E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

‘নিরাপত্তাহীনতায় শুধু ভোটার নয়, রাজনীতিবিদরাও’

২০২৫ ডিসেম্বর ১৫ ১২:০৪:০১
‘নিরাপত্তাহীনতায় শুধু ভোটার নয়, রাজনীতিবিদরাও’

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। এই উদ্বেগ শুধু ভোটার বা বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; রাজনীতিবিদরাও এখন নিজ নিজ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। সম্প্রতি ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা সেই আশঙ্কাকে আরো জোরালো করেছে। এই হামলাই শেষ নয়—এমন ধারণাও তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।

রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ট্র্যাকার’ ওয়েবসাইটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ও বর্তমান সরকার রাজনীতিবিদদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘সাধারণত বিপন্ন জনগোষ্ঠী বলতে আমরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী সম্প্রদায় বা ভিন্নমতাবলম্বীদের কথা বলি। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তাও একটি বড় উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরো সহিংসতা বা হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, দেবপ্রিয় জানান, গত দেড় মাসে ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ট্র্যাকার’ প্ল্যাটফর্ম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাক-নির্বাচনী সংলাপ আয়োজন করেছে। এসব সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা প্রায় সর্বত্রই নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাজনৈতিক পরিবেশ আদৌ নিশ্চিত করা যাবে কি না—এ নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত নন। এসব আলোচনার ভিত্তিতে একটি নাগরিক ইশতেহার প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।

সংস্কার এজেন্ডা প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের অভিজ্ঞতা থেকেই সংস্কার নিয়ে বর্তমান বিতর্কের ভিত তৈরি হয়েছে। তাঁর মতে, রাজনীতিবিদ, আমলা ও বড় ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি উচ্চবর্গীয় এলিট গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, যা প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফল হিসেবে দেশে তৈরি হয়েছে প্রতিযোগিতাহীন অর্থনীতি। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা ‘চামচা পুঁজিবাদ’ বিকশিত হয়ে এক পর্যায়ে অলিগার্কিক বা লুটপাটতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। এতে রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নের স্বাধীনতা

ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করা হয়েছিল, তা অনেক ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত ছিল এবং অংশগ্রহণমূলক ছিল না। সাধারণ মানুষ সেই উন্নয়নের পূর্ণ সুবিধা সব সময় পায়নি।

দেবপ্রিয় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে সংস্কার কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে বর্তমান উদ্যোগটি আলাদা, কারণ এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কমিশন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ সুযোগ তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করলেও তিনি বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়ার শুরুতে যে উদ্দীপনা ও গতি ছিল, তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাঁর ভাষায়, সংস্কার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, তথ্য-উপাত্তের ধারাবাহিকতা এবং কার্যকর যোগাযোগ সব সময় বজায় রাখা হয়নি। সরকারের ভেতরে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল এবং অংশীজনদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত উদ্যোগ দেখা যায়নি। শুধু নকশা বা পরিকল্পনা করলেই সংস্কার সফল হয় না; নাগরিকদের সচেতন ও ধারাবাহিক অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কার অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য থাকলেও সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক ও আমলাশক্তি। তাঁর মতে, জুলাই আন্দোলন থেকেও এসব গোষ্ঠী কোনো শিক্ষা নেয়নি। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজেও স্বার্থান্বেষী শক্তির সক্রিয় উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি সর্বত্রই ‘চুরির মহাসাগর’ দেখতে পেয়েছেন। সেই মহাসাগর শুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হলেও এটি অত্যন্ত কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, মাফিয়াদের তাড়াতে এক বছর লেগেছে, আর এখন আবার নতুন নতুন মাফিয়া তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, সংসদে ব্যবসায়ীদের আধিক্য রাজনীতির নৈতিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বর্তমানে সংসদের প্রায় ৬০ শতাংশ সদস্যই ব্যবসায়ী, যা স্বার্থের সংঘাত তৈরি করছে। পাশাপাশি প্রশাসনের ভঙ্গুর বাস্তবতায় অল্প সময়ে প্রত্যাশিত সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবসম্মত নয়, এমন হতাশাও প্রকাশ করেন উপদেষ্টা।

অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং খাতের গভীর সংকট নিয়েও আলোচনা হয়। বক্তারা জানান, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে প্রায় ছয় লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৯৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করাই যথেষ্ট নয়, ব্যাংক খাতে আরো কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।

সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান বলেন, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, সমস্যা আইন প্রণয়নে নয়, বরং বাস্তবায়নের ব্যর্থতায়। তিনি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের উদাহরণ টেনে বলেন, বড় সংস্কার না হলেও সৎ নেতৃত্বের কারণে তখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়েছিল।

এ সময় সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব সুস্পষ্ট করার পাশাপাশি তাঁদের কার্যপ্রণালির নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, এমপিদের দায়িত্ব পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা জরুরি। একজন এমপিকে সব ধরনের কাজের এখতিয়ার দিলে অনিয়ম হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা ফেরানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, গত দেড় দশকে কমিশনের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের ‘বড় অধঃপতন’ ঘটেছে। এ আস্থা পুনরুদ্ধারই এখন কমিশনের অগ্রাধিকার। মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্য সাধারণত গোপনে হয়। তবে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে নির্বাচন কমিশন অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ

(ওএস/এএস/ডিসেম্বর ১৫, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test