E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ছাত্রসমাজ ও নারীদের ভবিষ্যৎ কোথায়

গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাস্তবতায় এক অনিশ্চিত যাত্রার প্রতিচ্ছবি

২০২৫ জুলাই ১৬ ১৯:৩৭:১০
গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাস্তবতায় এক অনিশ্চিত যাত্রার প্রতিচ্ছবি

দিলীপ কুমার চন্দ : ৫ আগস্ট ২০২৪—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র জনতার উত্তাল স্রোত ভেঙে দেয় বহুদিনের পুরনো কাঠামো। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে জাতি প্রবেশ করে এক নতুন অধ্যায়ে।

ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মানুষ আশাবাদী হয়েছিল—সম্ভবত এবার সত্যিই পরিবর্তন আসবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই আশার জায়গা দখল করে নেয় হতাশা, ভয় আর অনিশ্চয়তা।

অস্থির রাজনৈতিক আবহে দিশেহারা ছাত্রসমাজ: যাঁরা বুক চিতিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন, গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছিলেন, সেই ছাত্রসমাজই আজ সবচেয়ে বেশি হতবাক ও বিভ্রান্ত। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির নামে দখলবাজি, ছাত্রনেতা নামধারী কিছু যুবকের চাঁদাবাজি আর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বলছিলেন, “আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম ন্যায়ের পক্ষে। আজ ক্লাসরুমে ফিরতেও ভয় লাগে। কে কোন দলের, কার সঙ্গে কথা বললে বিপদ—এই চিন্তায় পড়াশোনা দূরে থাক, নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি।”

রাজনীতি যেভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর চেপে বসেছে, তাতে আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরির স্বপ্ন আজ অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

নারীদের নিরাপত্তাহীনতা: প্রতিবাদ থেকে পিছু হটার ভয়: যে গণআন্দোলনের মূলশক্তি ছিল তরুণীরা, সেই নারীরাই এখন সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ।রাজপথে যেমন তাঁরা ছিলেন অগ্রণী, তেমনি পরবর্তী সহিংসতায় তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।কোথাও নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা, কোথাও বাড়ি থেকে অপহরণ, কোথাও আবার প্রকাশ্যে হেনস্থা—এই চিত্র এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়, প্রতিদিনকার বাস্তবতা।

খুলনার এক কলেজছাত্রীকে রাজনৈতিক নেতার অনুসারীরা দিনের আলোয় তুলে নিয়ে গেছে—ভিডিও ভাইরাল হলেও ব্যবস্থা হয়নি কোনো। রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে নারী শিক্ষার্থীদের উপর রাতের বেলা হামলা হয়েছে—নিরাপত্তা ব্যবস্থার ছিল চরম দুর্বলতা।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আগস্ট ২০২৫ থেকে এখন পর্যন্ত দেশে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে ৪২%। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে এক একটি কান্না, লজ্জা, প্রতিবাদহীনতায় গুমরে ওঠা আত্মা।

শিক্ষাক্ষেত্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বন্ধ, সেশনজট চরমে, অনলাইন ক্লাস নেই বললেই চলে। শিক্ষকরা অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় বাইরে বের হন না, শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে সময় নষ্ট করছেন অলসতায় বা রাজনৈতিক দলে ভিড়ে।

শুধু তাই নয়, অভিভাবকরা এখন মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বদলে বিবাহের কথা ভাবছেন—‘নিরাপদ পথ’ হিসেবে।এভাবে একটি প্রজন্মের স্বপ্ন থেমে যাচ্ছে অসময়ে, বাধ্য করা হচ্ছে গুটিয়ে যেতে।

প্রশাসনের নিরবতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর:অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায় ছিল স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, কিন্তু বাস্তবতা হলো—বিচারহীনতা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।নেতাদের আশ্বাস যতই মধুর হোক, মাঠের বাস্তবতায় বিচার নেই, নিরাপত্তা নেই, নীতিনৈতিকতা নেই।

যেসব পুলিশ অফিসার গণআন্দোলনের সময় মানবিক ছিলেন, তাঁদের বদলি করা হয়েছে।বরং উগ্র রাজনীতিকদের প্রশ্রয়ই বেড়েছে—আর তার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—যেখানে আদর্শের জায়গায় এসেছে দলীয় ফায়দা, নেতৃত্বের জায়গা দখল করেছে অস্ত্র আর ভয়।ছাত্রসমাজ, যাঁদের কাঁধে জাতির ভবিষ্যৎ গড়া, আজ তাঁরাই দিশেহারা। নারীরা, যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন এক নিরাপদ, সমানাধিকারের রাষ্ট্রের, তাঁরাই আজ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে।

এই বাস্তবতা যদি আমরা এখনই মোকাবিলা না করি, তাহলে শুধু একটি সরকার নয়, একটি প্রজন্মকে হারাব আমরা—চিরতরে।

এই সময় ইতিহাসে কীভাবে লেখা হবে, তা নির্ভর করছে বর্তমান নেতৃত্ব ও সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকার ওপর। রাজনীতি হোক সেবার, শিক্ষা হোক মুক্তির, নারী হোক মর্যাদার প্রতীক—এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

(ডিসি/এসপি/জুলাই ১৬, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test