E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস: কারণ, লক্ষণ ও যত্ন

২০২৫ অক্টোবর ০৫ ১৭:৫৩:৪২
বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস: কারণ, লক্ষণ ও যত্ন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছর ০৬ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস (World Cerebral Palsy Day)। এটি আন্তর্জাতিকভাবে উদযাপিত হয় এবং বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালন করা হয়। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

সেরিব্রাল পালসি এমন একটি অবস্থা যা আক্রান্ত শিশুর দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে সঠিক যত্ন, পুনর্বাসন ও চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক শিশু স্বাভাবিক জীবনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আজকের দিনে শুধুমাত্র রোগ সম্পর্কে তথ্য ছড়ানোই নয়, বরং সমাজে সহমর্মিতা, সমর্থন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করাও এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য।

বিশ্বে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতি বছর অনেক শিশু নতুনভাবে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। অনেক সময় পরিবারের লোকজনও সঠিক তথ্য জানেন না, ফলে শিশুর প্রাথমিক যত্ন ও চিকিৎসা সময়মতো পাওয়া যায় না। এই কারণেই সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সেরিব্রাল পালসি কী?

সেরিব্রাল পালসি (Cerebral Palsy বা CP) হলো এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যা, যা মূলত শিশুর মস্তিষ্ক ও পেশীতে প্রভাব ফেলে। এটি একক কোনো রোগ নয়; বরং এটি একাধিক স্নায়বিক সমস্যার সমষ্টি। শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি বা বিকাশজনিত সমস্যা গর্ভাবস্থায়, জন্মের সময় বা জন্মের পরে হতে পারে। এর ফলে শিশুর পেশী শক্ত বা ঢিলা হয়ে যায়, চলাফেরা ও সমন্বয় ঠিকমতো হয় না, এবং অনেক ক্ষেত্রে কথা বলা, শেখার ক্ষমতা, দৃষ্টি ও শ্রবণেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১.৭ কোটি মানুষ বিশ্বব্যাপী সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। প্রতি ১,০০০ শিশুর মধ্যে ২–৪ জন এই অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। এটি কোনো সংক্রামক রোগ নয়, বরং একটি স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা, যা জীবনব্যাপী প্রভাব ফেলে। তবে সঠিক চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি এবং সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে অনেক শিশু স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

সেরিব্রাল পালসির ধরন

সেরিব্রাল পালসির প্রধান ধরনগুলো হলো—

১. স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পালসি

* সবচেয়ে সাধারণ ধরন। * আক্রান্ত শিশুর পেশী শক্ত হয়ে যায়, ফলে হাত-পা নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়। * হাঁটা বা বসার সময় ভারসাম্য হারাতে পারে।

২. ডিসকাইনেটিক সেরিব্রাল পালসি

* শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়াচড়া করে। * কখনও হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে থাকে বা হঠাৎ নড়তে পারে।

৩. অ্যাটাক্সিক সেরিব্রাল পালসি

* ভারসাম্য ও সমন্বয়ে সমস্যা হয়। * শিশুর হাঁটাচলা বা লিখতে অসুবিধা হয়।

৪. মিশ্র ধরনের সেরিব্রাল পালসি

* একাধিক ধরনের লক্ষণ একসাথে দেখা যায়।

* পেশীর শক্তি ও সমন্বয়ে জটিলতা থাকে।

প্রতিটি শিশুর লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে। তাই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সবসময় শিশুর ব্যক্তিগত অবস্থার ওপর নির্ভর করে।

সেরিব্রাল পালসির কারণ

সেরিব্রাল পালসির প্রধান কারণ হল মস্তিষ্কের ক্ষতি বা বিকাশজনিত সমস্যা। এর পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে—

১. গর্ভাবস্থায়:

* গর্ভকালীন সংক্রমণ (যেমন—রুবেলা, সাইটোমেগালোভাইরাস)। * মায়ের পুষ্টিহীনতা বা বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাব। * ভ্রূণের মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে সমস্যা।

২. প্রসবকালে:

* প্রিম্যাচিউর (অকাল জন্ম) শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। * জন্মের সময় মাথায় আঘাত বা অক্সিজেনের অভাব। * জটিল বা দীর্ঘ প্রসব।

৩. জন্মের পরপর:

* মস্তিষ্কে আঘাত বা রক্তক্ষরণ। * মেনিনজাইটিস, এনসেফালাইটিসের মতো সংক্রমণ। * গুরুতর জন্ডিসের জটিলতা।
এর পাশাপাশি জিনগত ফ্যাক্টর, পরিবেশগত সমস্যা এবং পুষ্টির ঘাটতি ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ শিশুর বয়স এবং ক্ষতির মাত্রা অনুযায়ী ভিন্ন হয়। সাধারণত দেখা যায়—

* পেশী শক্ত বা ঢিলা হওয়া। * মোটর স্কিল শেখার ক্ষেত্রে দেরি (গড়াগড়ি, বসা, হাঁটা)।
* অনিয়ন্ত্রিত হাত-পা কাঁপানো। * কথা বলা বা উচ্চারণে সমস্যা। * খাওয়া বা গিলতে অসুবিধা।
* দৃষ্টি বা শ্রবণ সমস্যা। * মৃগীরোগ (Epilepsy) খিঁচুনি। * শেখার বা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার সমস্যা।

শিশুরা কখনও কখনও স্বাভাবিক শিশুদের মতো আচরণ করতে না পারলে পরিবারের জন্য মানসিক চাপও তৈরি হয়। তাই শুরু থেকেই সচেতনতা এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

রোগ নির্ণয়

সেরিব্রাল পালসির সঠিক নির্ণয় শুরু হয় শিশুর জন্মের প্রথম বছরেই। প্রধান নির্ণয় পদ্ধতিগুলো হলো—

১. শারীরিক পরীক্ষা:- পেশীর শক্তি, নড়াচড়ার ধরন, হাত-পার সমন্বয় পরীক্ষা করা হয়।

২. চিকিৎসা ইতিহাস:- গর্ভকালীন সমস্যা, জন্মের সময় জটিলতা বা আগের আঘাতের তথ্য নেওয়া হয়।

৩. চিত্রায়ন পরীক্ষা:- মস্তিষ্কের MRI বা CT স্ক্যান ক্ষতির স্থান ও মাত্রা নির্ধারণে সহায়ক।

৪. নির্দিষ্ট থেরাপি মূল্যায়ন:- ফিজিওথেরাপি বা স্পিচ থেরাপি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিশু কতটা সমন্বয়পূর্ণ বা স্বাভাবিক কাজ করতে পারে তা দেখা হয়। শিশুর চিকিৎসা শুরু করতে হলে দ্রুত এবং সঠিক নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসা পদ্ধতি

সেরিব্রাল পালসি স্থায়ীভাবে নিরাময়যোগ্য নয়, তবে যথাযথ চিকিৎসা ও যত্নের মাধ্যমে শিশুর জীবনমান অনেকাংশে উন্নত করা সম্ভব।

> চিকিৎসার ধাপ: এলোপ্যাথি

১. ঔষধ:-পেশীর খিঁচুনি কমানো ও মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত।

২. ফিজিওথেরাপি:-পেশী সচল রাখা, শক্তি বাড়ানো এবং সমন্বয় উন্নত করা।

৩. স্পিচ থেরাপি:- কথা বলার দক্ষতা ও খাওয়া-গিলতে সহজতা বাড়ায়।

৪. অকুপেশনাল থেরাপি:- দৈনন্দিন কাজ শেখায়, শিশুর স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

৫. শল্যচিকিৎসা:-গুরুতর ক্ষেত্রে হাত-পা বা হাড়ের গঠন সংশোধনের জন্য প্রয়োজন হতে পারে।

পরিবারের সমর্থন, বিশেষ বিদ্যালয়, পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং সমাজের সহায়তা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চিকিৎসার ধাপ :- হোমিওপ্যাথি

হোমিওপ্যাথি শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসার একটি পদ্ধতি। এটি শিশুর দুর্বলতা কমায়, পেশী শক্তি বাড়ায় এবং স্নায়ুবিক সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক। চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। সেরিব্রাল পালসির জন্য অভিজ্ঞা সম্পন্ন চিকিৎসকগন প্রাথমিকবাবে যেইসব ঔষধ নির্বাচন করে থাকে: ক্যালক্যার্বোনিকা, আর্নিকা, জেলসিয়াম, ফসফরাস, সাইলিসিয়া, ব্যারাইটা মিউরিয়াটিকা, কোনিয়াম, লাইকোপোডিয়াম, সালফার সহ আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে। তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এইজন্য সঠিক ঔষধ, নিয়মিত চিকিৎসা এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তদারকি শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও স্বনির্ভরতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ। হোমিওপ্যাথি শিশুর জন্য নিরাপদ ও কার্যকর একটি বিকল্প। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুধুমাত্র শারীরিক সমস্যার দিকে মনোযোগ দেয় না, বরং শিশুর মানসিক ও আচরণগত বিকাশেও সাহায্য করে। চিকিৎসার সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক উদ্দীপনা এবং সঠিক পুষ্টি সংযোজন করলে শিশুর জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হয়।

জটিলতা

সেরিব্রাল পালসি শুধুমাত্র পেশী সমস্যার সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়; এটি অনেক জটিলতা তৈরি করতে পারে—

* শারীরিক অক্ষমতা: শিশু চলাফেরায় ও দৈনন্দিন কাজকর্মে সীমাবদ্ধ থাকে।

* মৃগীরোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা: খিঁচুনি, হাড়ের বিকৃতি, হঠাৎ আঘাত।

* শিক্ষা ও মানসিক সমস্যা: শেখার অক্ষমতা, মনোযোগের সমস্যা।

* সামাজিক ও মানসিক চাপ: পরিবারে উদ্বেগ, শিশুর আত্মবিশ্বাসের অভাব।এই জটিলতাগুলো প্রতিরোধ ও সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকাংশে হ্রাস করা যায়।

বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবসের গুরুত্ব

বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস শুধু একটি স্মরণীয় দিন নয়। এটি সচেতনতা বৃদ্ধি, সহায়তা প্রদান এবং সমাজে পরিবর্তন আনার প্রতীক। এই দিবসের মাধ্যমে— * সাধারণ মানুষ সেরিব্রাল পালসি সম্পর্কে সচেতন হয়। * আক্রান্ত শিশু ও পরিবারের পাশে দাঁড়ানো যায়। * সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। * স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা যায়। * বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়। শিশু ও পরিবারকে সহায়তার মাধ্যমে সমাজে একটি ন্যায়সম্মত ও মানবিক পরিবেশ গড়ে তোলা যায়।

সেরিব্রাল রোগীর যত্ন

১. পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য খাবার দিন। ২. পর্যাপ্ত পানি পান করান। ৩. খাবার ধীরে খাওয়ান ও নিয়মিত সময় অনুযায়ী দিন।৪ . দাঁত ও মুখের পরিচর্যা নিশ্চিত করুন। ৫. চুল ও নখ পরিচর্যা করুন। ৬. পোশাক ও বেডশীট নিয়মিত পরিবর্তন করুন। ৭. হালকা ব্যায়াম ও প্রসারক ব্যায়াম করান।
৮. মাসাজ দিয়ে পেশী শক্তি বজায় রাখুন। ৯. চলাফেরায় সহায়তা দিন ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করুন। ১০. সময়মতো ঔষধ সেবন করান। ১১.নিয়মিত ডাক্তার দেখান। ১২. রোগীর সঙ্গে আলাপ করুন ও মানসিক সমর্থন দিন। ১৩. উৎসাহ ও মনোবল বাড়ান। ১৪. রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ করুন।

পরিশেষে বলতে চাই, সেরিব্রাল পালসি প্রাণঘাতী নয়, তবে এটি আজীবন শারীরিক অক্ষমতা সৃষ্টি করে। সঠিক চিকিৎসা, যত্ন ও সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তাই বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস শুধু একটি স্মরণীয় দিন নয়, বরং সচেতনতা, সহমর্মিতা এবং পরিবর্তনের প্রতীক।

সঠিক তথ্য, সহায়তা এবং সমর্থনের মাধ্যমে সমাজের সব শিশুই উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। আমাদের সকলের দায়িত্ব হলো শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ, সমর্থনমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৫ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test