E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষকের প্রেমের সম্পর্কের জের : কলেজ ছাত্রকে লোহার রড ও হাতুড়িপেটা

২০২০ মে ০১ ১৮:৩৪:৫৯
ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষকের প্রেমের সম্পর্কের জের : কলেজ ছাত্রকে লোহার রড ও হাতুড়িপেটা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : মোবাইল ফোনে বাড়িতে ডেকে নিয়ে আটক রাখার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের এক কলেজ ছাত্রকে লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। ছেলেকে রক্ষায় এগিয়ে গেলে মাকেও হাতুড়ি পেটা করা হয়েছে। বিষয়টি কাউকে জানাজানি করা হলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার ভোরে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্যাংদহা গ্রামে এ ঘটনা ঘটার পর সদর হাসপাতালে যেয়েও সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না ওই কলেজ ছাত্র।

ব্যাংদহা গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র দাস জানান, তার ছেলে উত্তম দাস (২৬) সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক অনার্স চুড়ান্ত বর্ষের ছাত্র। একই পাড়ার গণি শেখের অষ্টম শ্রেণী পড়–য়া শিরিনা খাতুনকে উত্তম প্রাইভেট পড়াতো। গাভা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে চলতি বছরে নবম শ্রেণীতে ওঠার পর মেয়েটি উত্তমের কাছে আর পড়তো না। দু’ মাস আগে গণি শেখ তার মেয়েকে উত্তর ফিংড়ির মোজাইক টাইলস মিস্ত্রী মোমিনের সঙ্গে বিয়ে দেয়।

নারায়ণ দাস অভিযোগ করে বলেন, গত মঙ্গলবার ভোর তিনটার দিকে শিরিনার মোবাইল থেকে উত্তমকে ডেকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় গণি শেখ ও তার ছেলে জামালউদ্দিন শেখ। শিরিনাকে মোবাইলে কেন বিরক্ত করা হয় এমন কথা বলতে বলতে উত্তমকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে আটক রেখে তাকে লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। চিৎকার শুনে সেহেরী খেতে ওঠা পাশের বাড়ির আজমারুল ইসলাম ও তার স্ত্রী যেয়ে উত্তমকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।

একপর্যায়ে গণি শেখের দু’ ছেলে জনি, জামালউদ্দিন ও জামালউদ্দিনের স্ত্রী যেয়ে তাকে ও তার স্ত্রী চন্দনা দাসকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। এ সময় দূর থেকে উত্তমকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চন্দনা তার ছেলের অপরাধ কি তা জানতে চাইলে জামাল বলে যে, তার বাবা সুদের ব্যবসা করে। ডাকাতি করতে এলে উত্তমকে ধরে তারা পিটুনি দিয়েছে। চন্দনা ছেলের জীবন ভিক্ষা চায় গণি ও জামালের কাছে। এ সময় তাকেও হাতুড়িপেটা করা হয়। মারা হয় কিল চড় ও ঘুষি। বেগতিক বুঝে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে তার কাছে দু’বিঘা জমি ও দু’ লাখ টাকা দাবি করে গণি শেখ ও তার ছেলেরা।

উত্তমকে মেরে না ফেলে ছেড়ে দেওয়ার জন্য শিরিনা বাবা ও ভাইদের পায়ে ধরে। ব্যর্থ হওয়ায় শিরিনা পাশের ঘরে যেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে গণি শেখের ছেলেরা বুঝতে পেরে দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে। ছেলেকে ফিরিয়ে নিতে হলে তাকে (নারায়ণ) কয়েকটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সাক্ষর করতে ও দু’ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। একপর্যায়ে আজমারুলের উপস্থিতিতে গরু বিক্রির ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা ও প্রতিবেশি এক মহিলার কাছ থেকে ৫০০ টাকা সুদে নিয়ে মোট ৫০ হাজার টাকা গণি শেখকে দেওয়ার পর একটি সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে নিয়ে উত্তমকে তার কাছে দেওয়া হয়। বিষয়টি কাউকে জানালে বা হাসপাতালে উত্তমকে ভর্তি করলে খুন করার হুমকি দেয় জামাল। ভোর চারটার দিকে উত্তমকে বাড়িতে আনা হয়। সকালে স্থানীয় ডাক্তার সুমল দাস না আসায় দেবব্রত মিত্রকে ডেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে বিষয়টি দু’এজনকে জানানোর পর বুধবার সকালে উত্তমকে মুমুর্ষ অবস্থায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু উত্তমের শরীরের অবস্থার অবনতি না হলেও বৃহষ্পতিবার তার ছাড়পত্র দিয়ে দেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ জাহাঙ্গীর হোসেন। কাছে টাকা না থাকায় নিরুপায় হয়ে উত্তমকে বাড়িতে নেওয়া হয়। রাতে আবারো অবস্থার চরম অবনতি হওয়ায় উত্তমকে শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে এলে তাকে ভর্তি না নিয়ে একটি বহিঃবিভাগের টিকিটে ব্যবস্থাপত্র লিখে বাড়ি যেতে বলা হয়। বাধ্য হয়ে সদর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠণিক সম্পাদক অজয় কুমার দাসসহ কয়েকজনের সহায়তায় বণ্ড দিয়ে চায়না বাংলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

স্থানীয়রা জানান, গণি শেখ যশোরের বাসিন্দা ছিলেন। সেখান থেকে কয়েক বছর আগে ব্যাংদহা শেখপাড়ায় বসবাস করতেন। সাত বছর আগে বিকাশ সরদারের কাছ থেকে ১২ শতক জমি কিনে বর্তমান স্থানে বসবাস শুরু করেন। গণির ছেলে জামালউদ্দিন মিলে ধান ও চাউলের ব্যবসার পাশপাশি ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি করে থাকে। সে ব্যাংদহা এলাকার লাল্টু বাহিনীর সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। লাল্টু আত্মগোপনে থাকায় জামাল ওই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জামালের বিরুদ্ধে স্ন্দুরবনে ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে।

জোড়দিয়া গ্রামের রেজাউল ইসলাম ও দক্ষিণ ফিংড়ির সিদ্ধার্থ সানার বাড়িতে ডাকাতিসহ এলাকার বিভিন্ন চুরি, পথচারীদের কাছ থেকে মোবাইল ছিনতাইসহ বিভিন্ন ঘটনার নেতৃত্বে দেয় জামাল। ২০১৩ সালে জামালের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ রয়েছে। উত্তমের ঘটনায় কেউ মুখ খুললে পরিণতি ভাল হবে না বলে ব্যাংদহা বাজারে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে জামাল। বিষয়টি নিয়ে বৃহষ্পতিবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সামছুজ্জামানের কাছে গেলে তিনি মামলা মোকদ্দমা না করে স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য আগমি রোববার বসাবসির কথা বলেছেন।

জানতে চাইলে চায়না বাংলা হাসপাতালে ৪০১ নং শয্যায় চিকিৎসাধীন উত্তম দাসের চিকিৎসক ডাঃ আরিফ আহম্মেদ জানান, উত্তমের দু’ হাঁটু, দু’ কাঁধ, পিঠ, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন রয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এ ব্যাপারে শুক্রবার বিকেলে গণি শেখের সঙ্গে মোবাইলে কথা বললে তিনি বলেন, প্রাইভেট পড়ানোর সময় তার মেয়ে শিরিনার সঙ্গে উত্তমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নাবালিকা হওয়ার পরও দু’ মাস আগে উত্তর ফিংড়ি গ্রামের মোজাইক টাইলস এর মিস্ত্রী মোমিনের সঙ্গে শিরিনার বিয়ে দেওয়া হয়। এরপরও পূর্বে একসঙ্গে তোলা ছবি নিয়ে ব্লাকমেইল করার চেষ্টা করে উত্তম। গত ২৬ এপ্রিল শিরিনা বাপের বাড়িতে এসে তাকে বিষয়টি জানায়।

একপর্যায়ে মঙ্গলবার ভোর তিনটার দিকে সেহেরীর সময় জানালায় টোকা দিয়ে মেয়ের ঘরে ঢোকে উত্তম। মেয়ে চিৎকার করায় উত্তমকে ধরে মারপিট করা হয়। ছেলেকে চেয়ারম্যান বা পুলিশে না দেওয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে একটি সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে উত্তমকে তার বাবা ও মায়ের কাছে দেওয়া হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় ওই ৫০ হাজার টাকা বৃহষ্পতিবার রাতে ব্যাংদহা বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম হোসেনের কাছে দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইলতুৎ মিশ বৃহষ্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগ পেলে মামলা নিয়ে আসামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(আরকে/এসপি/মে ০১, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test