E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

দিনাজপুরে মালচিং পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি চাষে ব্যাপক সাফল্য

২০২৫ জুন ২৯ ১৮:৪৮:৫১
দিনাজপুরে মালচিং পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি চাষে ব্যাপক সাফল্য

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক কৃষি প্রযুক্তি মালচিং পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি চাষে দিনাজপুরে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে দ্বিগুণ ফলন ও বাজারদর ভালো পাওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষক। সাফল্য দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষে।

সনাতন পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে লোকসান গুণে চাষাবাদ প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, দিনাজপুর সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের দিঘন গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন। গতবছর থেকে নতুন করে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন তিনি। এতে ভালো ফলন হওয়ায় সবজি চাষে আগ্রহ বেড়েছে তার। এ বছর তিনি চাল কুমড়া ও চিচিঙ্গা চাষ করছেন। ফনলও পেয়েছেন দ্বিগুণ।

কৃষক আফজাল হোসেন জানান, 'সবজি লাগিয়ে বার বার লস খাওয়ার পর পরামর্শের জন্য মহিলা বহুমুখি শিক্ষা কেন্দ্রের কৃষি অফিসার আবু সুফিয়ান স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন, মালচিং পেপার, ফেরোমন ফাঁদ, রঙিন আঠালো ফাঁদ সম্পর্কে সম্পর্কে জানতে পারি।

পরে পল্লী কর্ম-সংস্থান ফাউন্ডেশন আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এবং মহিলা বহুমুখি শিক্ষা কেন্দ্রের বাস্তবায়নে নতুন করে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি হিসেবে চাল কুমড়া ও চিচিঙ্গা চাষ শুরু করি। এতে তিন মাসের মধ্যে ভালো ফলন হওয়ায় সবজি চাষে আরও আগ্রহ বাড়ে আমার। '

শুধু আফজাল নয়,দিনাজপুরের অসংখ্য কৃষক এখন পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক কৃষি প্রযুক্তি মালচিং পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি চাষ করছেন। কম খরচে মরিচ, চাল কুমড়া,শসা,বরবটি, ধুন্দল, বেগুন, করলা ও চিচিঙ্গা চাষ করে দ্বিগুণ ফলন পাচ্ছেন অনেকেই।

কৃষক আফজালের চাষাবাদ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার অন্যান্য কৃষক মালচিং পেপার ব্যবহার করে নিরাপদ সবজি উৎপাদন শুরু করেছেন।

মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ভালো সফল হওয়া চাষি মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মহিলা বহুমুখি শিক্ষা কেন্দ্রের সহায়তায় প্রথমে আমি ১৮ শতাংশ জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে শসা চাষ শুরু করি। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে, রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করা লাগে। তাছাড়া পানি সেচও কম লাগে। এতে উৎপাদন খরচ কম হয়। একই সঙ্গে ফলনও ভালো হয়। তাই পরবর্তীতে আমি আরও ৫২ শতাংশ জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে ধুন্দল, বেগুন, মরিচ, চিচিংগা, বরবটি ও করলা আবাদ করেছি। এখন গ্রামের অনেক কৃষক এ পদ্ধতিতে সবজি চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সফল হওয়া চাষি রথিন্দ্র কুমার চন্দ্রে জানান,সহায়তায় প্রথমে আমি ২৫ শতাংশ জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে শসা চাষ শুরু করি। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে, রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করা লাগে। তাছাড়া পানি সেচও কম লাগে। এতে উৎপাদন খরচ কম হয়। একই সঙ্গে ফলনও ভালো হয়। তাই পরবর্তীতে আমি আরও ৬৪ শতাংশ জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে ধুন্দল, চিচিংগা, বরবটি ও করলা আবাদ করেছি। এখন গ্রামের অনেক কৃষক এ পদ্ধতিতে সবজি চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’

মালচিং পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি চাষাবাদে কৃষকদের কারিগরি সহায়তা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফ এবং মহিলা বহুমুখী সমবায় কেন্দ্র-এমবিএসকে নামে দু'টি প্রতিষ্ঠান।

নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য সমন্বিত কৃষি ইউনিট-সমিতির মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি ভোক্তাদের কাছে নিরাপদ সব্জি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

মহিলা বহুমুখি শিক্ষা কেন্দ্র-এমবিএসকের কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আবু সুফিয়ান পিনু জানান, ' বিভিন্ন স্থানে এ পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি চাষ শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কৃষিপ্রধান জেলা দিনাজপুরে মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজির ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় উৎসাহিত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।'

তিনি বলেন, 'বর্তমানে উৎপাদিত সব সবজিতেই ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছ্র পরিবেশবান্ধব নানা প্রযুক্তি ও পদ্ধতি। সেই পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির মধ্যে একটি মালচিং পদ্ধতি।মালচিং পদ্ধতিতে প্রথমে জমিতে পরিমিত রাসায়নিক ও জৈব সার দিয়ে সারি সারি বেড তৈরি করা হয়। পরে সারিবদ্ধ বেডগুলো পলিথিন দিয়ে দেওয়া হয় ঢেকে। বেডে নির্দিষ্ট দূরত্বে পলিথিন ফুটো করে সবজির বীজ বা চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের পর শুধু দেখভাল করা ছাড়া তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পড়েনা। মালচিং পেপার দ্বারা ঢেকে দেওয়ার কারণে ছত্রাক বা রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে। জমির পরিচর্যার জন্য তেমন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ফলে উৎপাদন খরচ হয় খুব কম। এই পদ্ধতিতে ফলন হয় দ্বিগুণ। পরিশ্রম কম হয়। এ পদ্ধতি অনেক সহজলভ্য, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব।''
দিনাজপুরের সদর, বীরগঞ্জ, কাহারোল, খানসামা, চিরিরবন্দর উপজেলা সরজমিনে ঘুরে স্থানীয় কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, আগে যে পরিমাণ সবজির উৎপাদন হতো, মালচিং পদ্ধতি ব্যবহারে সবজির উৎপাদন অনেক গুন বেড়ে গেছে। এছাড়া জমিতে কোনো আগাছা হয় না। কোন ধরনের রাসায়নিক সার দিতে হয় না। পরিশ্রমও কম হয়। এসব কৃষকদের দেখাদেখি আরো কৃষকরা পলিথিন মালচিং ব্যবহার করে চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

বিভিন্ন রাস্তা থেকে সবজি ক্ষেতের দিকে তাকালে দেখা যায়, নতুন এক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে সবজি। প্লাস্টিকের ছিদ্র ভেদ করে বের হয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছ। এসবের মধ্যে বেশির ভাগই সবজি গাছ।

এ পদ্ধতিতে জমির মাঝে দুই পাশ থেকে কেটে দেড় ফুট চওড়া করে ও ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে বেড তৈরি করা হয়। তৈরি বেডগুলো মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্লাস্টিকের মালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা থাকে নিচে আর সিলভার রঙের দিকটা থাকে উপরের দিকে অর্থাৎ সূর্যের দিকে। সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে মাটিকে রাখে ফসলের জন্য উপযোগী।

কৃষককে সিকান্দার আলীরভকাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এটি হচ্ছে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ। এ পদ্ধতিতে জমির মাঝে দুই পাশ থেকে কেটে দেড় ফুট চওড়া করে ও ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে বেড তৈরি করা হয়। তৈরি বেডগুলো মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্লাস্টিকের মালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা থাকে নিচে আর সিলভার রঙের দিকটা থাকে উপরের দিকে অর্থাৎ সূর্যের দিকে। সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে মাটিকে রাখে ফসলের জন্য উপযোগী।

পরে মালচিং পেপারের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল গোল করে কেটে নেওয়া হয়। আর এরপর কেটে নেওয়া জায়গায় রোপণ করা হয় সবজি বীজ বা চারা। এরপর তিন ফুট উঁচুতে বাঁশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। এতেই সবজির ফলন হয়।

এই পদ্ধতিটি তৈরিতে শুরুতে একসঙ্গে কিছুটা খরচ বেশি হলেও পরবর্তী সময়ে খরচ হয় খুবই কম। এ ছাড়া আগাছা হয় না বলে পরিষ্কারের কোনো ঝামেলা থাকে না।

দফায় দফায় সার দেওয়ার ঝামেলাও নেই। আর গাছ দীর্ঘজীবী হওয়ায় উৎপাদন হয় দীর্ঘসময় ধরে। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করে আশানুরূপ লাভ পাচ্ছেন কৃষক। অধিক পরিমাণে লাভজনক হওয়ায় দিন দিন মালচিং পেপার পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন দিনাজপুরের কৃষকরা।

(এসএএস/এএস/জুন ২৯, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test