E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি 

২০২৫ অক্টোবর ২৮ ১৭:৩০:৩৮
স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। ২০০৬ সালে বিশ্ব স্ট্রোক সংস্থা প্রথম এই দিবসটি পালন শুরু করে। এর মূল লক্ষ্য—মানুষকে স্ট্রোক সম্পর্কে সচেতন করা, ঝুঁকি ও প্রতিরোধের উপায় জানানো এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব বোঝানো। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “Every Minute Counts” আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মাত্র কয়েক মিনিটের সচেতন পদক্ষেপ জীবন রক্ষা করতে পারে।

স্ট্রোক কী?

স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বাধা বা রক্তনালী ফেটে যাওয়া। এতে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছানো বন্ধ হলে সেই অংশের কোষ ধীরে ধীরে মারা যায়।

প্রধান দুই প্রকার: ১. অবরোধজনিত স্ট্রোক: রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া। ২. রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক: রক্তনালী ফেটে যাওয়া।

মূল ঝুঁকি কারণ: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও কম শারীরিক কার্যকলাপ।

স্ট্রোকের ঝুঁকি কারণ

স্ট্রোক যে কারও হতে পারে, তবে কিছু ঝুঁকি ফ্যাক্টর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ: * উচ্চ রক্তচাপ * ডায়াবেটিস * হার্ট রোগ, বিশেষ করে এ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন * অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, অতিরিক্ত লবণ, চর্বি ও চিনি * ধূমপান ও অ্যালকোহল * কম শারীরিক কার্যকলাপ * মানসিক চাপ এবং ঘুমের ঘাটতি * স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন।

বিশ্ব ও বাংলাদেশের অবস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৫ কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৫০ লাখ মারা যান এবং আরও ৫০ লাখ স্থায়ীভাবে অক্ষম হন। প্রতি ২৬ সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং প্রতি চার মিনিটে একজন মারা যান। স্ট্রোক বর্তমানে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এবং দীর্ঘস্থায়ী অক্ষমতার প্রধান কারণ।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ মানুষ নতুনভাবে আক্রান্ত হন এবং প্রায় আশি হাজার মারা যান। পুরুষদের ঝুঁকি নারীদের তুলনায় বেশি। গ্রামীণ এলাকায় আক্রান্তের হার শহরের তুলনায় বেশি।

কোভিড–১৯-এর পর তরুণদের মধ্যে ঝুঁকি বেড়েছে। দীর্ঘ সময় বসে থাকা, মানসিক চাপ, ঘুমের ঘাটতি, স্থূলতা ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস প্রধান কারণ।

স্ট্রোকের লক্ষণ

স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ সহজে মনে রাখার সূত্র—“মুখ, হাত, বাক্‌, সময়”: * মুখ: মুখের এক পাশে অবশ বা বেঁকে যাওয়া * হাত/পা: এক পাশে দুর্বল হওয়া * বাক্‌: কথা জড়িয়ে যাওয়া বা অস্পষ্ট উচ্চারণ।

* সময়: এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া * অন্যান্য সতর্ক সংকেত: চোখে ঝাপসা, হঠাৎ মাথা ঘোরা, ভারসাম্য হারানো।

স্ট্রোকের জটিলতা

স্ট্রোক থেকে সুস্থ হলেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে: * পক্ষাঘাত বা অঙ্গের কার্যক্ষমতা হারানো
* বাক্‌ সমস্যা বা কথা বোঝার অসুবিধা * স্মৃতি ও মনোযোগের সমস্যা * খাবার গিলতে না পারা, শ্বাসনালিতে খাদ্য প্রবেশের ঝুঁকি * দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া * মানসিক সমস্যা, যেমন হতাশা বা একাকিত্ব * দৈনন্দিন কাজের সীমাবদ্ধতা, যেমন হাঁটা, পোশাক পরা, খাওয়া–দাওয়া।

রোগ নির্ণয়

স্ট্রোকের প্রাথমিক নির্ণয় হয় রোগীর ইতিহাস ও লক্ষণ দেখে। সঠিক নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন: * CT Scan: রক্তক্ষরণ বা অবরোধ চিহ্নিত * MRI: ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক দেখায় * রক্ত পরীক্ষা: রক্তে চর্বি, শর্করা বা জমাট বাঁধার সমস্যা * ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাম: হৃদরোগ শনাক্ত * ক্যারোটিড ডপলার টেস্ট: মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে বাধা আছে কিনা

প্রতিরোধের উপায়

স্ট্রোকের চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর।

করনীয়:

১. রক্তচাপ ও রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখা ২ . ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা ৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, চর্বি ও লবণ কমানো ৪. প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম ৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা ৬. ফল, শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া ৭. পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা ৮. বছরে অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা ৯. মানসিক চাপ কমানো এবং বিশ্রাম নেওয়া ১০. মাদক, অতিরিক্ত ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা।

প্রযুক্তি ও পরিবার সহায়তা : * স্বাস্থ্য অ্যাপ ও রিমাইন্ডার ব্যবহার। * পরিবারের সদস্যদের স্ট্রোক লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন করা। * দ্রুত হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিশ্চিত করা।

ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস।অ্যাপোপ্লেক্সি” উল্লেখ করেন। ১৭ শতকে জোহান ওয়েপফার জানান—মস্তিষ্কে রক্তনালী ফেটে পক্ষাঘাত হতে পারে। পরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি স্ট্রোক নামে পরিচিত হয়।

বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে স্ট্রোক চিকিৎসা এখনও শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ এলাকায় বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও দ্রুত রোগী পরিবহনের সুযোগ কম। মানুষ প্রাথমিক লক্ষণ চেনে না, ফলে হাসপাতালে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়।

সমাধান: * উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে স্ট্রোক কেন্দ্র স্থাপন * প্রতিটি হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা ইউনিট
* অ্যাম্বুলেন্স ও রেফারেল ব্যবস্থা শক্তিশালী করা * গণমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি * স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম * কমিউনিটি ওয়ার্কশপে সাধারণ মানুষকে স্ট্রোক প্রতিরোধ শিক্ষা।

স্ট্রোক পরবর্তী হোমিও সমাধান

স্ট্রোকের পর স্নায়ু ও পেশির দুর্বলতা, স্মৃতি ও মানসিক চাপের জন্য হোমিওপ্যাথি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক গন প্রাথমিকভাবে যেই সব ঔষধ লক্ষণের উপর নির্বাচন করে থাকে,আর্নিকা মোন্টানা – স্ট্রোকের পর পেশি দুর্বলতা, শরীরের ব্যথা এবং স্নায়ুর ক্লান্তি হ্রাসে ব্যবহার হয়। এটি পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। ব্যারিটা মিউরিয়াটিকাম – বয়সজনিত দুর্বলতা, স্মৃতি দুর্বলতা ও ধীর পুনরুদ্ধারে সহায়ক। স্ট্রোকের পরে ধীরগতির পেশি পুনর্বাসনে কার্যকর।
জেলসেমিয়াম – হঠাৎ দুর্বলতা, মাথা ভারি, কম্পন এবং স্নায়ুর ক্লান্তি কমাতে সহায়ক। মানসিক চাপ ও দুর্বলতা হ্রাসে কার্যকর। গ্লোনিনাম – মাথা ভারি, রক্তচাপ ওঠা এবং মাথা ঘোরা কমাতে ব্যবহৃত হয়। স্ট্রোক পরবর্তী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

নাক্স ভূমিকা – ঘুমের সমস্যা, মানসিক চাপ ও হজম সমস্যায় সহায়ক। অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও অতিরিক্ত চাপের কারণে পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করে। ক্যালসিয়া ফসফোরিকা – পেশি দুর্বলতা, ধীরগতির মুভমেন্ট ও হাড়ের দুর্বলতা হ্রাসে ব্যবহার হয়। স্ট্রোক পরবর্তী শক্তি ও পুনর্বাসনে কার্যকর। নাট্রাম মিউরিয়াটিকাম – মানসিক চাপ, বিষণ্নতা এবং আবেগজনিত অস্থিরতা হ্রাসে সহায়ক। স্নায়ু পুনর্বাসন ও মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে। কালি ফসফরিকাম – স্নায়ু শক্তি বাড়াতে, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়। মানসিক ক্লান্তি ও স্নায়ুর দুর্বলতা কমাতে কার্যকর।

ফসফরাস – শক্তি বৃদ্ধি, মাংসপেশি দুর্বলতা হ্রাস এবং স্নায়ু পুনর্বাসনে সহায়ক। ঘাম ঝরানো ও দুর্বলতা কমাতে কার্যকর। সাইলেসিয়া – ধীরগতির পুনরুদ্ধার, পেশি শক্তি বৃদ্ধি এবং ক্ষীণত্ব হ্রাসে সহায়ক। শরীর ও পেশি পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর। ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে বিশেষজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বিঃদ্রঃ: হোমিওপ্যাথি ঔষধগুলো প্রাথমিক চিকিৎসার বিকল্প নয়। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রথমে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। হোমিওপ্যাথি ঔষধগুলো পুনর্বাসন এবং সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত সুষম জীবনধারা, মানসিক প্রশান্তি এবং পরিবারের সহায়তা সাথে থাকলে পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হয়

পরিশেষে বলতে চাই, স্ট্রোক একটি নীরব ঘাতক, যা মুহূর্তের মধ্যে জীবনকে বিপন্ন করতে পারে। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, পরিবারের সমর্থন এবং সময়মতো পদক্ষেপ রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।

আমরা যদি রক্তচাপ, শর্করা, ওজন, খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখি, নিজের ও পরিবারের জীবন রক্ষা করতে পারি। শিশুদের স্বাস্থ্য শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনধারার পরিবর্তন—সবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্ট্রোক দিবস মনে করিয়ে দেয়—প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক লক্ষণ চেনা এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া মানে জীবন বাঁচানো।

চলুন আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি—স্ট্রোক প্রতিরোধে আমি সচেতন, আমার পরিবার সচেতন, সমাজকেও সচেতন করতে সাহায্য করব।”

সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, পরিবার ও কমিউনিটির সমর্থন এবং সময়মতো পদক্ষেপ—এই চারটি উপাদান মিললে আমরা সফলভাবে এই প্রাণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব।

লেখক : কলাম লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২৮ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test