E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হামলার ভয়ে যেতে পারছেন না এলাকার বাইরে 

আলমগীর বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট তালার মাদরা গ্রামের সংখ্যালঘুরা

২০২০ জুন ১৩ ১১:৫৫:২১
আলমগীর বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট তালার মাদরা গ্রামের সংখ্যালঘুরা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আলমগীর হোসেন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মাদরা গ্রামের সংখ্যালঘুরা। প্রতিরোধ গড়ে তোলায় নতুন করে হামলার ভয়ে এলাকার বাইরে যেতে পারছে না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ি, চাকুরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা। 

সরেজমিনে শুক্রবার সকালে তালা উপজেলার মাদরা গ্রামের খোবরাখালিতে গেলে ঠাকুরদাস রায়, মাধব সরকারসহ কয়েকজন জানান, বালিয়াদহের হোসেন আলী গাজী কলাগাছির একান্ত বাছাড়ের কাছ থেকে ১০ কাঠা জমি কিনে দু’ ছেলে আলমগীর ও জাহাঙ্গীরকে নিয়ে ১৯৮০ সাল থেকে তাদের গ্রামে বসবাস শুরু করেন। আলমগীর এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে বহিরাগত সন্ত্রাসীসহ টিকেরামপুর সরদার বাড়ির লোকজনদের বাড়িতে আশ্রয় দিতো।

২০০৬ সালে দলুয়া বাজারের মাছের সেটে বোমা হামলায় নিহত রবীন ও জাহাঙ্গীরকে বোমা মেরে হত্যা মামলার অন্যতম আসামী দোহার গ্রামের আসাদুল সরদার গ্রেপ্তার হন আলমগীর হোসেনের বাড়ি থেকে । চরমপন্থি বিদ্যুৎ বাহিনী প্রধানের সঙ্গে সখ্যতা ছিল আলমগীরের। খোবরাখালি গ্রামের কল্যাণ মণ্ডলের স্ত্রীকে নির্যাতন করে তার গর্ভস্ত সন্তানকে মেরে ফেলার অভিযোগ রয়েছে আলমগীরের বিরুদ্ধে। বিশ্বনাথ মণ্ডলের ছেলে অজিত মণ্ডলকে মারপিট ও নিমাই মণ্ডলের ছাগল মেরে ফেলার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় শালিস মানেন না আলমগীর।

পারুল মণ্ডল জানান, গত মার্চের শেষের দিকে খেতে ছাগল যাওয়া নিয়ে আলমগীরের সঙ্গে তার বচসা হলে দায়ের কোপে তার বাম হাত জখম করে আলমগীর। করোনার কারণে পুলিশ মামলা নেয়নি। লাউকাটি গ্রামে আলমগীরের চাচা শ্বশুর ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাব্বির হোসেনের সহায়তা চান। সে অনুযায়ি কল্যান মণ্ডলের বাড়িতে শালিস হলেও সিদ্ধান্ত মানেনি আলমগীর।

নির্যাতনের শিকার খোবরাখালি গ্রামের বাড়িতে শয্যাশায়ী রবিন মণ্ডল বলেন, তিনি দলুয়া বাজাওে গৌর মণ্ডলের জলের ফিল্টারের মিলে কাজ করেন। গত ৬ জুন আলমগীরসহ টিকেরামপুর সরদার বাড়ির রুবেল, তুহিন, শাহীনুর, সজীব, মীম, শান্ত ও বারানগরের সবুজসহ কয়েকজন তাকে ও তার ছেলে অলোককে জীবননাশের হুমকি দেয়। বিষয়টি উপজেলা ওয়ার্কার্স পার্টিও নোত হিরন্ময় মণ্ডলকে জানালে তিনি বিষয়টি প্রতিবাদ করলে তাকেও কয়েকটি মোবাইল ফোন থেকে হুমকি দেওয়া হয়। পরদিন তাকে ওইসব সন্ত্রাসীরা কারখানায় ঢুকে মারতে যায়।

রবিন মণ্ডলের স্ত্রী সরলা মণ্ডল বলেন, গত মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আলমগীরের নেতৃত্বে ২০/২৫ জনের একদল দুর্বৃত্ত হাতে লোহার রড, চাইনিজ কুড়াল, দা ও লাঠি নিয়ে ১৪টি মোটর সাইকেলে তাদের পাড়ায় ঢোকার সময় মাদরা শ্মশানের পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে থাকা শান্ত, কুমারেশ ও সুমনকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে জখম করে। এরপর তাদের পাড়ায় এসে গালিগালাজ ও ভাঙচুর শুরু করলে বাড়ির পুরুষদের ঘরের মধ্যে আটকে রেখে মহিলারা ঝাঁটা ও লাঠি হাতে হামলাকারিদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন।

হামলাকারীদের লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়লে কয়েকটি মোটর সাইকেলের গ্লাস ভেঙে যায়। হামলাকারিরা পারুল. অজিত মণ্ডল, তার স্ত্রী ও মাকে পিটিয়ে জখম করে। ভাঙচুর করে তাদের কয়েকটি বাড়ি। খরর পেয়ে মাদরা বাজারের পার্শ্ববর্তী লোকজন ছুঁটে এলে হামলাকারিরা আলমগীর ও জাহাঙ্গীরের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। শালিখা নদী সাঁতার দিয়ে পালানোর সময় এএসআই জাকিরের নেতৃত্বে পুলিশ এসে কয়েকজনকে আটক করে। পরে তালা ও পাটকেলঘাটার থানার অতিরিক্ত পুলিশ এসে হামলাকারিদের উদ্ধার করে ছেড়ে দেয়।

রবিন মণ্ডল জানান, মুক্তি পাওয়া সন্ত্রাসীরা মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে দলুয়া বাজরে যেয়ে তাকে গৌরপদ মণ্ডলের ওয়াটার প্লান্টের মধ্য থেকে বের করে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করে। রাস্তার উপর পড়ে থাকা স্টোন চীপের উপর দিয়ে তাকে টেনে হিচড়ে রক্তাক্ত সঙ্গাহীন অবস্থায় মৃতভেবে ফেলে রেখে চলে যায় তারা। স্থানীয়রা ও পুলিশ এসে রবিনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর থেকে মাদরা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ি, চাকুরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা এলাকার বাইরে যেতে পারছেন না।

মাদরা গ্রামের ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালক ধ্যানেশ রায়, মৃণাল গাইন ও অনুপম সরকার জানান, বুধবার সকালে তারা আশাশুনির কাদাকাটি তেকে মাছ কিনে বাড়ি আসছিলেন। পথিমধ্যে দলুয়া বাজারে আলমগীরের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা তাদের মারপিট করে আটক রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে।

মাদরা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হোমিও চিকিৎসক মাদরা গ্রামের ডাঃ অরুন গাইন বলেন, খোবরাখালি গ্রামে হামলা ও পাল্টা হামলার পর থেকে তাদেরকে বাজারে যেতে নিষেধ করেছেন আলমগীর ও তার লোকজন। ফলে হোমিও চিকিৎসক রবীন বিশ্বাস, বস্ত্র ব্যবসায়ী মিহির মণ্ডল, হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী বিমল মণ্ডলসহ কয়েকজন দোকান খুলতে পারেননি। এমনকি শুক্রবার বার্ষিক হালখাতা করতে পারেননি মিহির ও বিমল। বৃহষ্পতিবার রবিন ফিস এ মাছ কিনতে গেলে প্রশান্ত বিশ্বাসকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। জাত তুলে গালিগালাজ করা হয়।

বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটকেলঘাটা রোডের কাটাখালিতে ব্যারিকেড বসিয়ে মাদরা গ্রামের ইঞ্জিনভ্যান চালক, মোটর ভ্যান চালক, ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালক, চাকুরীজীবী, শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে তাদেরকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।

জানতে চাইলে আলমগীর হোসেন বলেন, খোবরাখালি গ্রামে হিন্দুপাড়ায় তারা দু’ ভাই ও এক বোন বসবাস করেন। ছাগল ও গরুতে ফসল খাওয়া নিয়ে কথা বরলেই শুরু হয় গণ্ডগোল। এ নিয়ে গত তিন মাস তিনি খুব অশান্তিতে আছেন। গত মঙ্গলবার সকালে মাধব যেয়ে বিকেলে শালিস আছে বলে তাকে বলে আসে। তার পক্ষে দলুয়ার আনারুল ভাই, ও বালিয়াদহের কয়েকজন কয়েকটি মোটর সাইকেলে তাদের গ্রামে আসে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মধাব, সুকুমার, অলোকসহ কয়েকজন তার পক্ষের লোকজনদের উপর হামলা চালিয়ে মোটর সাইকেল ভাঙচুর করে। অবরুদ্ধ করে রাখা কয়েকজনকে পুলিশ উদ্ধার করে। রাত ৮টার দিকে মুক্তি পাওয়া ওইসব লোকজন রবীন মণ্ডলকে মারপিট করেছে বলে তিনি শুনেছেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় রাত ১০টার দিকে তার(আলমগীর) বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। মারপিট করা হয় ভাবী আনোয়ারাকে। বর্তমানে তিনি এলাকায় যেতে পারছেন না।

পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মুর্শিদ জানান, ডিআইজি সাহেবের সাতক্ষীরায় আসা উপলক্ষ্যে তারা ব্যস্ত ছিলেন। শুক্রবার আবারো হামলা হতে পারে এমন খবর পেয়ে তদন্ত ওসির নেতৃত্বে দলুয়া বাজারে পুলিশ পাঠানো হয়। পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। খুব শ্রীঘ্র উভয় পক্ষকে নিয়ে বসাবসির মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হবে।

(আরকে/এসপি/জুন ১৩, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test