E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্য এখন সময়ের দাবি

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৪ ১৭:২৯:৩৭
মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্য এখন সময়ের দাবি

আবীর আহাদ


বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মরেখা রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত অক্ষরে। নয় মাসের সংগ্রাম, অসংখ্য শহীদের আত্মাহুতি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু সেই বিজয়ের অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও মর্যাদা নানা ষড়যন্ত্রে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, যারা ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিল, তারা আজও থেমে নেই; প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব নিয়ে তারা কখনও বঙ্গবন্ধুকে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল সত্তাকে আঘাত করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্য আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতিশোধপরায়ণ তৎপরতা

ক) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানপন্থী চক্রের পরাজয়ের পর তারা নতুন কৌশল নিয়েছে। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে জিততে না পেরে তারা ইতিহাসের ভেতর ঢুকে পড়েছে।

খ) একদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।

গ) অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে মিত্থাচার ও অপবাদ দিয়ে তাঁকেই 'স্বাধীনতাবিরোধী' (!)আখ্যায়িত করে জাতির তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।

ঘ) বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও নানা অপবাদ, তাচ্ছিল্য ও প্রশ্নবিদ্ধ মর্যাদার মুখোমুখি করা হচ্ছে।

এইসব কর্মকাণ্ড আসলে ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ারই ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুয়া অনুপ্রবেশের সমস্যা

দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্থ, আত্মীয়তার প্রভাব এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকাররাও সরকারি তালিকায় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় পেয়েছেন। এর ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছি, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এই অব্যবস্থাপনা কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ করছে না, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা ও জাতীয় পরিচয়

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। এর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে জাতীয় আত্মপরিচয়ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সংবিধানে যে চেতনার কথা বলা হয়েছে: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ- তার সবকিছুই মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত সংগ্রাম থেকে উৎসারিত। তাই মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা মানে সংবিধান, রাষ্ট্র ও জাতিকে অবমাননা।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: বিভক্ত মুক্তিযোদ্ধা সমাজ

রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি, ভাতা ও সম্মান দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এ বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী। ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে একক অবস্থান গড়ে উঠছে না। তরুণ প্রজন্মও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ফলে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

ক) ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

খ) বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেওয়া।

খ) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে উচ্ছেদ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

ঘ) তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস ও মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা।

ঙ) সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

ঐক্য গঠনের উপায়

১. দল-মত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ প্ল্যাটফর্ম তৈরি।

২. রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা, আর্কাইভ ও শিক্ষা সম্প্রসারণ।

৩. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তরুণদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

৪. গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপপ্রচারের মোকাবিলা।

৭১-এ মুক্তিযোদ্ধারা একক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন- অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ অর্ধশতাব্দী পর একইভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা রক্ষায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্য মানে ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যথাযোগ্য সম্মান প্রতিষ্ঠা, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সত্য চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। সময়ের দাবী: বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত নয়, ঐক্যবদ্ধ হোন; জাতিকে পথ দেখান, যেমন দেখিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test