E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

স্পাইন রোগের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি 

২০২৫ অক্টোবর ১৫ ১৭:৫১:০২
স্পাইন রোগের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব স্পাইন দিবস। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো — “Invest in Your Spine” (আপনার মেরুদণ্ডে বিনিয়োগ করুন)। এ প্রতিপাদ্যের মূল উদ্দেশ্য হলো মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি, সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, সক্রিয় জীবনযাপন ও কর্মস্থলে সঠিক অঙ্গবিন্যাস নিশ্চিত করা।

বর্তমান যুগে অনেকেই দীর্ঘ সময় ধরে বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করেন, যা মেরুদণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে হাড়, লিগামেন্ট ও পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, স্পাইনের প্রাকৃতিক বাঁক বা কার্ভ নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ডিস্ক প্রল্যাপস (হারনিয়েটেড ডিস্ক), কোমর ও ঘাড়ের ব্যথা, এবং স্নায়ু চাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই প্রতি ৪৫ মিনিট পর ৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে হালকা নড়াচড়া বা স্ট্রেচিং করা মেরুদণ্ডের সুস্থতা রক্ষায় অত্যন্ত জরুরি। আর এই আন্তর্জাতিক দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সাধারণ জনগণের মধ্যে মেরুদণ্ডের যত্ন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এছাড়াও এটি মেরুদণ্ড এবং মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তুলে ধরে। বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ—শিশু, যুবক বা প্রবীণ—মেরুদণ্ডের ব্যথা, মেরুদণ্ড সম্পর্কিত প্রতিবন্ধকতা এবং পিঠের ব্যথায় ভুগছেন।

স্পাইনাল স্টেনোসিস কী?

স্পাইনাল স্টেনোসিস হলো মেরুদণ্ডের খাল বা স্পাইনাল ক্যানাল সংকুচিত হয়ে যাওয়া, যার ফলে মেরুদণ্ড ও স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হয়। মানবদেহে ৩৩টি কশেরুকা (vertebrae) একটির পর একটি সজ্জিত থাকে। প্রতিটি কশেরুকার মাঝখানে থাকে ডিস্ক, যা শক শোষক হিসেবে কাজ করে।
যখন এই ডিস্ক, হাড় বা লিগামেন্ট মোটা হয়ে যায়, তখন মেরুদণ্ডের ভেতরের স্থান সংকুচিত হয়—এটাই স্পাইনাল স্টেনোসিস।

স্পাইনাল স্টেনোসিসের প্রকারভেদ

সংকোচনের অবস্থান ও প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে স্টেনোসিসের ধরন চারটি—

১. সার্ভিকাল স্টেনোসিস: ঘাড়ের অংশে মেরুদণ্ডের খাল সংকীর্ণ হয়।

২. কটিদেশীয় (Lumbar) স্টেনোসিস: কোমরের নিচে সংকীর্ণতা দেখা দেয়।

৩. সেন্ট্রাল ক্যানাল স্টেনোসিস: মেরুদণ্ডের কেন্দ্রীয় অংশ সরু হয়ে যায়।

৪. ফোরামিনাল স্টেনোসিস: স্নায়ু বের হওয়ার পথ সংকুচিত হয় (ল্যাটারাল স্টেনোসিস নামেও পরিচিত)।কখনও কখনও একাধিক ধরন একসঙ্গে উপস্থিত থাকতে পারে।

স্পাইনাল স্টেনোসিসের লক্ষণ

কটিদেশীয় (Lumbar) স্টেনোসিসে—

* নীচের পিঠে স্থায়ী বা মাঝেমধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। * নিতম্ব, পা বা পায়ের পাতায় ঝিনঝিনি ভাব বা অসাড়তা দেখা যায়। * দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটার সময় ব্যথা ও দুর্বলতা বাড়ে, কিন্তু বসলে উপশম হয়। * পা ভারী লাগে, হাঁটতে বা সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধা হয়। * গুরুতর ক্ষেত্রে মূত্রাশয় বা অন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সার্ভিকাল (Cervical) স্টেনোসিসে—

* ঘাড়ে ব্যথা বা শক্তভাব অনুভূত হয়। * বাহু, হাত, পা বা পায়ের অসাড়তা ও দুর্বলতা দেখা যায়। * ভারসাম্য হারানো ও হাঁটতে কষ্ট হয়। * সূক্ষ্ম কাজ যেমন বোতাম লাগানো বা লেখা কঠিন হয়ে পড়ে। * গুরুতর ক্ষেত্রে মূত্রাশয় বা অন্ত্রের অসংযম হতে পারে।

স্পাইনাল স্টেনোসিসের ঝুঁকির কারণসমূহ

* বয়স ৫০ বছরের বেশি: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের হাড় ও ডিস্কে প্রাকৃতিক ক্ষয় শুরু হয়, যা স্নায়ু পথ সংকুচিত করে।

* অস্টিওআর্থারাইটিস বা হাড়ের ক্ষয়: এই রোগে হাড়ের প্রান্তে ক্যালসিয়াম জমে গিয়ে স্পাইনাল ক্যানাল সংকুচিত হতে পারে।

* স্কোলিওসিস (মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়া): মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক বাঁক স্নায়ুর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে স্টেনোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

* পূর্বের আঘাত বা চোট: মেরুদণ্ডে দুর্ঘটনা, আঘাত বা অস্ত্রোপচারের পর হাড় ও লিগামেন্টে পরিবর্তন হয়ে স্নায়ুপথ সংকুচিত হতে পারে।

* বংশগত কারণ: কিছু মানুষের জন্মগতভাবে স্পাইনাল ক্যানাল সংকীর্ণ থাকে, যা পরবর্তীতে সমস্যা তৈরি করে।

* স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে, যা স্টেনোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

* দীর্ঘসময় বসে থাকা বা শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: স্নায়ু ও পেশিতে চাপ সৃষ্টি করে মেরুদণ্ড দুর্বল করে তোলে।

* অতিরিক্ত ভার উত্তোলন: ভুল ভঙ্গিতে ভার তোলার ফলে মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

শিশুর স্পাইন সমস্যা

শিশুর স্পাইন বা মেরুদণ্ড স্বাভাবিকভাবে সোজা নয়; এটি কোমর ও পেছনের অংশে কিছুটা বাঁকানো থাকে। তবে কখনো কখনো শিশুর স্পাইন বিকৃতির কারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ সমস্যাগুলো হলো স্কোলিওসিস (পিঠ বাঁকা হওয়া), কিফোসিস (পিঠের উপরের অংশে অতিরিক্ত বাঁক), লর্ডোসিস (কোমরে অতিরিক্ত বাঁক), এবং জন্মগত মেরুদণ্ড ত্রুটি।

লক্ষণ:- * পিঠ বা কোমরে অসম বোঁচকা বা অস্বাভাবিক বাঁক। * পিঠের একপাশ বেশি উঁচু দেখা দেওয়া। * হাঁটা বা দাঁড়ানোতে অসুবিধা। * ব্যথা বা শারীরিক অস্বস্তি, বিশেষ করে দীর্ঘ সময় বসা বা খেলা করার সময়। * কখনো কখনো পায়ের দুর্বলতা বা চলাফেরায় সমস্যা।

কারণ: * জন্মগত ত্রুটি বা মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক গঠন। * অস্বাস্থ্যকর ভঙ্গি বা দীর্ঘ সময় খারাপ অবস্থায় বসা। * পেশী দুর্বলতা বা সংযোগকারী টিস্যুর সমস্যা। * অতিরিক্ত ওজন বা পেছনের পেশীর অসম ভারবহন।এই জন্য নিয়মিত ডাক্তারের পরিদর্শন ও নিয়মিত স্পাইন চেকআপ জরুরি।

প্রতিরোধ: শিশুকে সঠিক ভঙ্গি শেখানো, ভারসাম্যপূর্ণ খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম ও ব্যাগ হালকা রাখা মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্রাথমিক পর্যায়ে যত্ন নিলে দীর্ঘমেয়াদে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

জটিলতা

১. স্থায়ী স্নায়ু ক্ষতি: দীর্ঘসময় স্নায়ুতে চাপ পড়লে সংবেদনশক্তি ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা স্থায়ীভাবে নষ্ট হতে পারে।

২. পা বা হাতের পক্ষাঘাত: স্নায়ু ক্ষতির ফলে হাত-পা দুর্বল হয়ে যেতে পারে বা পুরোপুরি নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

৩. কাউডা ইকুইনা সিনড্রোম : মেরুদণ্ডের নিচের অংশের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে মূত্রাশয় ও অন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি দেখা দেয়।

৪. দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা: কোমর, ঘাড় বা পিঠে স্থায়ী ব্যথা থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।

৫. চলাফেরায় অক্ষমতা: ধীরে ধীরে হাঁটা, দাঁড়ানো বা বসার সক্ষমতা হারিয়ে যায়।

৬. মানসিক সমস্যা: ক্রমাগত ব্যথা ও অক্ষমতার কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। তাই সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

রোগনির্ণয়

* রক্ত পরীক্ষা: CBC, CRP * ইমেজিং: এক্স–রে, এমআরআই বা সিটি স্ক্যান * বায়োপসি (প্রয়োজনে): টিউমার বা ইনফেকশন নির্ণয়ে

প্রতিরোধের উপায়

* সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন: সোজা হয়ে বসুন, কাঁধ পেছনে রাখুন, পিঠ বাঁকা করবেন না।

* নিয়মিত ব্যায়াম করুন: হাঁটা, যোগব্যায়াম, স্ট্রেচিং ও কোর এক্সারসাইজ মেরুদণ্ডের পেশি শক্তিশালী করে।

* ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন: অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

* ভারী বস্তু তুলতে সতর্ক থাকুন: হাঁটু বাঁকিয়ে পায়ের শক্তি ব্যবহার করুন, পিঠ বাঁকাবেন না।

* দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকবেন না: প্রতি ৪৫ মিনিট পর ৫ মিনিট হাঁটুন বা স্ট্রেচ করুন।

* সঠিক আসন ও অফিস ব্যবস্থা ব্যবহার করুন: এরগোনোমিক চেয়ার ও উপযুক্ত ডেস্ক উচ্চতা বজায় রাখুন।

* ধূমপান ও স্ট্রেস থেকে দূরে থাকুন: এগুলো হাড়ের রক্তপ্রবাহ কমিয়ে ক্ষয় বৃদ্ধি করে।

* প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: অসাড়তা বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা অবহেলা করবেন না।

হোমিও সমাধান

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসার মাধ্যমে একজন অভিজ্ঞ হোমিওচিকিৎসক রোগীর শারীরিক, মানসিক ও সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত ওষুধ নির্বাচন করেন। মেরুদণ্ডের সমস্যায় সাধারণত যে ওষুধগুলো প্রাথমিকবাবে যেইসব ঔষধ নির্বাচন করে থাকেন:-আর্নিকা মন্ট, কস্টিকাম, ক্যালমিয়া, ন্যাজা, জিম্কাম মেট, আয়োডাম, প্যারিস, এসিড ফ্লুয়োরিক, লাইসিন, স্ট্রামোনিয়াম, ল্যাকেসিস, কোবাল্টাম, সাইলিসিয়া, রাস টক্স ইত্যাদি।তবে ওষুধ নিজে নিজে না ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে গ্রহণ করা উচিত।

পরিশেষে, মেরুদণ্ডের ব্যথার কারণ নির্ণয়ের সময় রোগীর ইতিহাস, বয়স, কাজের ধরন, অতীত রোগ ও শারীরিক গঠন বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকরা প্রয়োজনে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্ণয় করেন।

মেরুদণ্ডের ব্যথা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো— সচেতন জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম ও সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “Invest in Your Spine” আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সুস্থ মেরুদণ্ড মানেই সক্রিয় জীবন, উৎপাদনশীল কর্মক্ষমতা ও মানসিক প্রশান্তি।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

১৫ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test