E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইনে জমি উদ্ধার মানে ঢাকের দায়ে মণষা বিক্রি

২০১৭ সেপ্টেম্বর ২৩ ১৪:২৬:৪০
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইনে জমি উদ্ধার মানে ঢাকের দায়ে মণষা বিক্রি

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাংঘর্ষিক আইন, বিলম্বিত বিচার, খরচ বহুল ও রায় পরবর্তী জমি উদ্ধারে প্রশাসনের যথাযথ ভূমিকা না থাকায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাস্তবায়নে সফলতা শূন্যের কোটায়। এ ছাড়া আগামিতে এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের জমি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালত সূত্রে জানা গেছে, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন ও বিধিমালা-২০১২ অনুযায়ি ২০১২ সাল থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা দায়েরের কাজ শুরু হয়। মামলার আধিক্য অনুযায়ি বিচারক সকল মামলা গ্রহণযোগ্য(মেন্টেনেবল) বলে আদেশ দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। দ্রুত নিষ্পত্তির সুবিধার্থে পরবর্তীতে বিচার কার্যক্রম বিভিন্ন আদালতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষে এসব মামলা পরিচালনা করার জন্য অ্যাড. সুভাষ চক্রবর্তী, অ্যাড. সালমা আক্তার, অ্যাড. সুলতানা পারভিন শিখা ও অ্যাড. ফারুক শেখসহ কয়েকজন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জেলা ও দায়রা জজ, সদর সহকারি জজ, তালা সহকারি জজ, যুগ্ম জজ প্রথম আদালত, যুগ্ম জজ দ্বিতীয় আদালতে এসব মামলার বিচার চলছে।

একইভাবে মামলার রায় বাদির পক্ষে গেলে রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে রায় বাদির পক্ষে গেলে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন ও বিধিমালা-২০১২ এর সেকশান ১১(৪)/ক ধারা অনুযায়ি ডিক্রী প্রাপকের আবেদন অনুযায়ি জেলা প্রশাসককে ৩০ দিনের মধ্যে ওই জমি নোটিশের মাধ্যমে জবরদখল মুক্ত করে ডিক্রী প্রাপককে বুঝিয়ে দিতে হবে। ওই আইনের ১১(৪)/খ ধারা অনুযায়ি জেলা প্রশাসক পুলিশ দিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবে। ওই আইনের ৬(ক) ধারা অনুযায়ি আইন প্রবর্তনের পূর্বে যদি সরকারের দেওয়ার কোন ডিক্রী থাকে সেক্ষেত্রে ওই জমি অর্পিত সম্পত্তির আওতায় যাবে না। অথচ এ আইন না মেনে ভুরি ভুরি জমি বিচার আওতায় আনা হয়েছে। দেওয়ানী কার্যবিধির কোন্ আইন প্রয়োগ করা যাবে বা যাবে না তা সুষ্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় অনেক মামলায় রিভিশন হচ্ছে ও মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইনের সেকশান ২ এর ড এর কলামে জমি পাওনাদারের ক্যাটাগরী হিসেবে মূল মালিক বা উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীর স্বার্থাধিকারী বা ইজারা গ্রহণকারি বা অন্য কোনভাবে সম্পত্তি দখলদারের কথা বলা হয়েছে। অথচ উত্তরাধিকার সূত্রে সহ অংশীদার, মূল মালিক বা উত্তরাাধিকারী বা ইজারা গ্রহণকারিরা মামলা করতে পারবে এমন কথা উল্লেখ থাকায় বিচার ব্যবস্থা সাংঘর্ষিক হচ্ছে । ন্যয় বিচার পাওয়া বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সাতক্ষীরা আদালতের বিচারকরা প্রায় শতভাগ ইজারা গ্রহীতাদের মামলা খারিজ করে দিচ্ছেন। তবে মোট মামলার এক শতাংশ নিষ্পত্তি হলেও বিচার বিড়ম্বনায় পড়ে আছে কয়েক হাজার মামলা। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার একটিও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাদি দখলে আনতে পেরেছেন এমন নজির নেই।

সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. বিবেকানন্দ রায় জানান, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইনে আপিল ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) যাওয়ার সূযোগ নেই। তাছাড়া বিচার চলাকালিন ডিসিআরকৃত জমিতে আদালত স্থায়ী বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে না । কারণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত সরকারের পাশেই অবস্থান নেয়। তা ছাড়া একই জমি নিয়ে যদি একাধিক মামলা থাকে তাহলে সকল মামলা একইসাথে বিচার করার নিয়ম রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিচারে জটিলতা দেখা দেয়। তা ছাড়া বিবাদী পক্ষ সরকার হওয়ায় তাদের পক্ষে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশীলদার তাদের সরকারি আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ি জেলা প্রশাসকের অনুমোদন সাপেক্ষে আদালতে জবাব দাখিল করায় বিচার বিলম্বিত হয়।

তিনি জানান, একটি মামলার শুরু থেকে ৫৫ থেকে ৬০টি ধার্য দিন পড়ার পরও বিচার কার্যক্রম শেষ হচ্ছে না আইনের নানা জটিলতায়। সেক্ষেত্রে পাঁচ বছরে রায় মিলছে না। আইনজীবী, মোহরার, পেশকার, পিওনদের পিছনে খরচ করতে করতে মামলার বাদি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ১০ কাঠা জমি উদ্ধার করতে যেয়ে এক বিঘা জমি বিক্রির উপক্রম হয়েছে। তাছাড়া আপিলে জিতে যাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেও জমির দখল পাচ্ছেন না। তিনি ও অ্যাড. খগেন্দ্রনাথ ঘোষ উভয়েই রায় পেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে চার মাসেরও বেশি সময় পার করলেও কোন ব্যবস্থা বা প্রতিকার হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জেলার অর্পিত সম্পত্তির বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মী বা সমর্থকদের দখলে থাকায় সাংঘর্ষিক জায়গা এড়িয়ে চলতে চান জেলা প্রশাসক। ফলে রায়ের পরও জমি ফিরে পাওয়ার কোন সূযোগ থাকে না।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাস্তবায়ন নাগরিক কমিটির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি সাতক্ষীরা দিবা নৈশ কলেজের অধ্যাপক সংবাদ কর্মী আনিসুর রহিম জানান, ২০১২ সালের ৩০ জুন তাকে সভাপতি ও অধ্যাপক পবিত্র মোহন দাসকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৭ সদস্য বিশিষ্ঠ সাতক্ষীরা জেলা কমিটি গঠণ করা হয়। কমিটি গঠণের পর থেকে তারা মাত্র তিন থেকে চারটিসভা করেছেন জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সহকারি ভুমি কমিশনারসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পরবর্তীতে তাদের সংগঠণের আর কোন কার্যক্রম নেই।

তিনি জানান, জেলার ঠিক কি পরিমান সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির আওতায় তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসকের কাছে আছে বলে তিনি মনে করেন না। অর্পিত সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার নামে হিন্দু স¤প্রদায়কে আরো এক দফা প্রতারিত করছে সরকার। তাদেরকে নিঃস্ব করার আরো একটি কৌশল ছাড়া কিছুই নয়। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রয়াত অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ মজুমদার সাভারে তার পৈতৃক কোটি কোটি টাকার জমি উদ্ধার করতে পারেননি। সাতক্ষীরার বরেণ্য চিকিৎসক প্রয়াত ডাঃ শ্যামাপদ পালসহ (বাগেরহাটের রামপালে) বিভিন্ন জ্ঞানী জনেরা তাদের সম্পত্তি জীবদ্দশায় উদ্ধার করতে পারেননি। তাদের পক্ষে কেউ ওই জমি উদ্ধার করবে জবরদখলকারিদের কাছ থেকে এটা ভাবা আর মুর্খের স্বর্গে বাস করা সমান কথা। সাতক্ষীরা শহরের গড়েরকান্দার মুসলিমলীগ নেতা আব্দুল গফুর, মুনজিতপুরের নারী সাংসদ ক্ষমতাসীন দলের রিফাত আমিনসহ অনেকেই অর্পিত সম্পত্তি দখল করে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সরকার বদল হয়েছে অথচ ওই জমি উদ্ধারে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী ছয় বছরের জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হিন্দুদের উপর পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া কালা কানুন তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতার ভিত্তিতে তিনি দেখেন যে ওই সব শত্র“ সম্পত্তির (অর্পিত) ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ তারই দলীয় নেতা, কর্মী বা সমর্থকদের দখলে। বাকী অংশ বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ইসলামের নেতা কর্মীদের দখলে। তাই ওই আইন বাতিল করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে গেলে তার দলে লোক থাকবে না। ঘরে ঘরে যুদ্ধ বেঁধে যাবে। তাই তিনি ওই পথে হাঁটেননি। যদিও ২০১২ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন করে হিন্দুদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার নামে তাদের সমুহ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছেন তারই মেয়ে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দু সংগঠণগুলোর উচিত অর্পিত সম্পত্তিসমূহ একটি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ‘খ’ তপশীলের মধ্যে এনে খাস করে সরকারের দখলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা । সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা জমির মালিক হিসেবে অন্ততঃ ডিসিআর পাবে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার শীল জানান, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাস্তবায়নে সমস্যার শেষ নেই। আইনি জটিলতা ও দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে মালিকদের ওই জমি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। তাছাড়া রায় পাওয়ার পর জমি উদ্ধারে প্রশাসনের ভূমিকা না থাকা, অধিকাংশ জমি ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের দখলে থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এ আইনের সুফল ভোগ করা যাচ্ছে না। তাই আইনের যথাযথ বাস্তবায়নেও সংখ্যালঘু জনগোষ্টীর বেদখলীয় জমি ফিরে পাওয়া সংক্রান্ত সুফল পাওয়ার সুযোগ কম।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল লতিফ খাঁন জানান, এ সংক্রান্ত কয়েকটি আবেদন পেয়েছেন তিনি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না হলেও আদালতের রায় অনুযায়ি সংশ্লিষ্ট মালিকদের জমি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test