E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আড্ডায় আলাপনে নাট্যজন মনোজ মিত্রর সন্ধ্যা

২০১৯ জুন ২২ ১৪:২১:৩১
আড্ডায় আলাপনে নাট্যজন মনোজ মিত্রর সন্ধ্যা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : নাড়ির টানে শিকড়ের সন্ধানে এসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন মনোজ মিত্র। শৈশবের ধুলিধূসর স্মৃতি আর বন্ধু বাৎসল্যের নানা ঘটনা স্মরণে এনে  নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। অস্তায়মান সূর্যের কিনারে এসে  নিজেকে নতুন করে চিনবার চেষ্টায় অশ্র“ ঝরিয়ে তিনি বললেন, যারা এদেশ থেকে চলে  গেছেন তাদের এক ধরনের কষ্ট রয়েছে। আর যারা দেশান্তরী হননি তাদের কষ্টও কম নয়। শিশু জীবনের খোলাধুলা পড়ালেখা আর প্রবীণদের শাসনের কথা স্মরণে এনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। ৮৪ বছর বয়সী এই প্রাজ্ঞ নাট্যজন ষ্পষ্ট ভাষায় নির্ভুল উচ্চারণে আরও বললেন স্মৃতি রয়ে যায়, স্মৃতি মুছে যায়না। এক পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে আরেক পরিমন্ডলে যেয়ে গড়ে তুলতে হয় নতুন ভূবন। 

আষাঢ়ের ঘন ঘন দেয়া গর্জন আর বর্ষন হুংকারের নির্মল পরিবেশে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এমনই এক আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। সাথে ছিলেন তার সহোদর কবি অমর মিত্র ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র বসু। শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবের শহিদ আলাউদ্দিন মিলনায়তন দর্শক শ্রোতায় টইটুম্বুর হয়ে পড়ে।

নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা সাতক্ষীরার ‘ধুলোর’ (ধুলিহর) গ্রামের সন্তান মনোজ মিত্র এদিন নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও এই মাটি ও মানুষের সাথে একাকার হয়ে যান। তিনি বলেন জন্মভূমি নিয়ে অনেক আবেগ আছে। শিকড়ে এলে নতুন অনুভব। বারবার তার স্মৃতিচারণে উঠে আসে ধুলিহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার কথা। পিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩/৪ মাস লেখাপড়ার কথা। খেলার মাঠ আর বাড়ির পুকুর ঘাটের কথা। বললেন সে সময় স্কুলে লেখাপড়ার সাথে সাথে উচ্চ লাফ ও লম্বা লাফ প্রতিযোগিতা হতো। আমরা হয়তো কোনো স্বার্থ লাভের জন্য ১১/১২ বছর বয়সে দেশান্তরী হয়েছি।

এখনও মনে হয় কি যেনো এক অপরাধ করেছি। তার জন্য জ্বালা যন্ত্রণা তো ভোগ করতেই হয়েছে। এই শহরের প্রাণ সায়ের খাল ছিল বড় নদীর মতো। পিএন স্কুলের সামনে সড়ক ধারে ছিল সারিবদ্ধ বকুল গাছ। এখানে রোজ এক মৌলভী সাহেব আসতেন। তিনি কি যেনো কেনাবেচা করতেন। প্রতিদিন তাকে দেখতাম গরুর গাড়িতে। প্রাণ সায়ের খাল ধারে বাস করতেন কোর্টের মোক্তাররা। স্মৃতিকথা উচ্চারণ করতে গিয়ে তিনি বললেন এখানে ছিলেন একজন মোয়াজ্জেম ডাক্তার। তিনি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। এখন সে গ্রাম পাল্টে গেছে। কোন রাস্তা কোথায় ছিল , কোথায় আমার স্বজনের বসত ছিল সবই যেনো ওলটপালট হয়ে গেছে।

সান্ধ্যকালীন এই কৌলিন আড্ডায় শামিল হয়েছিলেন তালা কলারোয়া আসনের সংসদ সদস্য এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। তিনি বলেন মনোজ মিত্রের সাথে এই আড্ডা আলাপ শেষ নয়। আমরা আবারও বৃহৎ কলেবরে আড্ডা জমাবো তার সাথে । সেদিন জানবো তার অভিনয় সম্পর্কে, নাট্যজগত সম্পর্কে । জানবো এবং শিখবো নাট্য রচনা ও অভিনয়ের শত কৌশল।

এজন্য আগামি শীত মৌসুমে আরও একটি আড্ডা আলাপনের আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি বলেন, মনোজ মিত্রর মতো বিজ্ঞজনরা যদি বাংলাদেশের মাটিতে থাকতেন তাহলে এদেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মাথা উঁচু করতে পারতো না।

মনোজ মিত্রের স্মৃতিচারণে উঠে আসে বাংলাদেশের নাট্যকার মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দ্বীন, সৈয়দ শামসুল হক, রামেন্দ্র মজুমদার , ফেরদৌসী মজুমদার এর কথা। ভারতীয় সিরিয়াল গুলিতে যে চর্চা হচ্ছে তা কতোটা গ্রহনযোগ্য এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এর প্রতিবাদ করতে হবে। যেটুকু সম্ভব তা আদায় করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বিভূতি ভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সিরিয়াল ‘ আদর্শ হিন্দু হোটেল’ তুলে ধরেন। কলকাতার প্রকৃতি ও পরিবেশ আপনার চাহিদা মেটাতে পারে কিনা এবং এ কারণেই কি আপনার লেখার মধ্যে বারবার বাংলাদেশ বিশেষ করে আপনার জন্মভিটার কথা উঠে আসে এমন প্রশ্নের জবাবে এই বিশিষ্টজন বলেন মনের চাহিদা এবং আপন অনুভূতির প্রকাশ তো এভাবেই হয়। কোনো গন্ডির মধ্যে তো সে থাকতে চায় না। প্রখ্যাত এই নাট্যকার এ প্রসঙ্গে তার নিজের নাট্যসৃষ্টি পরবাস, দর্পণে শরৎ শশী, বাঞ্ছারামের বাগান, মৃত্যুর চোখে জলসহ বিভিন্ন নাটকের কথা তুলে ধরেন।

স্মৃতি চারণকালে উঠে আসে তিনি ১৯৩৮ এর ২২ ডিসেম্বর ধুলিহর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫০ এর দিকে তিনি দেশ ত্যাগ করেন তার পরিবারের সাথে। মনোজ মিত্র ১৯৫৫ তে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৫৭ তে কলকাতায় মঞ্চ নাটকে অংশ নেন তিনি। ১৯৭৯ তে চলচ্চিত্রে পা রাখেন মনোজ মিত্র।

তিনি ছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রধান। এর আগে তিনি বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭২ সালে তার নিজের নাটক ‘চাকভাঙ্গা মধু’ মঞ্চস্থ হয়। শতাধিক নাটকের লেখক মনোজ মিত্র তার শিল্পকর্মের জন্য বহুবার পুরস্কৃত হয়েছেন। তার ভাষায় ‘ আমি অভিনেতা, আমি মানুষের মনের কথা বলতে ভয় পাই না’।

শিল্প সংস্কৃতি নাট্যকলার এই প্রবীন ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার শতায়ূ কামনা করেন তার জন্মভূমি সাতক্ষীরার মানুষ।

শুক্রবারের এই আড্ডায় আরও শামিল হয়ে নিজেদের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন সহোদর অমর মিত্র, অধ্যাপক সৌমিত্র বসুসহ অনেকেই।

(আরকে/এসপি/জুন ২২, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test