E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৯৯ বছর জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী

২০১৮ জুলাই ০৫ ১৫:৪৪:৫৬
৯৯ বছর জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী

তপন বসু, বরিশাল : “আধুনিক সমাজ ও দেশ গড়ার জন্য প্রতিটি শিশুকে শিক্ষিত হতে হবে। প্রতিটি ঘরের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হলেই দেশ এগিয়ে যাবে।” সরকারের আজকের এই শিক্ষা নীতির অন্তর্নিহিত কথা হয়ত আজ থেকে ৯৯ বছর আগে পশ্চাদপদ আগৈলঝাড়ায় ভেগাই হালদার বুঝতে পেরেছিলেন। ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তি অবহেলিত সমাজকে আলোকিত করতে প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ পরিবারের ছেলে মেয়েদের সু-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১৯১৯ সালের ২৬ জানুয়ারী আগৈলঝাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভেগাই হালদার তাঁর নিজের জায়গায় নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন “ ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী”।

অশিক্ষিত ভেগাই হালদার শিক্ষিত সমাজ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গৈলা গ্রামের প্রতিথযশা কৈলাশ সেনকে নিয়ে প্রথমে পাঠশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির রূপায়ন করেন। কালের বিবর্তনে আজ তা আগৈলঝাড়া উপজেলার অন্যতম বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সুনাম ছড়াচ্ছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও।

ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মোর্তুজা খান ও প্রধান শিক্ষক যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রী জানান, বর্তমানে এই বিদ্যাপীঠে প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়নের জন্য ২২জন শিক্ষক শিক্ষিকা কর্মরত রয়েছেন। প্রায় ৫ একর জমির উপর ৩০টি শ্রেণীকক্ষসহ দুটি দ্বিতল ভবন ১টি টিনের ঘরে ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক সুবিধা রয়েছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আশাব্যঞ্জক ফলাফল নিয়ে বের হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীরা।

ইতহাস ও প্রবীণ ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য মতে, ১৯১৯ সাল। ইংরেজী শাসন আমলে বঙ্গদেশ দ্বি-খন্ডিত করে বঙ্গদেশ ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামে পৃথক প্রদেশে পরিণত হয়। ভেগাই হালদার হিন্দু নিম্নবর্ণের পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় তৎকালীন উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে অবজ্ঞা আর অবহেলার চোখেই দেখছিলেন।

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সমাজ ব্যবস্থাকে শিক্ষিত করার প্রয়াসে ভেগাই হালদার নিম্নবর্ণ সহ সকল ধর্মের লোকের শিক্ষার জন্য একটি পাঠশালা স্থাপন করেন। ভেগাই দেশ বরেণ্য অশ্বিনী কুমার দত্তের সাহচর্য ও পরামর্শে গৈলার কৃতী সন্তান কৈলাশ সেনকে সাথে নিয়ে পাঠশালার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পাঠশালা প্রতিষ্ঠার প্রধান পন্ডিত ছিলেন হর ভূষণ হালদার। পর্যায়ক্রমে পাঠশালাটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের ঢল নামতে শুরু করলে অবকাঠামো বড় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় ভেগাইকে সহাঅনুভুতি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় নিবারণ চন্দ্র দাস, নিশি কান্ত মিস্ত্রী, সীতা নাথ হালদার, গোপাল হালদার, মফিজ উদ্দিন খান, মুন্সী দলিল উদ্দিন পাইক, ধনাই পাইকসহ আরও অনেকে। ওই সময় দশম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করা স্কুলগুলোর নাম ছিল ‘হাই ইংলিশ স্কুল’ (এইচ,ই,স্কুল)। ভেগাই তার স্বপ্নের পাঠশালাটিকে কাংখিত বিদ্যাপীঠে রুপান্তরিত করার জন্য উপমহাদেশে বিভিন্ন বিত্তশালীদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি নিজে লেখাপড়া না জানায় অর্থ সংগ্রহের জন্য ওই সময় একটি খাতা (ডায়েরী) ব্যবহার করতেন। ওই ডায়েরীতে স্কুলের জন্য দানকারী দাতাগণ তাদের অনুদান ও সংক্ষেপে তাদের অভিপ্রায় লিখতেন। যার মধ্যে প্রখ্যাত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, স্বদেশী আন্দোলনের নেত্রী সরোজিনী নাইডু, বাংলার বাঘ শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, আরসি ব্লাকহুড অন্যতম। তার ওই অনুদানের খাতা আজও স্কুলে রক্ষিত আছে।

এরপর আর থেমে থাকেনি ভেগাই হালদারের ইচ্ছা শক্তি। বিদ্যালয়টি আরও প্রসারিত করার জন্য জমির প্রয়োজন দেখা দিলে ভেগাই হালদার রামচরণ হালদারের কাছ থেকে জমি চাইলে শ্রদ্ধাভাজন রাম চরণ তাকে জমি দান করেন। বর্তমানে অবস্থিত বিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ জায়গাই রাম চরণ বিদ্যালয়ের নামে দান করেন।

তবে ভেগাই হালদারের জীবদ্দশায় তার স্কুলটি স্থায়ী মঞ্জুরী দেখে যেতে পারেননি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ তার প্রতিষ্ঠিত ভেগাই হালদার পাবলীক একাযেডমী (বিএইচপি একাডেমী) আধুনিক বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত।

ভেগাই হালদার সমাজের অবহেলিত লোকজনের কস্ট বুঝতে পেরে তিনি উদ্যোগে নিয়ে আগৈলঝাড়ায় একটি জনসভা করেন। ওই সভায় সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন দেশবরণ্য কবি ও সমাজসেবক অশ্বিনী কুমার দত্ত, আচার্য প্রফুল্ল¬ চন্দ্র রায়, শের-ই বাংলা একে ফজলুল হক, ভারতের বিখ্যাত পন্ডিত ও কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্য এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের বোনের মেয়ে সরলা দেবী। ভেগাই হালদারের উদ্যোগে ওই জনসভা সংবাদ তৎকালীন ভারতের আনন্দবাজার ও অমৃতবাজার পত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে ভেগাই হালদারের নাম ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে পরিচিত লাভ করেন। পরাধীনতার শক্তি থেকে দেশকে মুক্ত করতে রাজনীতিতেও ভেগাই হালদার অংশগ্রহণ করেন। ১২৬০ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ় জন্ম গ্রহণ করে র্দীর্ঘ ৮০ বছর কর্মময় জীবন শেষে ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ় অনুযায়ী ৬ জুলাই একই দিনে ভেগাই হালদার জাগতিক দেহত্যাগ করেন।

একই দিনে জন্ম ও মৃত্যু এবং তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি আজ সবার কাছে ‘মহাত্মা’ ভেগাই হালদার নামেই পরিচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ সংলগ্ন দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে তাঁর সমাধি মন্দির। ভেগাই তার কর্মজীবনের জন্য আগৈলঝাড়ায় চির অম্লান ও অবিনাশী হিসেবে সবার কাছে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন বলে মত প্রকাশ করেছেন স্কুলের শিক্ষক মন্ডলী ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।

(টিবি/এসপি/জুলাই ০৫, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test