E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি  

২০২৫ নভেম্বর ০২ ১৭:৪৯:৩৪
ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি  

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতিবছর নভেম্বর মাসকে বিশ্বব্যাপী “ফুসফুস ক্যান্সার সচেতনতা মাস” হিসেবে পালন করা হয়। লক্ষ্য হলো সাধারণ মানুষকে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি, প্রাথমিক শনাক্তকরণের গুরুত্ব এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন করা। বাংলাদেশেও বিভিন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসক সংস্থা ও গণমাধ্যম এই মাসে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। ফুসফুস ক্যান্সারের হার দেশে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরুষদের মধ্যে এটি অন্যতম প্রধান ক্যান্সার, তবে সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের মধ্যেও এর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ধূমপান, বায়ুদূষণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং অনিয়মিত জীবনধারা ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

ফুসফুস ক্যান্সার কী?

ফুসফুস ক্যান্সার হলো ফুসফুসের কোষের অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধি, যা ধীরে ধীরে টিউমারে পরিণত হয়। এটি শুধু ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমন লিভার, হাড়, মস্তিষ্ক ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি।

ফুসফুস আমাদের শরীরের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কোষের নিয়ন্ত্রণহীন বিভাজন ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত করে এবং দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুস ক্যান্সার প্রায়ই লক্ষণ প্রকাশ করে না, তাই সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অপরিহার্য।

ফুসফুস ক্যান্সারের ধরন

ফুসফুস ক্যান্সার প্রধানত দুই ধরনের:

১. নন-স্মল সেল লাং ক্যান্সার

প্রায় ৮৫% ক্ষেত্রে দেখা যায়।

প্রধান উপধরন:

অ্যাডিনোকারসিনোমা: ধূমপায়ী ও অধূমপায়ী উভয়েই দেখা যায়।

স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা: দীর্ঘমেয়াদি ধূমপায়ীদের মধ্যে বেশি।

লার্জ সেল কারসিনোমা: দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত ছড়ায়।

২. স্মল সেল লাং ক্যান্সার (SCLC)

প্রায় ১৫% ক্ষেত্রে দেখা যায়।

অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ধূমপায়ীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও দ্রুত ছড়ায়।

ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ

ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ হলো তামাকজাত দ্রব্য, তবে আরও কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রয়েছে:

১. ধূমপান: মোট ক্যান্সারের ৮০–৯০% ক্ষেত্রে দায়ী। ধূমপানের মাত্রা ও সময়কাল বেশি হলে ঝুঁকি আরও বাড়ে।

২. পরোক্ষ ধূমপান (Second-hand smoke): যারা অন্যের ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকে, তাদের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ক্ষতিকর।

৩. বায়ুদূষণ ও পেশাগত ঝুঁকি: রাসায়নিক গ্যাস, অ্যাসবেস্টস, ধাতব ধূলিকণা এবং কিছু কারখানার ধোঁয়া দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে। শহরে বাতাসে PM2.5, কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যান্য দূষণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারে পূর্বে ফুসফুস ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেশি। কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য কোষ নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধি ঘটাতে সহায়ক।

৫. রেডন গ্যাস ও বিকিরণ: ভূগর্ভস্থ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি রেডন গ্যাসের সংস্পর্শ ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত বিকিরণ সংস্পর্শও ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

৬. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ফলমূল ও সবজি কম খাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া। পর্যাপ্ত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন গ্রহণ না করা।

৭. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: নিয়মিত ব্যায়াম না করা, স্থূলতা ও অসুস্থ জীবনধারা দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়।

ফুসফুস ক্যান্সারের জটিলতা

ফুসফুস ক্যান্সার শুধুমাত্র ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এটি সমগ্র দেহে জটিলতা সৃষ্টি করে:

* শ্বাসকষ্ট ও অক্সিজেনের ঘাটতি: টিউমার বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত করে।

* রক্তক্ষরণ: কফে রক্ত বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। * ফুসফুসে সংক্রমণ: বারবার ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া হতে পারে।

* প্লিউরাল ইফিউশন: ফুসফুসের চারপাশে তরল জমে শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায়। * মেটাস্টাসিস: লিভার, হাড়, মস্তিষ্ক বা অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়লে মারাত্মক জটিলতা। * ব্যথা ও দুর্বলতা: স্নায়ু বা হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে চলাচলে ব্যাঘাত। * ওজন হ্রাস ও ক্ষুধামান্দ্য: ক্যান্সার কোষের বিপাকীয় প্রভাবের কারণে ধীরে ধীরে শক্তি কমে যায়।

প্রাথমিক লক্ষণ

প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুস ক্যান্সার সচরাচর লক্ষণ প্রকাশ করে না। তবে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিলে অবহেলা করা উচিত নয়:

* দীর্ঘদিন ধরে শুকনো বা কফযুক্ত কাশি * কফে রক্ত বা বাদামী দাগ

* বুকে ব্যথা বা শ্বাস নিতে কষ্ট

* শ্বাসকষ্ট ও ক্লান্তি * খাবারে অরুচি ও ওজন হ্রাস * কণ্ঠ ভাঙা বা গিলে অসুবিধা * ঘন ঘন ফুসফুস সংক্রমণ

> উপসর্গ দেখা মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ চিকিৎসার সাফল্য বাড়ায়।

> রোগ নির্ণয়

সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার সাফল্য অনেক বৃদ্ধি পায়। ব্যবহৃত পরীক্ষা সমূহ:

১. চেস্ট এক্স-রে: প্রাথমিক স্ক্রিনিং।

২. CT স্ক্যান: টিউমারের আকার, অবস্থান ও বিস্তার বোঝার জন্য।

৩. বায়োপসি: কোষ সংগ্রহ ও মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা।

৪. ব্রঙ্কোস্কপি: ফুসফুসে ক্যামেরাযুক্ত টিউব দিয়ে নমুনা। ৫. PET স্ক্যান: ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়েছে কিনা বোঝার জন্য। বয়স ৫০-এর বেশি বা দীর্ঘমেয়াদি ধূমপায়ীদের জন্য বছরে একবার লো-ডোজ CT স্ক্যান করানো উচিত।

চিকিৎসা পদ্ধতি

১. এলোপ্যাথি (সমকালীন চিকিৎসা):_* অস্ত্রোপচার: প্রাথমিক পর্যায়ে টিউমার বা আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলা। * কেমোথেরাপি: ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস। * রেডিয়েশন থেরাপি: উচ্চক্ষমতার বিকিরণ ব্যবহার।
* টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি: নির্দিষ্ট জিন বা প্রোটিন লক্ষ্য করে ওষুধ।
* পার্সোনালাইজড ট্রিটমেন্ট: রোগীর জিনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা।

২. হোমিওপ্যাথি: হোমিওপ্যাথি ফুসফুস ক্যান্সারের অগ্রগতি ধীর করতে, ব্যথা উপশমে এবং কেমো বা রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে সহায়ক। ব্যবহৃত ওষুধ: কারসিনোসিন, কোনিয়াম, ফসফরাস, লাইকোপোডিয়াম, সাইলেসিয়া, ক্যালি কার্বোনিকাম। হোমিওপ্যাথি ওষুধ রোগীর শারীরিক, মানসিক ও উপসর্গের ধরন অনুযায়ী ব্যবহার করতে হয়।

প্রতিরোধ

ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে জীবনধারায় পরিবর্তন অপরিহার্য:

১. ধূমপান সম্পূর্ণ বন্ধ করুন। ২. পরোক্ষ ধূমপান এড়ান। ৩. বায়ুদূষণ কমান। ৪. পুষ্টিকর খাদ্য খান।
৫. নিয়মিত ব্যায়াম করুন। ৬. পেশাগত নিরাপত্তা বজায় রাখুন। ৭ . নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।

জনসচেতনতা

অনেকেই কাশি বা শ্বাসকষ্টকে সাধারণ সর্দি ভাবেন। নভেম্বর মাসে গণমাধ্যম, স্কুল, কলেজ ও অফিসে ধূমপানবিরোধী প্রচারণা জরুরি। চিকিৎসক, সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন।

ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য রোগ। ধূমপান ত্যাগ, পরিবেশ দূষণ রোধ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত স্ক্রিনিং—এই চারটি বিষয় মানলেই মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

পরিশেষে বলতে চাই,ফুসফুস ক্যান্সার আজ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটি শুধু বয়স্ক বা ধূমপায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক প্রভাবও এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তবে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

নভেম্বর মাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—সুস্থ ফুসফুস মানেই সুস্থ জীবন। সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং ধূমপানমুক্ত জীবন প্রতিটি ব্যক্তির এবং সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই আসুন সবাই প্রতিজ্ঞা করি—নিজের, পরিবারের এবং সমাজের জন্য সুস্থ ফুসফুস ও দীর্ঘায়ু জীবন নিশ্চিত করতে সচেতন হই।

লেখক : চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০২ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test