E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দালালের দখলে দক্ষিণাঞ্চল নৌ-রুটের টিকিট

২০১৭ ডিসেম্বর ৩০ ১৬:১৭:৫৪
দালালের দখলে দক্ষিণাঞ্চল নৌ-রুটের টিকিট

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটের লঞ্চের কেবিনের টিকিট দালাল ও অসাধু লঞ্চ কর্মচারীদের হাতে চলে যাওয়ায় টিকিট পেতে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের বারো মাসই চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। লঞ্চ মালিকরা ইচ্ছেমতো আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাংখী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেবিনের টিকিট দিলেও সাধারণ মানুষ জিম্মি এসব টিকিট কালোবাজারীর হাতে।

কেবিনের নির্ধারিত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দিলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটে লঞ্চের কেবিনের টিকিট। একাধিক যাত্রীরা জানান, লঞ্চের কেবিনের টিকিট পেতে হলে যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা না থাকলে টিকিট মিলছে না। নগরীর প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা তার আত্মীয়, প্রশাসনের কর্মকর্তা হলে অনায়াসেই মিলছে লঞ্চের টিকিট।

এ ব্যাপারে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের দাবি, যে সংখ্যায় যাত্রী রয়েছে, সে অনুযায়ী কেবিন না থাকায় সবাইকে টিকিট দেয়া যাচ্ছেনা। যাত্রীদের দাবি মালিক পক্ষের অবৈধ রোটেশন প্রথার কারণেই লঞ্চের টিকিট নিয়ে দালাল ও লঞ্চ কর্মচারীরা যাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছে। এছাড়া সরকারীভাবে কোন মনিটরিং না থাকায় লঞ্চের টিকিট যাচ্ছে দালালের হাতে। ফলে বৈধভাবে সাধারণ যাত্রীরা টিকিট পাচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেবিনের টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করা দালালরা জানান, লঞ্চ মালিক, প্রশাসন, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের সাথে সম্পর্ক রেখেই তারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ ব্যবসা করে আসছেন। তবে দালালে বিরুদ্ধে সব সময় নিরব ভূমিকা পালন করছেন নৌ-পুলিশ। তাদের (নৌ পুলিশ) সামনেই এসব দালালরা বীরদর্পে তাদের ব্যবসা চালিয়ে আসলেও বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই।

সূত্রমতে, ঢাকার সাথে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নৌ-পথ। বিশেষ করে অধিকাংশ অসুস্থ্য রোগী সড়কের পরিবর্তে নৌ-পথে বরিশাল থেকে ঢাকায় যাতায়াত করে থাকেন। এ কারণেই নৌপথের লঞ্চের টিকিট নিয়ে সক্রিয় রয়েছে একটি শক্তিশালী দালাল চক্র।

ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে চলাচলকারী উল্লেখযোগ্য লঞ্চগুলোর মধ্যে অন্যতম মেসার্স রাবেয়া শিপিং কোম্পানির পারবাবত। মেসার্স সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির সুন্দরবন। মেসার্স স্টার নেভিগেশন কোম্পানির সুরভী। টিপু কোম্পানির এমভি টিপু এবং কীর্তনখোলা। এসব লঞ্চের মধ্যে পারাবাত লঞ্চের ৮০ ভাগ লঞ্চের কেবিনই দালালের হাতে চলে যায় লঞ্চের কেরানি, বুকিং কাউন্টারের বুকিং ক্লার্ক, লঞ্চ ম্যানেজার ও সুপারভাইজারের মাধ্যমে। বাকী কেবিনগুলো প্রশাসন, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মালিক পক্ষের লোকজন পাচ্ছেন।

টিপু, ফারহান লঞ্চের কেবিনও একইভাবে দালালদের হাতে চলে যাচ্ছে। এসব কেবিন দুই থেকে তিন গুন দামে দালালের কাছ থেকে কিনে নিতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। এছাড়া লঞ্চ স্টাফদের যোগসাজসে বিলাসবহুল সুন্দরবন, সুরভী ও কীর্তনখোলা লঞ্চের কেবিনও মিলছে দালালের কাছে। মাঝে মধ্যে সরকারী-বেসরকারী কোঠার কেবিনগুলোও কর্মচারীদের সাথে যোগসাজস করে কিনে নেয় দালালরা।
দালালদের দাবী বর্ষা মৌসুম, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় লঞ্চের কেবিনের চাহিদা থাকে কম। ওইসময় তারা লঞ্চের কেবিন বিক্রি করে লঞ্চ মালিকদের সহায়তা করে থাকেন। এ কারণেই মূলত মালিক পক্ষ তাদের লঞ্চের কেবিন দিয়ে থাকেন। তবে তাদের এসব দাবী অস্বীকার করেছেন লঞ্চ মালিকরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লঞ্চের টিকিট কালোবাজারিদের মধ্যে অন্যতম লেদু (দালাল)। তিনিই মূলত লঞ্চের টিকিট কালোবাজারি শুরু করেছেন। এরপর এ কালোবাজারির সাথে যুক্ত হয়েছেন দালাল হাসেম, পারাবাত লঞ্চের স্টাফ সাগর, কলম্যান জসিম, সেলিম, বসির, কলম্যান ফজলা, খোকন, কালামখান লঞ্চের কলম্যান আলাউদ্দিন, মোশাররফ, জাহাঙ্গীর ও ইমাম, টিপু লঞ্চের কলম্যান দুলাল, খালেক, সুন্দরবন লঞ্চের কলম্যান জাহিদ, কবির হোসেনসহ আরও অনেকে। তবে লেদু, হাসেম, জসিম ও সেলিমই বর্তমানে এ চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করছেন।

দালাল হাসেম জানান, তাদের কাছ থেকে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই টিকিট নিয়ে থাকেন। তারা সবাইকে খুশি করেই লঞ্চ ঘাটে এ ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন। সূত্রমতে, এসব দালাল চক্র মূলত টিকিট কালোবাজারি করে বরিশাল লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় বসে। এদের কাছে কাউকে পাঠিয়ে দিলেও পাওয়া যায় লঞ্চের কেবিনের কাঙ্খিত টিকিট নামের সোনার হরিন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সিঙ্গেল কেবিনের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৯শ’ থেকে এক হাজার টাকা আর ডাবল কেবিন ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। কিন্তু সেই টিকিট কালোবাজারি দালালের কাছ থেকে বর্তমানে সিঙ্গেল কেবিন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা ও ডাবল তিন হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের।

নগরীর ফজলুল হক এভিনিউ এলাকায় মেসার্স সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির টিকিট বুকিং কাউন্টারের সামনে টিকিট প্রত্যাশী একাধিক যাত্রীরা বলেন, ‘লঞ্চের কেবিনের টিকিট পেতে হলেও যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা না থাকলে টিকিট মিলবে না’।

যাত্রীরা আরও বলেন, নগরীর প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা তার আত্মীয়, প্রশাসনের কর্মকর্তা না হলে বুকিং কাউন্টারগুলো থেকে সাধারণ যাত্রীরা লঞ্চের কেবিনের টিকিট পাচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়েই কালোবাজারি দালালের কাছে ধর্ণা দিতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের।

শনিবার কেবিনের একটি টিকিট হন্য হয়ে খুঁজছিলেন লঞ্চ টার্মিনালে আসা রেজাউল নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘বরিশাল থেকে তার স্বজনরা ঢাকায় যাবেন। তাই কেবিনের টিকিটের জন্য প্রায় দুইদিন আগ থেকে কাউন্টারগুলোতে ঘুরেও টিকিট মেলেনি। বুকিং কাউন্টারগুলো থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘কালোবাজারি হাসেমের কাছে ডাবল এবং সিঙ্গেল দুই শ্রেণির কেবিনের টিকিটই পেয়েছি। কিন্তু একটি সিঙ্গেল কেবিনের টিকিটের দাম রাখা হয়েছে তিন হাজার টাকা।

অপরদিকে ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে রোটেশন পদ্ধতির বিষয়ে রয়েছে যাত্রীদের বিস্তার অভিযোগ। এ পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলেও বিআইডব্লিউটিএ সমস্যা সমাধানে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলেও এ রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীরা অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লঞ্চ মালিক সমিতির একাধিক সদস্যরা জানান, রোটেশন পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিআইডব্লিউটিএ’র ব্যাপার। যদি তারা আমাদের ডাকে তবে অবশ্যই আমরা তাদের সাথে বসে এ সমস্যা সমাধান করবো।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএএর বরিশাল জোনের উপ-পরিচালক আজমল হোসেন মিঠু সরকার বলেন, কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বরিশাল নৌ-পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার মোতালেব হোসেন বলেন, দালালের বিরুদ্ধে নৌ-পুলিশ সোচ্চার রয়েছে। এ ব্যাপারে লিখিত কোন অভিযোগ পেলে অব্যশই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(টিবি/এসপি/ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test