E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মিটফোর্ডের নির্মমতা: ছবি, নীরবতা ও ক্ষমতার কালোছায়া

২০২৫ জুলাই ১৫ ১৯:২১:৩৮
মিটফোর্ডের নির্মমতা: ছবি, নীরবতা ও ক্ষমতার কালোছায়া

দিলীপ চন্দ : গত ৫ জুলাই বুধবার, মিটফোর্ডের জনাকীর্ণ পরিবেশে সংঘটিত সোহাগ হত্যাকাণ্ড কেবল একটি প্রাণহানি নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের গভীরে প্রোথিত ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির জাল এবং গণমাধ্যমের প্রশ্নবিদ্ধ নীরবতার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। ঘটনার দুই দিন পর, যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর মাধ্যমে এই নৃশংসতা জনসমক্ষে আসে, তখন ছবিগুলো যেন এক অজানা সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে, যা এই হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

অস্ত্রের মুখে এক মুখ, ক্ষমতার বলয়ে আরেক: প্রথম ছবিটি (বাম দিকে) এক ব্যক্তিকে অস্ত্র হাতে দেখাচ্ছে, যার মাথায় লাল টিক চিহ্ন দেওয়া। এই ছবিটি সোহাগ হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার প্রাথমিক দৃশ্য তুলে ধরে। তবে, একই ব্যক্তির মুখাবয়বের সঙ্গে পরবর্তী দুটি ছবির সাদৃশ্য গভীর প্রশ্ন তৈরি করে।
দ্বিতীয় ছবিটি (ডান দিকে) একই মুখাবয়বের এক ব্যক্তিকে (লাল টিক চিহ্ন দেওয়া) একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার পাশে হাসিমুখে দাঁড়ানো দেখাচ্ছে। এই দৃশ্যটি ইঙ্গিত দেয় যে, যে ব্যক্তি অস্ত্র হাতে ছিল, সে হয়তো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তি। এই বৈপরীত্যই এই হত্যাকাণ্ডের সরল অপরাধমূলক ব্যাখ্যাকে জটিল করে তোলে। একজন অস্ত্রধারী ব্যক্তি কীভাবে রাজনৈতিক মহলের এত কাছাকাছি থাকতে পারে, তা ক্ষমতার অপব্যবহারের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।

ঘনিষ্ঠতা ও প্রভাবের ইঙ্গিত: তৃতীয় ছবিটি দুইজন ব্যক্তিকে দেখাচ্ছে, যেখানে একজন (লাল বৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত) পূর্বে অস্ত্র হাতে দেখা যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, এবং অন্যজন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ছবিটি আরও একবার অভিযুক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের ছবিগুলো শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রমাণ নয়, বরং ক্ষমতার বলয়ে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে অপরাধীদের যোগসাজশের একটি নীরব দলিল।

এটি প্রশ্ন তোলে, এই ঘনিষ্ঠতা কি অপরাধ সংঘটনে তাদের সাহস জুগিয়েছিল, নাকি এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ?

একই মুখ, ভিন্ন প্রেক্ষাপট, প্রশ্নবিদ্ধ নীরবতা : চতুর্থ ছবিটি (লাল বৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত) একজন দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে দেখাচ্ছে, যার মুখাবয়ব পূর্বের ছবিগুলোতে চিহ্নিত ব্যক্তির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই ছবিতে তাকে একজন অন্য ব্যক্তির সাথে সাধারণ পোশাকে দেখা যাচ্ছে, যা তার দৈনন্দিন জীবন বা সামাজিক মেলামেশার চিত্র হতে পারে। কিন্তু এই ছবিগুলো যখন হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আসে, তখন এর গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়।

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি ওঠে গণমাধ্যমের নীরবতা নিয়ে। এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড জনসম্মুখে সংঘটিত হওয়ার পরও কেন মূলধারার গণমাধ্যমগুলো প্রথম দুই দিন নীরব ছিল? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যদি এই ঘটনাকে জনসমক্ষে না আনতো, তবে কি এই নির্মমতা চাপা পড়ে যেত? এই নীরবতা কি কোনো রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবের ফল, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে?

রাষ্ট্র কাঠগড়ায়, দুর্নীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি : আপনার দেওয়া পূর্ববর্তী প্রতিবেদনটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযানের চিত্র তুলে ধরেছে, যেখানে ২৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা, ৯২ জন রাজনীতিবিদ এবং ১১৪ জন ব্যবসায়ীসহ মোট ১,২৬৪ জন অভিযুক্ত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে সোহাগ হত্যাকাণ্ড আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ প্রমাণিত হয়, তবে তা কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে প্রবেশ করেছে, তার একটি ভয়াবহ উদাহরণ।

অধ্যাপক জোবায়ের আহমেদ যেমনটি বলেছেন, "আমরা এতদিন ধরে যে রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের কথা বলেছি, এখন প্রশাসনও সেই ছায়ায় চলে গেছে। নীতিহীনতার সঙ্গে পেশাদারিত্বের বিচ্যুতি রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করেছে।" সোহাগ হত্যাকাণ্ড যেন এই উক্তিরই এক জীবন্ত প্রমাণ।

ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার আহ্বান : মিটফোর্ডের সোহাগ হত্যাকাণ্ড এবং এর সঙ্গে জড়িতদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিতবাহী ছবিগুলো বাংলাদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। এই ঘটনা কেবল একটি আইনি তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং এর পেছনে থাকা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং গণমাধ্যমের নীরবতার কারণও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

জাতি এখন তাকিয়ে আছে, এই মামলাটি কি কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হয়ে থাকবে, নাকি সত্যিকারের ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাবে? এই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তই কেবল নিহত সোহাগের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

(ডিসি/এসপি/জুলাই ১৫, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test