E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ভূবৈচিত্র্য: জীববৈচিত্র্যের নীরব ভিত্তি ও টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি

২০২৫ অক্টোবর ০৭ ১৭:৪৯:৪১
ভূবৈচিত্র্য: জীববৈচিত্র্যের নীরব ভিত্তি ও টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি

ওয়াজেদুর রহমান কনক


আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস (International Geodiversity Day) হচ্ছে পৃথিবীর অজীব ভূবস্তু—যেমন পাথর, খনিজ, জীবাশ্ম, মাটি, নদী, উপত্যকা ও ভৌগোলিক প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য—সম্মান ও রক্ষা করার একটি বার্ষিক দিন। ইউনেস্কো ২০২১ সালে এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছিল এবং এখন থেকে প্রতি বছর ৬ অক্টোবর এই দিবসটি পালিত হয়; উদ্দেশ্য হল সাধারণ মানুষ, শিক্ষাবিদ, নীতি নির্ধারক ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে ভূবৈচিত্র্য সম্পর্কে জানানো এবং এটি কেন আমাদের জীবন, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝানো।

সরল ভাষায় বললে, ভূবৈচিত্র্য হচ্ছে পৃথিবীর সেই সব “জিনিস” যা জেগে উঠেনি — কিন্তু সেগুলোই জীবজগতকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। মাটি ও খনিজ নেই কোনো খাদ্য চাষ সম্ভব হত না; নদী ও ভূপ্রকৃতি না থাকলে মানুষের বসতি, পথচলা, এবং অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই জন্মাত না। ভূবৈচিত্র্য একরকম ভূ-বেস হিসেবে কাজ করে; এর উপর বাস করে বন, কীটপতঙ্গ, প্রাণী ও মানুষের জীবন। বেশ কয়েকটি প্রধান সংস্থা ও গবেষণায় বলা হয়েছে যে ভূবৈচিত্র্য ও জৈববৈচিত্র্য একে অপরকে পরিপূরক করে এবং ভূবৈচিত্র্য থাকা মানেই অনেক-রকম পরিবেশগত সেবা (ecosystem services) বজায় থাকে—যা খাদ্য, পানি, বাসস্থান, পর্যটন, শিক্ষা এবং ঝুঁকি কমানোর মতো সুবিধা সরবরাহ করে।

প্রকৃত উদাহরণ ও সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বিষয়টাকে বুঝানো সহজ হবে। ২০২৪ সালে মার্কিন ভূতত্ত্ব সংস্থা (USGS) তাদের ‘Geoheritage Sites of the Nation’ তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে প্রতিটি রাজ্য ও অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে প্রাথমিকভাবে ৫৫টিGeoheritage সাইটকে তুলে ধরা হয়েছে—এগুলো দেখায় যে কিভাবে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে এবং সেগুলোর মধ্যে শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব রয়েছে।

আন্তর্জাতিকভাবে UNESCO Global Geoparks-এর সংখ্যা গত কয়েক বছরে দ্রুত বেড়েছে; ২০২৪ সালের এক বিজ্ঞপ্তিতে ইউনেস্কো জানিয়েছিল যে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২১৩টি গ্লোবাল জিওপার্ক আছে, এবং এই জিওপার্কগুলো ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতি ও টেকসই উন্নয়নকে সংযুক্ত করে—অর্থাৎ ভূবৈচিত্র্যকে শুধু বিজ্ঞান নয় বরং লোকজ জীবন ও আয়ের একটি উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। জিওপার্কগুলো পর্যটন, শিক্ষা ও স্থানীয় কর্মসংস্থানও বাড়ায়।

গবেষণা ও প্র্যাকটিক্যাল কাজগুলো দেখায় যে ভূবৈচিত্র্য রক্ষা করলে সেখানকার পরিবেশগত সেবা উন্নত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন অধ্যয়ন পেয়েছে যে উচ্চ ভৌগোলিক ও মাটির বৈচিত্র্য থাকা অঞ্চলে একাধিক ধরনের বাস্তুতন্ত্র ও পরিষেবা (যেমন পানি ধরে রাখা, মাটির উর্বরতা, প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা থেকে আড়াল) বেশি পাওয়া যায়; তাই ভূবৈচিত্র্য সংরক্ষণই প্রকৃতপক্ষে জীবনভিত্তিক নীতি ও টেকসই ব্যবহারকে সমর্থন করে। তবে এই সম্পর্কটি ভৌগোলিকভাবে ভিন্ন এবং সব জায়গায় একই মাত্রায় প্রকাশ পায় না—তাই স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা জরুরি।

দিবসটি পালনের সহজ উপায়গুলো হলো: স্কুলে বা স্থানীয় কমিউনিটিতে মাঠভ্রমণ আয়োজন করা, স্থানীয় জিওসাইট-গুলো সম্পর্কে ছোট গল্প বা প্রদর্শনী করা, মাটির, পাথরের ও জীবাশ্মের ছোট সংগ্রহ এবং সেগুলোর গুরুত্ব বোঝানো, এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এমন সাইটগুলোর যত্ন নিতে অনুরোধ করা। আন্তর্জাতিকভাবেও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আছে যাতে ভূবৈচিত্র্য সংরক্ষণকে নীতিগত স্থান দেওয়া হয়—কারণ এটা শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, আমাদের খাদ্য, পানি ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও বুনিয়াদ।

সংক্ষেপে: আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীর “অজীব অংশ” — পাথর, মাটি, নদী, ভূ-প্রক্রিয়া—তেমনই জীবনের জন্য অপরিহার্য; ৬ অক্টোাবরকে আমরা এই অজীব স্থাপত্যের কদর করি, তথ্য ছড়াই, আর স্থানীয় ও বিশ্বস্তরে সংরক্ষণের উদ্যোগ দেখি। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে তোমার এলাকাভিত্তিক একটি ছোট ভূমি/জিও-রিপোর্ট তৈরি করে দিতে পারি — যেখানে স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, সম্ভাব্য জিওসাইট এবং তাদের নিরাপত্তার উপায়গুলো সহজ ভাষায় লেখা থাকবে।

আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস (International Geodiversity Day) হচ্ছে এমন একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ যা পৃথিবীর অজীব উপাদান—যেমন পাহাড়, নদী, উপত্যকা, মরুভূমি, পাথর, খনিজ, মাটি, জীবাশ্ম, আগ্নেয়গিরি এবং ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলোর বৈচিত্র্য—সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। এই দিবসটি প্রতি বছর *৬ অক্টোবর* পালিত হয়। দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর অজীব সম্পদ ও ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা জাগানো, তা সংরক্ষণের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, এবং বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণে ভূবৈচিত্র্যের গুরুত্ব তুলে ধরা।

এই দিবসের ধারণাটি প্রথম উঠে আসে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশবিদদের একটি আলোচনায়। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দেখে আসছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও অযাচিত খনিজ আহরণের কারণে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভূ-প্রক্রিয়া ও উপাদান দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু মানুষ প্রায়ই শুধু জীববৈচিত্র্যের (Biodiversity) কথা বলছে, ভূবৈচিত্র্যের (Geodiversity) গুরুত্ব প্রায় অজানাই থেকে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা থেকেই ইউনেস্কো (UNESCO) ২০২১ সালে ৬ অক্টোবরকে আনুষ্ঠানিকভাবে *“আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস”* হিসেবে ঘোষণা করে, যা ২০২২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।

ভূবৈচিত্র্য বলতে বোঝায় পৃথিবীর ভূত্বক ও প্রাকৃতিক গঠনের বৈচিত্র্য। পৃথিবীর প্রতিটি স্থানে পাথর, খনিজ, জীবাশ্ম, পর্বত, নদী, হ্রদ ও ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া একেক রকম। এই ভিন্নতাই ভূবৈচিত্র্য গড়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের টেকটোনিক অবস্থান একদিকে পাহাড়ি গঠন তৈরি করেছে, অন্যদিকে ব-দ্বীপীয় ভূমি ও নদীবিধৌত মাটি তৈরি করেছে। এই ভূবৈচিত্র্যের ফলেই এখানে নানা রকম বাস্তুতন্ত্র, বন, কৃষি অঞ্চল ও মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। ভূবৈচিত্র্য না থাকলে কোনো জায়গায় মাটি উর্বর হত না, নদী প্রবাহ গড়ে উঠত না, এবং মানুষের জীবনযাত্রা এত বৈচিত্র্যময় হত না।

বিশ্বের নানা গবেষণায় দেখা গেছে, ভূবৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্য একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যেসব এলাকায় ভূপ্রকৃতি ও মাটির বৈচিত্র্য বেশি, সেসব এলাকায় জীববৈচিত্র্যও সাধারণত বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, হিমালয়ের বিভিন্ন উচ্চতার পার্থক্য ও শিলার গঠন সেখানে নানা প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য উপযুক্ত আবাস তৈরি করেছে। একইভাবে মরুভূমি বা আগ্নেয় অঞ্চলের ভূবৈচিত্র্য সেখানে নির্দিষ্ট প্রজাতির টিকে থাকার পরিবেশ তৈরি করে। সুতরাং ভূবৈচিত্র্য রক্ষা মানে শুধু পাথর বা মাটি সংরক্ষণ নয়, বরং জীবনের ভিত্তি সংরক্ষণ।

২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, ইউনেস্কোর আওতায় পৃথিবীতে প্রায় *২১৩টি গ্লোবাল জিওপার্ক* রয়েছে, যেগুলো ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এসব জিওপার্কে শিক্ষা, গবেষণা, পর্যটন এবং স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন একসাথে ঘটছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধুমাত্র ইউরোপেই ৯০টিরও বেশি জিওপার্ক রয়েছে, আর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৮০টি। এই পার্কগুলো বছরে কোটি কোটি পর্যটক আকর্ষণ করে এবং হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, যা দেখায় ভূবৈচিত্র্য কেবল বিজ্ঞান নয়, অর্থনীতিরও একটি চালিকাশক্তি।

দিবসটি পালনের মাধ্যমে প্রতিটি দেশকে আহ্বান জানানো হয়—তাদের জাতীয় ভূতাত্ত্বিক সম্পদ যেমন পাহাড়, নদী, খনিজ অঞ্চল, সমুদ্রতল এবং জীবাশ্ম অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে। একই সঙ্গে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ভূবৈচিত্র্য বিষয়ক ক্লাস, প্রদর্শনী, ফিল্ড ট্রিপ ও গবেষণা আয়োজন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অনেকে স্থানীয় পর্যায়ে মাটির, পাথরের বা নদীর উৎস সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, কেউ কেউ আবার স্থানীয় ঐতিহাসিক ভূগঠন যেমন পাহাড় বা গুহাকে “জিওহেরিটেজ” হিসেবে ঘোষণা করে।

আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবসের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে মানবজাতিকে বোঝানো—পৃথিবীর অজীব উপাদানগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা না রাখলে জীবজগৎও টিকবে না। আমরা যদি নদী শুকিয়ে ফেলি, পাহাড় কেটে ফেলি বা মাটি দূষণ করি, তাহলে শুধু ভূতাত্ত্বিক গঠনই নষ্ট হয় না, বরং সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় প্রাণ, জল, এবং খাদ্যের উৎস। এই কারণে জাতিসংঘের “জিওডাইভারসিটি ডে” মানুষকে আহ্বান জানায়—পৃথিবীর মাটির প্রতি কৃতজ্ঞ হও, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে সম্মান কর, এবং অজীব সম্পদের সাথে সহাবস্থানের পথ শিখে নাও।

সবশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর জীবনের গল্প আসলে পাথরের, নদীর ও মাটির গল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই অজীব উপাদানগুলোই জীবনের ভিত্তি, সভ্যতার বুনিয়াদ। তাই ভূবৈচিত্র্যের যত্ন নেওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার পথ তৈরি করা। ৬ অক্টোবরের এই দিনটি পৃথিবীর নীরব অথচ সবচেয়ে প্রভাবশালী নায়কদের প্রতি এক সম্মান প্রদর্শনের দিন—যারা কথা বলে না, কিন্তু জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে।

আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস এখন বিশ্বের নানা দেশে এক অনন্য শিক্ষা ও সচেতনতা উৎসব হিসেবে পালিত হয়। ৬ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান সংস্থা, জিওপার্ক, স্কুল এবং স্থানীয় কমিউনিটি নানা উদ্যোগ নেয়। প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী দিবসটি উদযাপন করে থাকে। নিচে সহজ ভাষায় তুলে ধরা হলো, পৃথিবীর নানা প্রান্তে কিভাবে এই দিবসটি পালিত হয়—

বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ এই দিনে *জিওপার্ক ও জিওহেরিটেজ সাইটগুলোতে প্রদর্শনী, ফিল্ড ভিজিট ও আলোচনা সভা* আয়োজন করে। যেমন ইউরোপের গ্লোবাল জিওপার্ক নেটওয়ার্কের আওতায় ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, গ্রিস ও পর্তুগালে ভূতত্ত্ববিদ ও শিক্ষার্থীরা স্থানীয় পাহাড়, গুহা ও খনিজ সম্পদের ওপর ফিল্ড স্টাডি পরিচালনা করে। এসব আয়োজনে মানুষকে দেখানো হয় কিভাবে বিভিন্ন ভূপ্রকৃতি গঠিত হয়েছে এবং তা কেমন করে স্থানীয় কৃষি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।

*ইউরোপীয় দেশগুলোতে* এই দিবসে বিশেষভাবে “জিওডাইভারসিটি ফর লাইফ” (Geodiversity for Life) শিরোনামে সেমিনার ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিক্ষাবিদ, গবেষক ও পরিবেশকর্মীরা একত্রিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, খনিজ আহরণের টেকসই পদ্ধতি, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক নীতি নিয়ে আলোচনা করেন। উদাহরণ হিসেবে, যুক্তরাজ্যের "British Geological Survey" প্রতিবছর এই দিবসে স্কুল পর্যায়ে পাথর ও মাটির প্রদর্শনী আয়োজন করে, যাতে শিশুদের মধ্যে পৃথিবী সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়।

*এশিয়ার দেশগুলোতেও* এই দিবসটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ইউনেস্কো-স্বীকৃত জিওপার্কগুলোতে জনসচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করে। চীনে এই দিবসে “জিওসায়েন্স এক্সপো” অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মডেল, পোস্টার ও ভিডিও প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ভূবৈচিত্র্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে। ইন্দোনেশিয়া তাদের আগ্নেয়গিরি ও দ্বীপভিত্তিক ভূবৈচিত্র্য তুলে ধরে জনসাধারণকে জানায়, এই বৈচিত্র্যই দেশটির পর্যটন ও অর্থনীতির ভিত্তি।

*আফ্রিকার দেশগুলোতে* ভূবৈচিত্র্য দিবস পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার শেখানোর সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও কেনিয়ায় স্থানীয় কমিউনিটিগুলো এই দিনটিকে "Earth Heritage Festival" নামে উদযাপন করে। তাঁরা পাহাড়, মরুভূমি ও খনিজভূমিকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, স্থানীয় নৃত্য ও লোকসংগীত আয়োজন করে; যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনভিত্তি এই মাটি ও শিলার সঙ্গে কতটা জড়িত।

*লাতিন আমেরিকার দেশগুলো* যেমন ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা—তাদের অ্যান্ডিজ পর্বতমালা ও জীবাশ্মভূমি সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এই অঞ্চলে ভূবৈচিত্র্য দিবসকে স্থানীয় শিক্ষার অংশ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীরা পাথর সংগ্রহ করে তার ইতিহাস লেখে, কেউ কেউ স্থানীয় নদী বা পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা করে। এতে তরুণ প্রজন্ম শিখছে, প্রকৃতির নিচে লুকিয়ে থাকা ভূতাত্ত্বিক গল্পগুলো কিভাবে তাদের ইতিহাস ও জীবনকে গড়ে তুলেছে।

*উত্তর আমেরিকায়*, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়, ভূবৈচিত্র্য দিবসকে জিও-হেরিটেজ উইকের সঙ্গে মিলিয়ে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস ও USGS (United States Geological Survey) এই দিনটি উপলক্ষে বিনামূল্যে ফিল্ড ট্যুর, ওয়েবিনার ও শিক্ষামূলক ভিডিও প্রকাশ করে। মানুষকে দেখানো হয়, কীভাবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, ইয়েলোস্টোন বা রকি পর্বতমালার মতো জায়গাগুলোর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস কোটি বছরের পরিবর্তনের সাক্ষী।

*বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে* এখনো এই দিবসটি নতুন ধারণা হিসেবে প্রচলিত হচ্ছে, তবে ভূবিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এর গুরুত্ব তুলে ধরতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ মাঝে মাঝে পোস্টার প্রদর্শনী, সচেতনতা লেকচার ও মাঠ গবেষণার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশে সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চল, কক্সবাজারের সমুদ্রতট কিংবা তেতুলিয়া–তরাই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি নিয়ে স্থানীয়ভাবে কাজ হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী এই দিবসের মূল সুর একটাই—“পৃথিবীর নীরব কণ্ঠকে শোনো।” ভূবৈচিত্র্যের সংরক্ষণ কেবল বিজ্ঞানীদের কাজ নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। তাই দেশভেদে পদ্ধতি আলাদা হলেও উদ্দেশ্য এক: মানুষকে বুঝানো, প্রকৃতির পাথর, নদী, মাটি ও গঠনই আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটি পৃথিবীর প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও ভূগোলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক মহামুহূর্ত হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে *আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস*ের গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক। কারণ বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, মাটি, নদী, পাহাড়, উপকূল ও ব-দ্বীপীয় গঠন — সবই পৃথিবীর ভূবৈচিত্র্যের অনন্য নিদর্শন। এই ছোট্ট ভূখণ্ডটি পৃথিবীর অন্যতম নবীন ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল, যেখানে ভূপ্রক্রিয়া এখনো ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। ফলে বাংলাদেশের জীবন, অর্থনীতি, কৃষি, জলবায়ু এবং মানুষের বসবাসের ধরন—সবকিছুই ভূবৈচিত্র্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই বাস্তবতা থেকেই বলা যায়, ভূবৈচিত্র্যের গুরুত্ব বোঝা ও সংরক্ষণ করা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

বাংলাদেশ একটি *ব-দ্বীপ রাষ্ট্র*, যা গঠিত হয়েছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পলিমাটি জমে। প্রতি বছর এই নদীগুলো হিমালয় থেকে বিপুল পরিমাণ পলি বয়ে এনে দেশের দক্ষিণাংশে জমা করে। এর ফলে নতুন ভূমি সৃষ্টি হয়, আবার নদীভাঙনে কিছু অংশ বিলীনও হয়। এই ভূপ্রক্রিয়া একদিকে বাংলাদেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করছে, অন্যদিকে নদীভাঙন, ভূমিক্ষয় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়াচ্ছে। ভূবৈচিত্র্য দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে কেবল দুর্যোগ নয়, বরং একটি “চলমান ভূতত্ত্বীয় বাস্তবতা” হিসেবে বুঝতে হবে। এর সঠিক বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও ব্যবস্থাপনা নীতি নির্ধারণে সাহায্য করে।

বাংলাদেশের মাটির বৈচিত্র্যও এই দিবসের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। দেশের প্রায় ৫৫ ধরণের মাটির শ্রেণি রয়েছে, যার মধ্যে পাহাড়ি, বালুময়, পলিমাটি, লবণাক্ত ও জৈবসমৃদ্ধ মাটির উপস্থিতি এক বিশাল কৃষিভিত্তিক সম্পদ তৈরি করেছে। ভূবৈচিত্র্যের কারণে উত্তরাঞ্চলে খাদ্যশস্য, মধ্যাঞ্চলে পাট ও সবজি, আর উপকূলে লবণ, চিংড়ি ও নারকেল উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত চাষাবাদ, রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাটির গঠন নষ্ট হচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে উর্বর স্তর। ভূবৈচিত্র্য দিবস এই ক্ষতির প্রতি মানুষকে সচেতন করে—কারণ মাটি শুধু কৃষির উপাদান নয়, এটি জীবনের ভিত্তি।

বাংলাদেশে পাহাড়ি অঞ্চল যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট বা মধুপুর গড়—ভূবৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ নিদর্শন। এই পাহাড় ও উঁচু ভূমিগুলো জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল এবং অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কিন্তু অবৈধ পাহাড় কাটা, খনিজ আহরণ ও বন উজাড়ের কারণে এই অঞ্চলগুলোর ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। ভূবৈচিত্র্য দিবসের আলোচনায় এ বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক—কারণ এই ধরনের কর্মকাণ্ড ভূতাত্ত্বিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং ভূমিধস, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হয়।

বাংলাদেশের *উপকূলীয় অঞ্চল* ভূবৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এখানে নদীর পলি, জোয়ার-ভাটা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততা মিলিয়ে এক জটিল ভূপ্রক্রিয়া কাজ করছে। এর ফলেই সুন্দরবনের মতো অনন্য বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা ও ভূমিক্ষয়ের কারণে এই ভূবৈচিত্র্য এখন বিপন্ন। ভূবৈচিত্র্য দিবস আমাদের আহ্বান জানায়—উপকূলীয় ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতির নিজস্ব প্রক্রিয়াকে সম্মান করতে। যদি আমরা বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণের সময় এই ভূতাত্ত্বিক গতিশীলতাকে উপেক্ষা করি, তাহলে বিপরীতে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধসের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূবৈচিত্র্য হলো *নদীনির্ভর জীবনব্যবস্থা*। দেশে প্রায় ৭০০ নদী আছে, যেগুলোর প্রবাহ দেশের ভূতাত্ত্বিক কাঠামো নির্ধারণ করে। নদীর চর, বাঁক, গতি ও পলিবাহিত বৈশিষ্ট্য ভূবৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু অযৌক্তিক বাঁধ, নদী খনন বা দূষণ এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। ভূবৈচিত্র্য দিবসের আলোচনায় এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক—কারণ নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ সংরক্ষণই ভূপ্রকৃতির স্থিতিশীলতা রক্ষার অন্যতম চাবিকাঠি।

ভূবৈচিত্র্য শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি বাংলাদেশের *সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ*। প্রাচীন সভ্যতা যেমন মহাস্থানগড়, ময়নামতি বা পুন্ড্রনগর—সবই ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থাপত্য। নদী, পাহাড়, মাটি, খনিজ—সবই আমাদের শিল্প, স্থাপত্য ও লোকগাথার উপাদান। ভূবৈচিত্র্য রক্ষা মানে সেই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ।

বাংলাদেশে ভূবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষণা এখনো সীমিত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় এটি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। হিমালয় থেকে পলি আসার গতি, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ভূমিধস বা ভূমিকম্পের ঝুঁকি—সবই ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ভূবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। টেকসই অবকাঠামো গড়তে হলে ভূপ্রকৃতির স্বভাব বুঝে কাজ করতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের টিকে থাকা মানেই তার ভূবৈচিত্র্যের টিকে থাকা**। এই দেশের প্রতিটি মাটি, পাথর, নদী ও পাহাড়ই জীবনধারার অংশ। আন্তর্জাতিক ভূবৈচিত্র্য দিবস আমাদের শেখায়—উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে, কারণ ভূবৈচিত্র্য ধ্বংস মানে ভবিষ্যতের জীবনধারা ধ্বংস। সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই দিবস শুধু বৈজ্ঞানিক উদযাপন নয়, বরং অস্তিত্ব রক্ষার এক সতর্ক বার্তা।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

০৭ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test