E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

স্মৃতির রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত বিজয়ের দিন 

২০২৫ ডিসেম্বর ১৫ ১৬:৪৮:৩৫
স্মৃতির রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত বিজয়ের দিন 

ওয়াজেদুর রহমান কনক


১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মুহূর্ত কোনো একক দিনের অনুভূতি নয়; এটি একটি জাতির দীর্ঘ নৈতিক সংগ্রাম, ঐতিহাসিক স্মৃতি এবং সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত সংহতির সময়। এই মুহূর্তে যে অনুভূতি জন্ম নেয়, তা কেবল উচ্ছ্বাস বা আনন্দের আবেগ নয়—বরং তা শোক, ত্যাগ, ন্যায়বোধ ও ভবিষ্যতের দায় একসঙ্গে ধারণ করা এক গভীর ঐতিহাসিক চেতনা। বিজয়ের এই অনুভূতি বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব এবং সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের আন্তঃসম্পর্কিত বিশ্লেষণ অপরিহার্য।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মানে ছিল ঔপনিবেশিক শোষণ ও অভ্যন্তরীণ আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক রায়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনা, ভাষাগত দমন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক অপমানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ ১৬ ডিসেম্বর এক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। এই মুহূর্তে অনুভূতির কেন্দ্রে ছিল “স্বীকৃতি”—নিজের ভাষা, ইতিহাস ও অস্তিত্বকে বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করার আত্মপ্রত্যয়। বিজয়ের আনন্দ তাই ব্যক্তিগত নয়; এটি সমষ্টিগত মর্যাদার পুনরুদ্ধার।

এই অনুভূতির আরেকটি গভীর স্তর হলো শোকের সঙ্গে আনন্দের সহাবস্থান। লক্ষ শহীদের রক্ত, নির্যাতিত নারী, উদ্বাস্তু পরিবার এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত গ্রাম-নগরের স্মৃতি বিজয়ের উল্লাসকে কখনোই নির্ভেজাল হতে দেয় না। ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতি তাই এক ধরনের নৈতিক দ্বন্দ্ব বহন করে—একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে অপূরণীয় ক্ষতির ভার। এই দ্বৈততা জাতির স্মৃতিতে এক অনন্য মানসিক গঠন তৈরি করেছে, যেখানে বিজয় মানে দায়িত্বও বটে।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই মুহূর্ত বাঙালির দীর্ঘকালীন ট্রমার এক প্রকার সমাপ্তি এবং একই সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জের সূচনা। যুদ্ধকালীন ভয়, অনিশ্চয়তা ও সহিংসতার অভিজ্ঞতা বিজয়ের মাধ্যমে অর্থ পায়—এই কষ্ট বৃথা যায়নি, এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতি এক ধরনের “সমষ্টিগত নিরাময়” হিসেবে কাজ করে, যদিও তা সম্পূর্ণ নয়, বরং চলমান।

রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিতে, বিজয়ের মুহূর্ত একটি নৈতিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা করে—রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে। স্বাধীনতার এই অনুভূতি মানুষকে কেবল আবেগী করে তোলে না, বরং প্রশ্নও জাগায়: যে রাষ্ট্রের জন্য এত ত্যাগ, সেই রাষ্ট্র কেমন হবে? ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা কি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হবে? ফলে বিজয়ের অনুভূতির ভেতরেই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার বীজ নিহিত থাকে।

সাংস্কৃতিকভাবে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির স্মৃতি-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। গান, কবিতা, শিল্পকলা ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অনুভূতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। বিজয়ের মুহূর্ত তাই সময়ের মধ্যে স্থির কোনো ঘটনা নয়; এটি প্রতিবার নতুন করে নির্মিত হয় সামাজিক অনুশীলনের মাধ্যমে। প্রতিটি প্রজন্ম এই অনুভূতিকে নিজের বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে নতুন অর্থ দেয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতি আত্মপরিচয়ের এক চূড়ান্ত ঘোষণা। এটি বলে দেয় যে বাঙালি কেবল ভৌগোলিক সত্তা নয়, বরং ন্যায় ও আত্মমর্যাদার পক্ষে দাঁড়ানো এক ঐতিহাসিক সত্তা। এই মুহূর্তের অনুভূতি তাই অতীতের বিজয়কে স্মরণ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য এক নৈতিক দিকনির্দেশনা—যাতে স্বাধীনতা কেবল অর্জিত সত্য না হয়ে প্রতিদিনের চর্চায় রূপ নেয়।

বিজয় দিবসের অনুভূতি কোনো নির্দিষ্ট ক্ষণিক আবেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি জাতির দীর্ঘ নৈতিক সংগ্রাম, ঐতিহাসিক স্মৃতি ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সম্মিলিত প্রকাশ। ১৬ ডিসেম্বর সেই দিন, যখন ইতিহাস কেবল একটি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেনি, বরং একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বগত দাবিকে নৈতিক বৈধতা দিয়েছে। এই দিনের অনুভূতি উচ্ছ্বাসে ভাসমান কোনো উৎসবমাত্র নয়; এর গভীরে প্রবাহিত থাকে শোক, ত্যাগ, আত্মমর্যাদা এবং ভবিষ্যতের প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা। বিজয় দিবস তাই আনন্দের পাশাপাশি আত্মসমালোচনারও দিন—যেখানে স্বাধীনতা অর্জনের অর্থ নতুন করে অনুধাবন করা হয়।

এই অনুভূতির কেন্দ্রে রয়েছে “স্বীকৃতি”—নিজের ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠা করার আত্মপ্রত্যয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনা, ভাষাগত দমন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক অপমানের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, ১৬ ডিসেম্বর তা রাষ্ট্রীয় ও ঐতিহাসিক স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে বিজয়ের অনুভূতি ব্যক্তিমানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমষ্টিগত মর্যাদার পুনরুদ্ধারে রূপ নেয়। এটি এমন এক মুহূর্ত, যেখানে একটি জাতি নিজেকে নতুন করে চিনে নেয়—পরাজয়ের ইতিহাস পেছনে ফেলে আত্মনির্ধারণের অধিকার অর্জনের গৌরবে।

তবে এই বিজয়ের আনন্দ কখনোই শুদ্ধ বা নির্ভেজাল নয়। লক্ষ শহীদের রক্ত, নির্যাতিত নারীদের নীরব যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু মানুষের দীর্ঘশ্বাস এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত জনপদের স্মৃতি বিজয়ের উল্লাসকে গভীর শোকের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। বিজয় দিবসের অনুভূতি তাই এক দ্বৈত বাস্তবতা বহন করে—একদিকে স্বাধীনতার উল্লাস, অন্যদিকে অপূরণীয় ক্ষতির ভার। এই সহাবস্থানই বিজয় দিবসকে নিছক উৎসব থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে এক নৈতিক উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যায়, যেখানে বিজয় মানেই দায়িত্ব।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির দীর্ঘকালীন ট্রমার এক অর্থবহ পরিণতি। যুদ্ধের ভয়, অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে রূপ নেয়, কষ্ট পরিণত হয় অর্থে। এই দিন একটি জাতির সমষ্টিগত স্মৃতিতে নিরাময়ের সূচনা ঘটায়, যদিও সেই নিরাময় সম্পূর্ণ নয়, বরং চলমান। বিজয় এখানে ভুলে যাওয়ার আহ্বান নয়; বরং স্মরণ করেই সামনে এগোনোর শক্তি সঞ্চয়ের দিন।

রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অর্থে বিজয় দিবস একটি নৈতিক অঙ্গীকারের প্রতীক। এই দিনের অনুভূতি রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ককে নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—যে রাষ্ট্র এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত, তা কি ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার আদর্শ রক্ষা করতে পারছে? ফলে বিজয়ের অনুভূতির মধ্যেই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার বীজ নিহিত থাকে, যা কেবল আবেগ নয়, বিবেককেও জাগ্রত করে।

সাংস্কৃতিকভাবে বিজয় দিবস বাঙালির স্মৃতি ও পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু। গান, কবিতা, শিল্পকলা ও জাতীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অনুভূতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর তাই কোনো স্থির অতীত নয়; এটি প্রতিবার নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থ ধারণ করে জীবিত হয়ে ওঠে। সর্বোপরি, বিজয় দিবসের অনুভূতি এক চূড়ান্ত আত্মঘোষণা—বাঙালি কেবল একটি ভূখণ্ডের নাম নয়, বরং ন্যায়, আত্মমর্যাদা ও মানবিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা এক ঐতিহাসিক সত্তা। এই অনুভূতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কেবল অর্জনের সত্য নয়; এটি প্রতিদিনের চর্চা ও দায়িত্ব।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test