E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলে হাতে ভাজা মুড়ির কারিগরদের দূর্দিন

২০১৮ জুন ০২ ১৩:৩৯:০৭
টাঙ্গাইলে হাতে ভাজা মুড়ির কারিগরদের দূর্দিন

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : রমজান মাসের ইফতারি তৈরিতে রকমারি উপাদানের মধ্যে মুড়ি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মুড়ির চাহিদা সারা বছর ব্যাপি থাকলেও রোজার সময় এর উৎপাদন এবং বিক্রি অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই মুড়ি ব্যবসায়ীরা বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকেন এ মাসটির জন্য। আবার অনেকে মৌসুমি ব্যবসা হিসেবে এই মাসে মুড়ি উৎপাদন এবং বিক্রি করে থাকেন।

টাঙ্গাইলসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় মুড়ি সরবরাহ হয় কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া থেকে। এখানকার উৎপাদিত মুড়ির সুনাম রয়েছে বিভিন্নস্থানে। মুড়ি উৎপাদনের সাথে এ এলাকার মানুষ অনেক পূর্বে থেকেই জড়িত। এখানে দুইভাবে মুড়ি উৎপাদিত হয়, হাতে ভেজে ও মেশিনের সাহায্যে। মুড়ি উৎপাদনকারি এলাকাগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার নারান্দিয়া শীর্ষে।

নারান্দিয়ায় ৪টি মিলে মেশিনের সাহায্যে এবং শতাধিক বাড়িতে হাতে ভেজে মুড়ি উৎপাদিত হয়। মেশিনের সাহায্যে মুড়ি উৎপাদন নতুন সংযোজন হলেও হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি এবং বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন বহু পরিবার যুগ যুগ ধরে। এ অঞ্চলে মোদক সম্প্রদায়ের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মুড়ি উৎপাদন।

নারান্দিয়া ইউনিয়নের নগরবাড়ীতে ২টি, দৌলতপুরে ২টি মোট ৪টি মিলে ৫টি মেশিনের সাহায্যে মুড়ি ভাজা হয়। সততা মুড়ির মিলের স্বত্বাধিকারী শংকর চন্দ্র মোদক বলেন, ৫০ কেজি চালের বস্তায় ৪৪-৪৫ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ি আমরা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করি। পাইকাররা আবার সেই মুড়ি প্রতি কেজি কমপক্ষে ৬৫-৭৫ টাকা দরে খুচরা বিক্রি করেন। রমজান মাসে প্রতিদিন ৫টি মিলে ১৫০ বস্তারও বেশি চালের মুড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিদিন মেশিনে ভাজা প্রায় ৪ লাখ টাকার মুড়ি কেনাবেচা হয় ওই এলাকায়।

এদিকে মেশিনের সাহায্যে বিপুল পরিমান মুড়ি প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হলেও হাতে ভাজা মুড়ির কদর এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেশিনে ভাজা মুড়ি সাদা ও লম্বা করতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ইউরিয়া কিংবা সোডা ব্যবহারের অভিযোগ থাকায় একশ্রেণির মানুষ সর্বদাই বিষমুক্ত হাতেভাজা মুড়ি খেয়ে থাকেন।

কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া, মাইস্তা, নগরবাড়ী, দৌলতপুর, লুহুরিয়া ও সিংহটিয়াসহ প্রায় পনেরটি গ্রামের কয়েক’শ পরিবার হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি করে থাকে। একজন ব্যক্তি ১ দিনে এক থেকে দেড় মণ চালের মুড়ি ভাজতে পারেন। প্রতি মণ চালে ২২ থেকে ২৩ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারি ৭০-৮০ টাকা এবং খুচরা ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মূলত গ্রামের মহিলারাই হাতে ভেজে গুণগত মানসম্মত মুড়ি তৈরি করেন।

দৌলতপুর গ্রামের অনিতা রানী মোদক নামের এক মহিলা বলেন আমরা বংশ পরম্পরায় এই মুড়ি ভাজা ও ব্যবসার সাথে জড়িত। ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকানোর পর আবার সেই ধান মেশিনে মাড়াই করে মুড়ি ভাজার জন্যে চাল তৈরি করা হয়। পরে সেই চাল দিয়ে লবণ জলের মিশ্রণে আগুনে তাপ সহ্য করে বিশুদ্ধ মুড়ি ভাজতে অনেক পরিশ্রম হয়। কিন্তু এবার বাজার দর অন্য বছরের চেয়ে একটু ভাল। অনেক সময় গ্রাহকদের চাহিদার তুলনায় হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি এবং সরবারহ কম হয়।

তাদের দেয়া তথ্যমতে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন এবং কেনাবেচা হয়। তবে পরিশ্রমের লাভ বেশির ভাগই চলে যায় মধ্যসত্বভোগীদের পকেটে। রমজান মাসে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা পিকআপ, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে বস্তাভর্তি মুড়ি কিনে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকায় বিক্রি করেন। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল থাকায় পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, বগুড়া, শেরপুর ও গাজীপুরে নারান্দিয়ার মুড়ি সরবরাহ হয়।

লোকনাথ মুড়ির মিলের স্বত্বাধিকারী সুনিল চন্দ্র মোদক বলেন আমরা অনেক সময় মোবাইলেও মুড়ির অর্ডার নিয়ে সরবারহ করে থাকি। তাছাড়া নির্দিষ্ট বাজারে স্থায়ী গ্রাহকরা মুড়ি ক্রয় করে থাকেন।

রমজানে ৬ লক্ষ টাকার মুড়ি প্রতিদিন মেশিনে ও হাতে ভেজে তৈরি হলেও বছরের অন্য সময়ে অর্ধেকে নেমে আসে। ৪টি মিলে ৪০জন শ্রমিক এবং শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ও বিপুল সংখ্যক মানুষ পরোক্ষভাবে মুড়ি ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে রমজানে কাজের চাপে দম ফেলার সময়টুকু পায়না মুড়ি উৎপাদনকারীরা।

তবে প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা। মেশিনে মুড়ি ভাজতে সময় কম লাগে কিন্তু তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি। অন্যদিকে হাতে মুড়ি ভাজতে সময় বেশি লাগে কিন্তু লাভ সামান্য। ফলে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা দিনদিন এই কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় ধাবিত হচ্ছেন এবং অনেকেই চলে গেছেন। এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।


(আরকেপি/এসপি/জুন ০২, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test