোলন

বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার টনেরও বেশি বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে অনেকটাই রাস্তা, খাল বা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে জলাবদ্ধতা, দুর্গন্ধ, মশার প্রজনন ও নানাবিধ রোগের বিস্তার ঘটে। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ব্যাপক কাজ করছে।

পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় করণীয়

১. ব্যক্তিগত উদ্যোগ:* নিজের ঘরবাড়ি, উঠোন ও আশপাশ সবসময় পরিষ্কার রাখা। * নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা ও রাস্তা-গলি পরিষ্কার রাখা।* প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহার করা। * শিশুদের ছোটবেলা থেকেই পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলা। * পানি, বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয় করা এবং গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা।

২. সামাজিক উদ্যোগ:- * স্থানীয় ও সম্প্রদায় ভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা।* স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো। * কমিউনিটি গার্ডেন বা ক্লিনিং প্রজেক্টে অংশগ্রহণ, যেখানে প্রতিবেশীরা সম্মিলিতভাবে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে।

৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: * ডাস্টবিন ব্যবহার নিশ্চিত করা ও আবর্জনা রাস্তায় না ফেলা। * বর্জ্য পৃথকীকরণ (Segregation) পদ্ধতি চালু করা—জৈব, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও অজৈব আলাদা করা।* পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও অব্যবহৃত সামগ্রী রিসাইক্লিং করা।

৪. সরকারি উদ্যোগ: * পর্যাপ্ত ডাস্টবিন, বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা এবং রিসাইক্লিং প্লান্ট স্থাপন।* পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। * পরিবেশ বান্ধব নগর পরিকল্পনা ও স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার, যেমন আবর্জনা পর্যবেক্ষণ ও রিসাইক্লিং ট্র্যাকিং।

৫. শিক্ষা ও সচেতনতা: * গণমাধ্যমে পরিচ্ছন্নতার প্রচার করা। * শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত করা। * কর্মশালা, সেমিনার ও ক্যাম্পেইন আয়োজন করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি।

৬. দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশ পরিকল্পনা: * বনায়ন ও সবুজায়ন কর্মসূচি চালানো। * দূষণ কমানো এবং জল, বায়ু ও মাটির মান রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ। * স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে টেকসই পরিবেশ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবসের তাৎপর্য

এই দিবস কেবল একটি প্রতীকী দিন নয়, বরং একটি বৈশ্বিক আন্দোলন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—“পরিচ্ছন্নতা শুরু হোক আমার থেকেই।” পৃথিবী নামক এই নীল-সবুজ গ্রহকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। ছোট ছোট পদক্ষেপ, যেমন প্লাস্টিক কম ব্যবহার, সঠিকভাবে ময়লা ফেলা, সচেতনতা বৃদ্ধি—এসব মিলেই বড় পরিবর্তন আনতে পারে।মহাত্মা গান্ধীর উক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক—“পরিচ্ছন্নতা স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।”

পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পরিচ্ছন্নতা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়, এটি একটি উন্নত, সুন্দর ও টেকসই পৃথিবী গঠনের মূল শর্ত। পরিবেশ দূষণ, বর্জ্যের স্তূপ এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা কেবল মানুষের শারীরিক ক্ষতি করে না, বরং সমাজ ও প্রকৃতির ভারসাম্যও নষ্ট করে। তাই পরিচ্ছন্নতা শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি সামাজিক ও বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা।

প্রতিটি মানুষ যদি নিজের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখে, পরিবারের সদস্যদের সচেতন করে, সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়, তবে পৃথিবী সত্যিই বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। ছোট ছোট উদ্যোগ এবং অভ্যাসের মাধ্যমে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। পরিচ্ছন্নতা কেবল দেহ-মন সুস্থ রাখে না, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও সবুজ পরিবেশ নিশ্চিত করে।

পরিচ্ছন্নতা এবং সচেতনতার এই বার্তাই বিশ্ব পরিচ্ছন্নতা দিবসের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিদিন আমাদের ছোট ছোট চেষ্টা যদি অবিরাম থাকে, তবে একদিন আমরা এমন এক পৃথিবী পাব যেখানে মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test