E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নিরাপদ চলাচলের সচেতনতা ও জীবন রক্ষার আহ্বান

২০২৫ অক্টোবর ২১ ১৯:২৬:৩৯
নিরাপদ চলাচলের সচেতনতা ও জীবন রক্ষার আহ্বান

ডা. মাহতাব হোসাইন মাজেদ


২২ অক্টোবর ২০২৫, বুধবার, দেশে নবমবারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য। সড়ক দুর্ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তির জীবনের নয়, পুরো পরিবার, সমাজ এবং দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিন আমাদের জীবনের এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ ও সামাজিক মাধ্যমে আমরা প্রায় প্রতিদিনই এমন খবর পাই, যেখানে মানুষের জীবন অযত্ন, বেপরোয়া বা অদক্ষ চালনার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। প্রযুক্তি ও যানবাহনের দ্রুতগতির উন্নয়নের যুগে আমরা হয়তো রাস্তা পারাপারে বা গাড়ি চালনায় সময় বাঁচাচ্ছি, কিন্তু সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি।

সড়ক দুর্ঘটনার বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৭,০০০ এবং আহতের সংখ্যা ১৫,০০০ এরও বেশি। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটের মতো বড় শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।বিশেষত যুবক ও কর্মক্ষম বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর অর্থ, শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির জীবন নষ্ট হচ্ছে না, তার পরিবার ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিপন্ন হচ্ছে। সন্তান, পরিবার ও সমাজের ভবিষ্যতও প্রভাবিত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে পরিবারে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। আহত ব্যক্তি যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হন, তবে চিকিৎসার খরচ, দিনমজুরের ক্ষতি এবং মানসিক চাপ পরিবারকে ভেঙে দিতে পারে। এছাড়া দুর্ঘটনার পর দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা শিশুর পড়াশোনা ও পরিবারের আয়কে প্রভাবিত করতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ

১. অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক: অনেক চালক গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন না। লাইসেন্স থাকলেও তাদের দক্ষতার অভাব থাকে।

২. ফিটনেসবিহীন যানবাহন: ব্রেক, লাইট, স্টিয়ারিং বা টায়ারের সমস্যা থাকলেও তা যাচাই করা হয় না।

৩. অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া চালনা: ট্রাফিক আইন অমান্য, লেন পরিবর্তন বা সিগনাল অমান্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. পথচারীদের অসচেতনতা: মোবাইল, হেডফোন ব্যবহার ও সিগনাল অমান্য রাস্তায় ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

৫. অপরিকল্পিত ও ভঙ্গুর সড়ক: গর্ত, ভাঙা সাইনবোর্ড, অপ্রতুল লাইট দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

৬. আবহাওয়ার প্রতিকূলতা: বৃষ্টি, কুয়াশা বা ঝড়ের সময় রাস্তায় বিপদ বাড়ে।

৭. জটলা ও অতিরিক্ত যানবাহন: শহরের ব্যস্ত সড়কে হঠাৎ ব্রেক বা লেন পরিবর্তন দুর্ঘটনার কারণ।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার, ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ হলো:

* ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন: আইন অমান্যকারীদের জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিল।

* চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদান: বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিতে দক্ষতা যাচাই।

* ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান: নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ গাড়ি পরীক্ষা।

* পথচারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ, কমিউনিটি ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা।

* সড়ক সংস্কার ও উন্নয়ন: পরিকল্পিত ও টেকসই সড়ক নির্মাণ, লাইট, সাইনবোর্ড ও সাইডওয়াক ঠিক রাখা।

* ড্রাইভিং কালচার উন্নয়ন: শান্তভাবে, ধৈর্যশীলভাবে গাড়ি চালানো।

* সচেতনতা অভিযানের সম্প্রসারণ: স্থানীয় কমিউনিটি, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদে নিয়মিত শিবির।

উদ্ভাবনী ও সামাজিক উদ্যোগ

সড়ক নিরাপত্তা শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়; এটি সম্প্রদায়িক এবং সামাজিক উদ্যোগের ফল। স্থানীয় কমিউনিটি, স্কুল, কলেজ, এবং যুব সংগঠনগুলো সচেতনতা অভিযান, ট্রাফিক কর্মশালা ও নিরাপদ পথচিহ্ন স্থাপনের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

স্বেচ্ছাসেবী পর্যবেক্ষক ও রাস্তায় সেবা প্রদান করে সাধারণ মানুষও সড়ক নিরাপত্তার অংশ হতে পারে। তারা যেমন পথচারীদের সতর্ক করতে পারে, তেমনি অদক্ষ চালক ও বেপরোয়া যানবাহন চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে।

পরিবার ও অভিভাবকের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শিশুরা যখন ছোট থেকেই নিরাপদ রাস্তা পারাপার, হেলমেট ব্যবহার এবং ট্রাফিক সিগনাল মানার অভ্যাস শিখবে, তখন বড় হওয়ার পরও তারা দায়িত্বশীল চালক বা পথচারী হবে। পরিবারে নিয়মিত আলোচনা ও অনুশীলন দীর্ঘমেয়াদে দুর্ঘটনা কমাতে সহায়ক।

গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধুমাত্র সংবাদ প্রচার নয়, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, ভিডিও, সামাজিক চ্যালেঞ্জ এবং কমিউনিটি কন্টেন্টের মাধ্যমে যুব সমাজকে সচেতন ও দায়িত্বশীল করা সম্ভব।

নাগরিক শিক্ষা ও অংশগ্রহণের উদ্ভাবনী প্রকল্প

* স্থানীয় পর্যায়ে সড়ক নিরাপত্তা মেলা আয়োজন করা যেতে পারে।

* স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের সৃজনশীল প্রচেষ্টা দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে।

* স্থানীয় সরকার ও এনজিও একত্রিত হয়ে স্বাস্থ্য সেবা, জরুরি প্রতিক্রিয়া এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কার্যক্রম প্রদর্শন করতে পারে।

* এটি শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করবে না, বরং জনগণকে সরাসরি কার্যকর পদক্ষেপে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে।

সরকারের উদ্যোগ

* সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন: নতুন আইন চালু।

* ট্রাফিক পুলিশ আধুনিকীকরণ: প্রশিক্ষণ, রাডার, সিসিটিভি, ডিজিটাল মনিটরিং।

* সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প: গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ে ও শহরের প্রধান সড়ক সংস্কার।

* সচেতনতা সপ্তাহ ও দিবস: জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ও সচেতনতা সপ্তাহ পালন।

* অর্থনৈতিক ক্ষতির নিরীক্ষা: হাসপাতাল খরচ, শ্রমক্ষেত্র ক্ষতি ও সামাজিক সুরক্ষা।

আমাদের ব্যক্তিগত দায়িত্ব

* চালক: নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো, হেলমেট পরা, সিগনাল মানা।

* পথচারী: রাস্তা পারাপারে সতর্ক থাকা, মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার না করা।

* অভিভাবক: সন্তানদের সড়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দেওয়া।

* গণমাধ্যম: জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে অবিরাম কাজ করা।

* জনগণ: রাস্তায় দায়িত্বশীল আচরণ করা।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ

* জাপান: ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে কার্যকর।

* সিঙ্গাপুর: সড়ক ক্যামেরা, ফাইন ও সচেতনতা প্রচার।

* সুইডেন: “Vision Zero” প্রকল্প, শূন্য মৃত্যুর লক্ষ্য।

* ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস: সাইকেল লেন, পেডেস্ট্রিয়ান জোন, যানজট নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশও এই উদাহরণ অনুসরণ করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে শিক্ষা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, আইন ও স্থানীয় অংশগ্রহণ একসাথে প্রয়োজন। স্থানীয় পর্যায়ে স্কুল ও কলেজে স্মার্ট ট্রাফিক ক্লাব, সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা প্রচারণা, এবং জাতীয় পর্যায়ে আইন কার্যকর করা জরুরি।

সড়ক নিরাপত্তার জন্য সরাসরি নাগরিক অংশগ্রহণ যেমন স্বেচ্ছাসেবী ট্রাফিক গার্ড, কমিউনিটি সড়ক পর্যবেক্ষক এবং স্থানীয় কমিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বলতে চাই, নিরাপদ সড়ক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য। সরকার, গণমাধ্যম, চালক, পথচারী, পরিবার ও সমাজ—সবার দায়িত্ব রয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, এটি জাতীয় স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্যও বড় ঝুঁকি। নিরাপদ সড়কের মান উন্নয়নে সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও শিক্ষামূলক প্রচারণা জরুরি। চালকের দায়িত্বশীলতা, গতি নিয়ন্ত্রণ, সিগন্যাল ও লাইট মেনে চলা এবং পথচারীর সচেতনতা জীবনের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। পরিবার ও সমাজকেও দুর্ঘটনার পরিণতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।

সড়ক নিরাপদ হলে জীবন নিরাপদ হয়। তাই এই দিবস আমাদের মনে করায়—দায়িত্ব ভাগাভাগি নয়, সম্মিলিত প্রতিজ্ঞা প্রয়োজন। আজকের দিনে সবাইকে সচেতন হতে, সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে আহ্বান জানাই। ছোট ছোট পদক্ষেপ—সীটবেল্ট ব্যবহার, হেলমেট পরা, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা—সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বড় অবদান রাখতে পারে। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে আমরা একটি নিরাপদ সড়ক ও সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২১ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test