E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

আমাদের বন্দী অর্থনীতি: বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অদৃশ্য স্থাপত্যের ভিতর

২০২৫ নভেম্বর ১৬ ১৭:৫৯:১৪
আমাদের বন্দী অর্থনীতি: বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অদৃশ্য স্থাপত্যের ভিতর

মো: ইমদাদুল হক সোহাগ


বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আজ একটি আধুনিক ডিজিটাল অবকাঠামোর চিত্র তুলে ধরে—গ্লাস টাওয়ার, বায়োমেট্রিক প্রবেশপথ, মোবাইল ড্যাশবোর্ড এবং স্বচ্ছতার ধারাবাহিক বার্তা। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেশাজীবীদের সঙ্গে কথোপকথন ইঙ্গিত দেয় যে এই ঝকঝকে ব্যবস্থার নীচে আরেকটি স্তর রয়েছে—কম দৃশ্যমান, কম জবাবদিহিমূলক এবং খুব কম আলোচিত। এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে অভিযুক্ত করা নয়; এটি বহু পেশাজীবীর বর্ণিত পুনরাবৃত্ত প্যাটার্নের বিশ্লেষণ—যা আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতির ওপর মৌলিক প্রশ্ন তোলে।

যখন একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সতর্ক সংকেত পাঠায়

আমার অভিজ্ঞতা শুরু হয় আকস্মিকভাবে। এক সকালে দেখি আমার চলতি হিসাবে হঠাৎ ১ কোটি ৪১ লাখ ঋণাত্মক ব্যালেন্স দেখাচ্ছে—কোনো বার্তা বা ব্যাখ্যা ছাড়াই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এন্ট্রি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়। পরে একটি পুরনো অভিযোগ দাখিল করার পর আমার অ্যাকাউন্ট যেন “সাইলেন্ট জোন”-এ ঢুকে যায়—ফোন ধরেনা, ইমেইল ফিরে আসে না, প্রক্রিয়া ধীরে যায়। এমন মুহূর্তে একজন সাধারণ গ্রাহক অনুভব করেন যেন তিনি কোনো অদৃশ্য স্তরে আটকে গেছেন।

ইনসাইডাররা যা ইঙ্গিত করেন

আইটি কর্মী, মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় বহু মিল পাওয়া যায়। তারা একটি অনানুষ্ঠানিক অভ্যন্তরীণ স্তরের কথা বলেন—যাকে অনেকেই সাব বেসমেন্ট স্তর (এসবিএল) নামে উল্লেখ করেন, যেখানে সংবেদনশীল কার্যক্রম নাকি নিয়মিত প্রশাসনিক রুটিনের বাইরে সম্পন্ন হয়। কন্ট্রোল রুম জিরো ও স্যাডো অপারেশন ইউনিট (এসওইউ) সম্পর্কেও সিমিলার বর্ণনা পাওয়া যায়। এসব তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়, তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানুষের কাছ থেকে একই ধরনের বিবরণ পাওয়া উদ্বেগজনক।

রাত ২টার ডিজিটাল জানালা

অনেক প্রযুক্তিবিদ ব্যাংকিং সিস্টেমের এন্ড অব ডে (ইওডি) সময়কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন—যা মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চলে। এই সময় লগিং সার্ভার আংশিক মেইন্টেনেন্স মোডে থাকে এবং কিছু লেনদেন ট্রেস করা কঠিন হয়। সাময়িক অভ্যন্তরীণ অ্যাকাউন্ট তৈরি ও বন্ধ করা সম্ভব হয় এবং কিছু লেনদেন পুনর্মিলনের সময় ওভাররাইট হয়ে যেতে পারে। আমার অ্যাকাউন্টের অনিয়মও এ সময়ে ঘটে।

দৃশ্যমান ব্যর্থতা ও অদৃশ্য প্রভাব

ইনসাইডারদের বর্ণনায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি দ্বি-স্তর প্রভাব দৃশ্যমান—একটি দৃশ্যমান স্তর, যেখানে বড় ঋণখেলাপিরা থাকে; আরেকটি অদৃশ্য স্তর, যেখানে ছোট ট্রেডিং হাউস, কাগুজে প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোহীন কনসালটেন্সিগুলোর মাধ্যমে নাকি অর্থ স্থানান্তর হয়। ভেলু-২২ একটি “অফলাইন তথ্যভান্ডার”—নিয়ে বহু বর্ণনা আসে।

জিরো-কমপ্লায়েন্স মরীচিকা

কিছু কর্মী বলেন, পরিদর্শনের সময় কিছু প্রতিষ্ঠান নাকি একটি “পরিপূর্ণতার ভার্চুয়াল চিত্র” প্রদর্শন করে—যেখানে সব লগ সঠিক, সব প্রক্রিয়া নিখুঁত। আমার ক্ষেত্রে ১.৪১ কোটি ডেডুকেশন–রিভারসেল-এর কোনো রেকর্ড অফিসিয়াল স্টেটমেন্টে ছিল না—স্ক্রিনশটে থাকা সত্ত্বেও।

এটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ

ব্যাংকিং হলো বিশ্বাসভিত্তিক কাঠামো। রেকর্ড সঠিক থাকবে—এই বিশ্বাসেই গ্রাহক টাকা রাখে। নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা কার্যকর—এই বিশ্বাসে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নেন। কিন্তু যদি রেকর্ড পরিবর্তনযোগ্য, অভিযোগ উপেক্ষাযোগ্য এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া কার্যকর থাকে—তাহলে আস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে বিনিয়োগ কমে, প্রবৃদ্ধি ধীর হয়, সুযোগ সংকুচিত হয়।

এখন প্রয়োজন কাঠামোগত সাহস

বাংলাদেশ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে অগ্রগতি করেছে, কিন্তু কাঠামোগত স্বচ্ছতা একই গতিতে এগোয়নি। কেবল বাহ্যিক আধুনিকায়ন যথেষ্ট নয়। গভীরতর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আস্থার সংকট দীর্ঘমেয়াদে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আমি নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ করছি—এই বিষয়গুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, কাঠামোগত সংকেত হিসেবে বিবেচনা করতে। আমার আসন্ন গ্রন্থ দ্যা ব্ল্যাক বুক—এ সমস্ত স্ক্রিনশট, টাইমলাইন ও প্রমাণ সংরক্ষিত আছে। এটি আমার বাবার আমলের অভিজ্ঞতারই ডিজিটাল পুনরাবৃত্তি। এখন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের—আমরা কি অদৃশ্য স্থাপত্যকে মোকাবিলা করব, না বাহ্যিক স্থিতির ভ্রমে চলব? এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আমাদের ভবিষ্যৎ আস্থার পথ।

লেখক : একজন কলামিস্ট ও উদ্যোক্তা। যিনি ডিজিটাল ব্যাংকিং স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।

পাঠকের মতামত:

১৬ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test