E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ইসকনের বিরুদ্ধে মুফতি মহিবুল্লাহ’র নাটক ভেস্তে গেছে 

২০২৫ অক্টোবর ২৯ ১৭:২৯:৪৪
ইসকনের বিরুদ্ধে মুফতি মহিবুল্লাহ’র নাটক ভেস্তে গেছে 

শিতাংশু গুহ


ইসকনের বিরুদ্ধে মুফতি মহিবুল্লাহ’র নাটকের যবনিকা ঘটেছে। মুফতি ও তার দুই পুত্র ধরা খেয়েছে। পুলিশ তাদের আটক করেছে কিনা জানিনা, তবে এদের বিচার হওয়া দরকার। মুফতি ও বিক্রমপুরির এ নাটক শুধু ইসকন নয়, হিন্দু সমাজ, ভারত ও মোদির বিরুদ্ধে ছিলো। এটি একাঙ্কিকা নয়, এর পেছনে আরো কুশীলব আছে। এ নাটকে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে চরম উস্কানি দেয়া হয়েছে। এটি ছিলো দাঙ্গা লাগানোর মেটিক্যুলাস প্ল্যান। এ যাত্রায় বাঁচা গেছে, তবে এমন নাটক আরো হবে, তাই সাবধান থাকতে হবে। 

পূর্বাহ্নে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এক বিবৃতিতে বলেছে, টঙ্গী টিএনটি কলোনি মসজিদের ইমাম মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ মিয়াজী অপহরণের তদন্তকালে এখন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সন্দেহাতীতভাবে দায়ী করার মত পর্যাপ্ত কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। এ নাটকে পুলিশের ভূমিকা ভাল, চ্যানেল ২৪ জানিয়েছে, পুলিশ বলেছে, মুফতি মহিবুল্লাহ অপহরণ ঘটনা মিথ্যা, তিনি নিজেই গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। একটি মহল বলছে, পরকীয়ায় ধরা পরে হুজুর একাধিক স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে নিজেই আত্মগোপনে চলে যায় এবং পরে ‘অপহরণ’ নাটক সাজায়।

নাটকের শুরুতে মুফতি চিৎ হয়ে শুয়ে মিডিয়াকে বলেছেন, তাকে ইসকনের পক্ষে কথা বলার জন্যে বলা হয়েছে। আবার অখন্ড ভারতের পক্ষে, বিএনপি-এনসিপি’র বিপক্ষে কথা বলার কথা বলা হয়েছে। মুসলিম যুবতী-হিন্দু যুবকের প্রেমের পক্ষে কথা বলতে বলা হয়েছে। তিনি আবার বলেছেন, যারা গুম করেছে তারা হিন্দু-মুসলমান কেউই না’। জনকণ্ঠ ২৪ অক্টবর ২০২৫ উদ্ধার হওয়া ইমামের বক্তব্য ছেপেছে, যাতে তিনি বলেন: যারা আমাকে গুম করেছে তাদের বাংলাদেশী মনে হয়নি, কোন ধর্মের অনুসারী মনে হয়নি’।

মুফতি অপহণের সংবাদে পুরো দেশে অনেক জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। ‘ইনতিফাদা বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভ করে ‘ইসকন’ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। তারা ইসকন অবৈধ কর্মকান্ডে অর্থ যোগান দিচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে (খবর, বাংলাদেশ অবজারভার, শুক্রবার ১০ই অক্টবর ২০২৫)। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ করেছে। ঐসব বিক্ষোভে শ্লোগান ছিলো, ‘ভারতের দালালেরা হুশিয়ার-সাবধান; ইসকন অফিস বন্ধ করো ইত্যাদি।

ঢাকায় এক সমাবেশে প্রকাশ্যে রাইফেল উঁচিয়ে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। ইসলামী বক্তা মুহাম্মদ জসীমউদ্দীন রহমানী বলেছেন, ইসকন ধর্মীয় সংগঠন নয়, এটি ইহুদী প্রভাবিত গোষ্ঠী। শায়খ কাজী ইউসুফ জাহান সরকারকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইস্কন নিষিদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। জনৈক মোল্লা ইসকন চেনার সহজ উপায় খুঁজতে গিয়ে বলেছেন যে, ‘হাতে লাল অথবা গেরুয়া রঙ্গের সুতা বাঁধা দেখলেই বুঝবেন সে ইসকন। এই মোল্লার জানা দরকার, গেরুয়া সুতা মাঝে মধ্যে সকল হিন্দুই পরে। নাফিস রায়ান নামে একজন লিখেছে, ‘আপনার নিকটবর্তী ইসকন মেম্বার বন্ধুটি’র শিরচ্ছেদ করে দিন, নিজে নিরাপদ থাকুন, দেশকে নিরাপদ রাখুন’।

হিন্দু নিউজ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “ইসকনকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে তোলার তৎপরতা চালাচ্ছে একটি পক্ষ”। কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদ নিন্দা জানিয়েছে। গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক বলেছেন, ইস্কনের বিরুদ্ধে কোনপ্রকার ষড়যন্ত্র চলবে না। ইউটিউবার সুলতানা রহমান এক শো’তে বলেছেন, জঙ্গীরা সক্রিয়। ইস্কন একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ইস্কন একটি আন্তর্জাতিক, অরাজনৈতিক, অহিংস, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্থা। ইস্কন দেশের আইন, সংবিধান ও প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিছু কিছু ব্যক্তি ইস্কন ভক্তদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে, বিভ্রান্ত ছড়িয়ে ইস্কন নিষিদ্ধের দাবি ছড়াচ্ছে, যা স্পষ্টত: কোন পরিকল্পিত নীলনকশার অংশ। ইস্কন সংবাদ সম্মেলন করে ইস্কনের নামে অপপ্রচার, গুজব ও ষড়যন্ত্রের নিন্দা জানিয়েছে।

ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশ্বে প্রায় ১৫০টি দেশে এর শাখা আছে। আমেরিকা, রাশিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তানে এঁরা ‘হরে কৃষ্ণ’ গেয়ে বেড়ায়। গুজব ছড়িয়ে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে একটি গোষ্ঠী ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করছে। এর লক্ষ্য বাংলাদেশে দাঙ্গা সৃষ্টি করে হিন্দুদের বিতাড়ন। ইস্কন মাছ-মাংস খায়না, নিরামিষ ভোজী। নেশা করেনা, প্রাণী হত্যা করেনা, মানুষ হত্যার কোন রেকর্ড নেই। এঁরা রাজনীতি করেনা, প্রতিহিংসা পরায়ণ নয়। ইস্কন মুসুল্লিদের ইফতার খাওয়ায়, বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে। নিউইয়র্কের ইমাম কাজী কাইয়ুম লিখেছেন, ইসকনকে ধর্মীয় উগ্রবাদী একটি সংগঠন বলে যারা এর বিলুপ্তি চাচ্ছেন, জামায়াতকে তারা কি বলবেন?

ইসকনের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র নুতন নয়, আগেও এমন নাটক হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইস্কনের বিরুদ্ধে মৌলবাদী শক্তি লেগেছে কেন? কারণ ইসকনের মাধ্যমে হিন্দুরা একত্রিত হচ্ছে, হিন্দুদের মন্দিরগুলো দখল করা যাচ্ছেনা। ভয়ও আছে, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ না আবার ‘ঘর ওয়াপছি’ করে দেয়? বাংলাদেশে যারা ইসকন বিরোধী তারা হিন্দু বিরোধী, ইসলামী মৌলবাদী, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। বহু হিন্দু ইসকনকে ‘অপছন্দ’ করে, তবে ইসলামী মৌলবাদীদের মত ষড়যন্ত্র করেনা। কলকাতা ২৪x৭ একটি ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে যাতে এক নেতা অনেক লোকের স্যামনে মাইকে চিৎকার করে বলছে, মোদিকে কাটো হিন্দুদের মারো, ইসকনের লোকদের হত্যা করো। https://share.google/SCxxz2mV0IJnZY9q0 বাংলাদেশের মোল্লারা এখন লাগামছাড়া কথাবার্তা বলছে, এতে ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই?

ইসকন জঙ্গী সংগঠন নয়

বাংলাদেশে অনেকে ইস্কনকে জঙ্গী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করতে চাচ্ছে। ইসকন জঙ্গী সংগঠন নয়। এঁরা প্রাণী হত্যা করেনা, নিরামিষ খায়। ইসকন প্রথম ভারতের বাইরে সনাতন ধর্মের প্রচার শুরু করে। কলকাতার প্রভুপাদ আমেরিকায় ইস্কন প্রতিষ্ঠা করেন। ইস্কন হচ্ছে কৃষ্ণ সম্পর্কে সচেতনতা, এদের শ্লোগান ‘হরে কৃষ্ণ’। এটি কোন দেশের নিষিদ্ধ নয়, ১৫৮টি দেশে এটি কৃষ্ণ নাম জপ করে যাচ্ছে। ইস্কন একটি গেরুয়া পতাকা বহন করে, গেরুয়া হিন্দুদের পবিত্র রং। ইসকন দেশে দেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়ায় না, ধর্মের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেনা, এঁরা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করেনা। সুতরাং ইস্কন জঙ্গী সংগঠন নয়।

যাঁরা বলছেন, ইসকন ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন তাঁরা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বলছেন। এরা জীব হত্যা করেনা, তাই এদের পক্ষে সন্ত্রাসী হওয়াটা কঠিন। বিশ্বের রাস্তায় রাস্তায় এঁরা ‘হরেকৃষ্ণ’ গেয়ে বেড়াচ্ছেন, “হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে” -এই নাম-গানে ইস্কন নুতন মাত্রা যোগ করেছে। নিজেদের সন্ত্রাসী চেহারাটা ঢাকতেই কেউ কেউ ইস্কনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে থাকে। আইসিস, আল-কায়দা, বোকাহারাম, বা এমনকি ৯/১১’র সন্ত্রাসীদের সাথে ইস্কনের কোন মিল নেই, ইস্কন কাউকে জোর করেনা, অন্য ধর্মের নিন্দা করেনা।

ইসকন শুধু হরেকৃষ্ণ গেয়ে যাচ্ছে। এতেই অনেকের ভয়, কারণ ‘সত্যকে’ ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশে অনেক হিন্দু মন্দির ইসকন দখল নিচ্ছে, এতে ভূমিদস্যুরা বিরক্ত, কারণ একজন গরিব হিন্দুর সম্পত্তি জবরদখল যতটা সহজ, ইসকনের হাত থেকে দখল নেয়া ততটা কঠিন। কারণ ইসকন সংঘবদ্ধ, তাঁদের ভক্ত আছে, টাকাপয়সা আছে, তাঁরা মামলা লড়তে পারেন। অর্থাৎ ভূমিদস্যুরা সহজে হিন্দু সম্পত্তি দখলের পৈতৃক অধিকার হারাচ্ছে! দোষ ইসকনের? রাগও তাই ইসকনের ওপর। ইস্কন শান্তির কথা বলে, কাজ করে শান্তির পক্ষে। যারা অশান্তিতে বিশ্বাসী তারা ইস্কনকে সহ্য করার কথা নয়, করেও না?

ইসকন কিছু মানুষকে কৃষ্ণের পথে ফিরিয়ে আনছে, এটিও ভয়, কি-জানি বাবা কি হয়? ইউরোপ-আমেরিকায় ইসকনের পতাকাতলে সাদা-কালোরা চলে আসছেন, এটাও ভয়? পাকিস্তানে বা ইরাকে বা মস্কোয় ইস্কন রাস্তায় ‘হরেকৃষ্ণ’ গেয়ে বেড়াচ্ছে, এতে তাঁরা ভয় পাচ্ছেন, ভয় থেকেই এই প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ঘটনা। দাবি আছে, ইস্কন নিষিদ্ধ করতে হবে? এঁরা আহমদিয়াদের ‘অমুসলমান’ ঘোষণা করার দাবিও করে? তাহলে বুঝুন এরা কারা? ইসকন কারো ধর্মগ্রন্থ পোড়ায় না, যাঁরা ইস্কন বন্ধের দাবি করেন, তাদের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে ‘কোরান শরীফ’ পোড়ানোর অভিযোগ আছে।

ইসকনের মহিলারা রাস্তায় রাস্তায় ‘হরেকৃষ্ণ’ গাইছে, যাঁরা ইসকন নিষিদ্ধ চাইছেন, তাঁরা মহিলাদের ঘরের ভেতরে আটকে রাখতে চান! ইস্কন গরিব মুসলমানদের একমাস ইফতার করান, ইসকনের ইফতার হারাম এ কথা তো শুনিনা! মূলত ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইসকনের বিরোধিতা করছেন, এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধিতা করেছেন, একুশ, পহেলা বৈশাখ-র বিরোধিতা করছেন। এঁরা যখন ইসকনের বিরোধী, তাহলে ইস্কন নিশ্চয় ভালো কাজ করছে, সঠিক পথে আছে। ঘটনা যাই হোক, ইসকন নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা এদের আছে কি?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২৯ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test