E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

শৈলকুপায় পেঁয়াজ রোপনের ভরা মৌসুমে সারের কৃত্রিম সংকট, ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা

২০২৫ ডিসেম্বর ০৪ ১৮:৪৬:০৫
শৈলকুপায় পেঁয়াজ রোপনের ভরা মৌসুমে সারের কৃত্রিম সংকট, ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা

শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : পেঁয়াজ রোপনের ভরা মৌসুমে সারের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। ফলে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ। সঠিক সময়ে ক্ষেতে সার প্রয়োগ করতে না পারলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

কৃষকদের অভিযোগ, বিসিআইসি’র সার ডিলার ও কৃষি অফিসের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সারের এ কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।

এদিকে ডিএপি সারের তথ্য ও মজুদ নিয়ে সার ডিলার ও কৃষি কর্মকর্তাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। কৃষি অফিস বলছে,নভেম্বর মাসের বরাদ্ধকৃত সরকারের ভর্তুকির ১৫’শ ৪২ টন ডিএপি সারের মধ্যে ৯’শ টন কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এখনো ৬’শ টন ডিএপি সার মজুদ রয়েছে,ফলে সারের সংকট নেই। অন্যদিকে ডিলাররা বলছেন,ডিএপি সার নেই,গত ৬ মাস ধরে সংকট চলছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিপুল পরিমাণ এই সার গেল কোথায়? যার দাম ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার উপরে। প্রতি কেজি ডিএপি ২১ টাকা দরে ১ টনের ( ১ হাজার কেজি বা ২৫ মণ) দাম ২১ হাজার টাকা। এই হিসাবে ৬’শ টনের দাম কোটি ৩২ লাখ টাকা।

কৃষকদের অভিযোগ,বিসিআইসি’র ডিলাররা তাদের পছন্দ আর তদবিরে কৃষকদের সার দিচ্ছে। ফলে প্রান্তিক চাষীরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে সার পাচ্ছেন না। এদিকে ইউনিয়নে/ওয়ার্ডে সাব ডিলারদের অভিযোগ, সরকারি বরাদ্দের সার তাদের দিচ্ছে না ডিলাররা। ফলে সংকট আরো বেড়েছে,প্রান্তিক চাষীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে।

কৃষি অফিস জানায়,শৈলকুপা উপজেলায় গত মৌসুমে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হয় এবার প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ও সম্ভাবনা রয়েছে ।

সাব-ডিলার জাফর হোসেন বলেন,তারা সারের জন্য ডিলারদের কাছে ধর্ণা দিয়েও সার পাচ্ছেন না,ফলে কৃষকের ভোগান্তি বাড়ছে। এদিকে সাব-ডিলারদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ কৃষকদের। সাব-ডিলাররা তাদের সার বিভিন্ন এলাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে গোপনে বিক্রি করে দিচ্ছে,ফলে এক হাজার ৫০ টাকা বস্তার ডিএপি কৃষকদের কিনতে হচ্ছে ২ হাজার টাকার বেশি দামে।

উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে,এখন এই অঞ্চলের কৃষকেরা মাঠের পর মাঠজুড়ে পেঁয়াজ রোপনে ব্যস্ত সময় পার করছে। তবে ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ চাষীরা সার পাচ্ছে না, বিশেষ করে ডিএপি সার এখন সোনার হরিণ হয়ে গেছে। এক বস্তা সারের জন্য চাষীদের হাহাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মনোহরপুর ইউনিয়নের কৃষকরা বলছেন,তারা চাহিদা অনুযায়ী ডিএপি সার পাচ্ছে না। এভাবে বিভিন্ন ইউনিয়নের কৃষকেরা তাদের পেঁয়াজ ক্ষেতে সার দিতে পারেননি এখনো।

মনোহরপুর গ্রামের কৃষক সিজার মিয়া,আনোয়ার হোসেন, মনোয়ার হোসেন, শহিদুল মিয়া,হুমায়ুন মিয়া, চুকা হোসেন, রপু মিয়া, রহিদুল মিয়া, রিতন জোয়াদ্দার, রিপন হোসেন,আকবর মিয়া, জাফর হোসেনসহ এক গ্রামেরই অর্ধশত কৃষক এখনো তাদের পেঁয়াজের ক্ষেতে জমি তৈরী ও বপনের জন্য কোন সার পাননি ।

কৃষক শাহীন মিয়া জানান,তার ৫ বিঘার বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ করছেন কিন্তু এখনো প্রয়োজনীয় ডিএপি সার দিতে পারেননি। তিনি জানান,নভেম্বর মাসে শৈলকুপায় ১৫’শ ৪২ টন ডিএপি বরাদ্ধ ছিল,তার মধ্যে ৯’শ টন বিতরণ করা হয়েছে। ডিলারদের কাছে এখনো ৬’শ টন ডিএপি সার মজুদ রয়েছে। এছাড়া ডিসেম্বর মাসে ১৭’শ টন ডিএপি সার আসবে,ফলে কৃষকদের সারের কোনোসংকট হবে না।

ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের ডাউটিয়া গ্রামের কৃষক আরিফ মৃধা জানান,সরকার নির্ধারিত মূল্য ছাড়াও অতিরিক্ত দাম দিয়েও সার পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো খুচরা দোকানেও সার নেই। সময়মতো জমিতে সার দিতে না পারলে পেঁয়াজ চাষে ক্ষতি হয়ে যাবে।

তবে কৃষি অফিসের তথ্য ও বক্তব্যের সাথে একমত নয় সার-ডিলাররা। বিসিআইসি ডিলাররা বলছেন, গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে শৈলকুপায় ডিএপি সারের সংকট রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ নেই ডিএপি সহ অন্যান্য সারের। ফলে প্রশ্ন উঠেছে নভেম্বর মাসের জন্য যে ১৫’শ ৪২ টন ডিএপি এসেছিল,তার মধ্যে ৯’শ টন কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে, বাকি ৬’শ টনের বেশি ডিএপি সার গেল কোথায় ? যার দাম কোটি ২৬ লাখ টাকা। কৃষি অফিসের তথ্যমতে প্রতি ডিলারের কাছে এখনো ৪২ টন করে ডিএপি সার থাকার কথা রয়েছে ।

বিসিআইসি সার ডিলার সমিতির সভাপতি ও হাকিমপুর ইউনিয়নের সার ডিলার নোমান মোল্লার দাবি,চাহিদা অনুযায়ী ডিলাররা সার পাননি,ফলে এমন সংকট দেখা দিয়েছে।

মনোহরপুর ইউনিয়নের সার ডিলার গোলাম নবী জানান,তার কাছে ৫ টনের মতো ডিএপি সার মজুদ আছে,যা বিতরণ চলছে। তিনি বলেন,সরকারি হিসাবে পেঁয়াজ লাগানোর সময় কৃষকেরা বিঘা প্রতি ২০/২৫ কেজি ডিএপি পাবে কিন্তু বস্তা বস্তা ডিএপি দাবি করে কৃষকেরা। এতে করে সংকট বেড়েছে ।

এদিকে সার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ডিলারসহ কৃষি কর্মকর্তাদের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করে কৃষক-ক্ষেতমজুর নেতা সুজন বিপ্লব বলেন,অবিলম্বে দোষীদের ডিলারশিপ বাতিল ও দুর্নীতিবাজ কৃষি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে কৃষকের পর্যাপ্ত সারসহ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

তিনি বলেন, খুলনা বিভাগের মধ্যে শৈলকুপায় সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করে কৃষকেরা। মূলত এই সুযোগ নিয়ে চাষীদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে সরকারি সার নিয়ে। এতে উৎপাদন ব্যহত ও চাষের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। দ্রুত এই সংকটের সমাধান না করা হলে লোকসানের ফলে কৃষক পেঁয়াজ চাষ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।

শৈলকুপা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান বলছেন,তারা প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করছেন অসাধু সার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তিনি বলছেন,খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বেশী সার বরাদ্ধ রয়েছে শৈলকুপায়। কোনো ডিলার বা সাব-ডিলারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা দ্রুত জানানোর অনুরোধ জানান তিনি। ইতোমধ্যে শৈলকুপা ডিলার সমিতির সভাপতিকে কৃষি অফিস থেকে শোকজ করা হয়েছে।

এদিকে অবৈধ সার ডিলার ও মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে বিপুল পরিমাণ সার উদ্ধার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই ব্যবসায়ীকে অর্ধলক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানের সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজুর রহমান, উপজেলা কৃষি বিভাগ ও থানা পুলিশের একটি টিম উপস্থিত ছিলেন।

এসময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শৈলকুপা পৌর শহরের পাইলট স্কুল মার্কেটের একটি তালাবদ্ধ গোপন গোডাউনে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। সে সময় ১১০ বস্তা টিএসপি ও ৭৫ বস্তা ডিএপি সার উদ্ধার করা হয়। একইসময়ে পাইটল হাইস্কুল রোড এলাকায় মেসার্স জীম ট্রেডার্সে অভিযান পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সিরাজুল ইসলামকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এছাড়া তার গুদাম থেকে ১৬৫ বস্তা ডিএপি সার উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে খুলুমবাড়িয়া বাজারে অবৈধভাবে সার রাখার অপরাধে আবু দাউদ নামের এক খুচরা ব্যবসায়ীকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া তার দোকান থেকে ১৩৩ বস্তা ইউরিয়া, এমওপি ১৫৬ বস্তা ও দুই বস্তা ডিএপি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত এসব সার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সরকারি মূল্যে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়।

(এসই/এএস/ডিসেম্বর ০৪, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test