E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইউএনও ওয়াহিদাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে!

২০২০ সেপ্টেম্বর ১৮ ১২:৫৪:০০
ইউএনও ওয়াহিদাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে!

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : ইউএনওকে হত্যা প্রচেষ্টার মুল পরিকল্পনাকারী বা হামলাকারীকে এ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ধ্রুমজাল। সাধারণ মানুষ এখনো বুঝে উঠতে পারছে না ঘটনা’র মুল নায়ক কে ? ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা, আটক, স্বীকারোক্তি, আদালতে সোর্পদ্দ, রিমান্ড সব কিছু যেনো সিনেমার গল্প’কেও হার মানিয়েছে। 

ইউএন ওয়াহেদা খানমকে হত্যা প্রচেস্টা মামলায় ৬ দিনের রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার মামলার অন্যতম আসামী ইউএনও’র বাড়ির সাময়িক বরখাস্ত মালি রবিউল ইসলামকে আদালতের মাধ্যমে আরো ৩ দিনের রিমান্ড নিয়েছে, পুলিশ।

কড়া নিরাপত্তা মধ্যে বৃহস্পতিবার সাড়ে ১১টায় দিনাজপুর আদালতে হেলমেন্ড পরিয়ে রবিউল ইসলামকে নিয়ে আসে পুলিশ। আসামী রবিউল ইসলামকে পুলিশ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দিতে বললে রবিউল অপারগতা জানায়। পরে ৬ ঘন্টা পর পুলিশ বিকেল সাড়ে ৫ টায় সিনিয়র জুডিশিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রিট আদালতের বিচারক আনজুমান আরার আদালতে রবিউলকে হাজির করে আরো ৭ দিনের রিমান্ড চায়। অদালতের বিচার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

দিনাজপুর কোর্ট পরিদর্শক ইসরাইল হোসেন জানান,ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা হত্যার প্রচেষ্টা মামলার অন্যতম রবিউল ইসলাম আদালতে ১৬৪ জবান বন্দি অপারগতা জালালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরো ৭ দিনের রিমান্ড চাষ। আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।

এদিকে পুলিশ বলছে, ক্ষোভ থেকে এই মিশনের সুচনা। এ ঘটনা সাময়িক বরখাস্তকৃত মালি রবিউল ইসলাম ঘটিয়েছে।
অন্যদিকে রবিউল ইসলামের স্বীকারোক্তি জোরপূর্বক নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। একইসঙ্গে স্থানীয়দের দাবি, একটি মহলকে আড়াল করতেই রবিউলকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। তাই এ মামলাটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি মাধ্যমে তদন্তের দাবী তুলেছেন তারা।

এদিকে ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা প্রচেষ্টা ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম শতভাগ সফল বলে জানিয়েছেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের চৌকষ ওসি ইমাম আবু জাফর।

তিনি জানান, জিজ্ঞাসাবাদ,আলামত উদ্ধার এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী রবিউল ইসলামেই একমাত্র আসামি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ইতিপূর্বে ৩ আসামীকে রিমান্ড এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে তদন্ত করেও যখন ক্লু পাওয়া যাচ্ছিল না,তখন সামনে আসে রবিউল ইসলামের সাময়িক বহিষ্কারের বিষয়টি। এরপর রবিউলকে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এক পর্যায়ে একটি মোবাইল নম্বর হাতে আসে, যেটিতে দিনাজপুরের বিরল থেকে ঘোড়াঘাট যাওয়ার লোকেশন দেখাচ্ছিল। নম্বরটি রবিউলের কিনা নিশ্চিত হতে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রবিউলের স্ত্রী বারবার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও মোবাইল নম্বরের কথা বলতেই তিনি থমকে যান। পরে বিভিন্ন উপায়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে রবিউলই সেদিন ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর রাত সোটা একটায় নিজ বাড়ি থেকে রবিউলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে রবিউল স্বীকার করে যে হামলার সঙ্গে সে জড়িত। জিজ্ঞাসাবাদে কোথায় কতক্ষণ ছিল সব তথ্য দিয়েছে রবিউল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে রবিউলের কথার মিল রয়েছে।

আইন শৃংখলা বাহিনী’র দায়িত্বপ্রাপ্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদক শাহ্ আলম শাহী’র কাছে এই ঘটনা বর্ণনা দিয়েছে। বিরবণের ঘটনা সত্য হলে তা সিনেমার গল্প’কেও হার মানিয়েছে।
যা ঘটেছিলো সেদিনঃ

২ সেপ্টেম্বর।বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউনিয়নের ধামাহার ভীরপুর নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে সকালেই বাই-সাইকেল যোগে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যায় রবিউল ইসলাম। সেখানে কাজ শেষ করে বেলা ১১টার দিকে শহরের ষষ্টিতলা মোড়ে মুরাদের সেলুনে যায়। সেখানে দীর্ঘ সময় সে মোবাইলে গেম খেলে। দুপুর দেড়টার দিকে মুরাদের কাছে ১০০ টাকা ধার চায় রবিউল। কিন্তু,মুরাদ টাকা দেয়নি টাকা ধার। রবিউল এ সময় বিশেষ কাজে বাইরে যাবে তাই,মুরাদকে তার দোকানে সাইকেলটা রাখার কথা বলে। মুরাদ তার দোকানে সাইকেল রাখার ব্যবস্থা নেই, জানিয়ে সাইকেল রাখতে বলে পাশের আইনুলের গ্যারেজে। রবিউল এ সময় সাইকেল নিয়ে আইনুলের গ্যারেজে রাখে। আইনুল সাইকেল রাখার জন্য দিনে ১০ টাকা ও রাতে ১৫ টাকা দিতে হবে জানালে রবিউলকে। রবিউল তাতে রাজি হয়। বিকাল ৩টার দিকে শহরের ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে যায় রবিউল।

ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে রবিউল তৃপ্তি পরিবহনে উঠে ঘোড়াঘাট রানীগঞ্জ বাজার বাসস্ট্যান্ডে নামে। সেখান থেকে ওসমানপুর উপজেলা চত্বরের বাইরে রাত ১টা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করে। পরে পুরাতন মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়াল টপকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রবেশ করে।

রাত ১ টা ১৯ মিনিটে রবিউল গার্ডরুমের সামনে দারোয়ান আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করে। এরপর উপজেলার সরকারি কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে ইউএনও’র বাসভবনের পশ্চিম দিকের দেয়াল টপকে বাসভবন চত্বরে প্রবেশ করে। সেখানে কিছুক্ষণ বাসভবন পর্যবেক্ষণ করার পর রাত ১টা ৪৬ মিনিটে বাসভবনের পেছনের কবুতরের ঘরের দিক থেকে একটি মই হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসে। ২টা ২ মিনিটে সে একটি হাতুড়িসহ গোলঘরে গিয়ে একটি চেয়ার নিয়ে যায়। চেয়ার ও মই দিয়ে সে বাসভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।প্রথম দফায় দ্বিতীয় তলায় উঠতে ব্যর্থ হয়ে চেয়ার ও মই রেখে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২টা ৩৬ মিনিটে রবিউল খালি হাতে গোলঘরের দিকে গিয়ে আবার ফেরত এসে বাসভবনের বাইরের সিকিউরিটি লাইট বন্ধ করে দেয়।

সিসিটিভি ক্যামেরায় রাত ৩টা ২৯ মিনিটে সে আবার আমগাছের নিচ থেকে মই ও ব্যাগ নিয়ে ইউএনও’র বাসভবনে যায়।ব্যর্থ হয়ে চলে যেতে উদ্যত হওয়ার সময় তার মনে হয় দ্বিতীয় তলায় ওঠার কেচি গেটের চাবি বাসার সিকিউরিটি গার্ড পলাশের কাছে থাকতে পারে। এজন্য সে গার্ডরুমে গিয়ে পলাশকে নাক ডেকে ঘুমাতে দেখে। গার্ডরুম থেকে সে একটি তালা ও কিছু চাবি নিয়ে প্রথমে বাইরে থেকে গার্ডরুম তালাবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু,কেচি গেট খুলতে না পেরে গার্ডরুমের সামনে থেকে টুল নিয়ে যায়। চেয়ার ও টুল একসঙ্গে করে মই বেয়ে সে দ্বিতীয় দফায় ইউএনও’র বাসভবনের দ্বিতীয় তলার বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।

বাথরুমে ঢোকার পর সে বুঝতে পারে বেডরুমের ভেতর থেকে বাথরুমের ছিটকিনি আটকা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ধাক্কা দিয়ে সে ছিটকিনি ভেঙে বেডরুমে প্রবেশ করে। এরমধ্যে শব্দ পেয়ে ইউএনও তার বাবাকে ডাক দেন। বলে“ দেখোতো বাবা রুমে কোন বেয়াদ্দব ডুকেকে !”রবিউল সঙ্গে সঙ্গে ইউএনও’র মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। ইউএনও ওয়াহিদা অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তার বাবা সেখানে আসেন। রবিউল তাকেও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে মেঝেতে ফেলে দেয়। রবিউল ইউএনও’র বাবার কাছে আলমারির চাবি চায়। চাবি না দিলে তার নাতিকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ইউএনও’র বাবা ওমর আলী তার নাতিকে না মেরে ঘরে যা আছে নিয়ে যেতে বলেন।

ইউএনওর বাসায় নগদ টাকা রয়েছে এ বিষয়ে ধারণা ছিল রবিউলের। কিন্তু সে একটা চাবি পেয়ে আলমারি খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে ওয়্যারড্রোবের ওপরে রাখা ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা ৫০ হাজার টাকার একটি বান্ডিল নেয়। এ সময় ফজরের নামাজের আজান শুরু হলে রবিউল দ্রুত ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। রাত ৪টা ৩১ মিনিটে মই ও ব্যাগ নিয়ে আম গাছের দিকে যায় রবিউল। রাত ৪টা ৪০ মিনিটে উপজেলার মেইন গেটে যায়। যাওয়ার সময় ইউএনও’র বাসভবন ও অন্য কোয়ার্টারের মাঝখানে এক গোছা চাবি ফেলে যায় রবিউল।ইউএনও’র বাসা থেকে বের হয়ে সে নতুন ভূমি অফিস সংলগ্ন পুকুরে হাতুড়িটি ফেলে দেয়। হেঁটে হেঁটে সে ঘোড়াঘাট টিএন্ডটি মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

এ সময় হানিফ পরিবহনের ঢাকাগামী একটি বাস এলে তাতে উঠে বিরামপুরে গিয়ে নামে। বিরামপুর শহরের ঢাকা মোড়ের একটি গলিতে গিয়ে একটি গাছের নিচে হাতে থাকা লাল প্লাস্টিকের ব্যাগ ও ব্যাগে থাকা লাল শার্ট, লাল গামছা, মাংকি ক্যাপ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। বিরামপুর বাজারে গিয়ে একটি হোটেলে ৩০ টাকা দিয়ে খিচুড়ি খায়। পরে সেখান থেকে একটি পিকাপে করে দিনাজপুর শহরে যায়। যষ্টীতলার আইনুলের গ্যারেজ থেকে সাইকেল নিয়ে সোজা চলে যায় বিরলের নিজ বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে গোসল করে ভাত খেয়ে সাইকেল নিয়ে আবারও দিনাজপুরে ডিসি কার্যালয়ে যায়। পরে গোর-এ শহীদ ময়দানের পাশে কালেক্টরেট স্কুলের সামনে গিয়ে খোকন নামে একজনকে ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা দেয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খোকনের কাছ থেকে ওই টাকা উদ্ধার করেছেন। খোকন, সেলুন মালিক মুরাদ ও গ্যারেজ মালিক আইনুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও রবিউলের স্বীকারোক্তির সঙ্গে মিল পেয়েছেন। তিন জনকেই এই মামলার সাক্ষী করা হয়েছে।

সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইসমাইল হোসেনের আদালতে ১৬৪ ধারায় খোকনের সাক্ষ্য রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া গত মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আঞ্জুমান আরা বেগমের আদালতে মুরাদ ও আইনুলের সাক্ষ্য রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া ইউএনওকে হামলায় ব্যবহৃত হাতুড়িটি পুকুর থেকে উদ্ধারের পর জব্দ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন শৃংখলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর ক্ষোভ থেকে হামলা ও টাকা চুরি করার পরিকল্পনা করেছিল রবিউল। ২০০৮ সালে রবিউল দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফরাশ (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) হিসেবে যোগ দেয়। ২০১১ সালের ২৪ মে থেকে সে জেলা প্রশাসকের বাসভবনে মালি হিসেবে কাজ করে। গত বছরের ডিসেম্বরে তাকে ঘোড়াঘাট উপজেলায় বদলি করা হয়। সেখানেও মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতো রবিউল। রবিউল মূলতঃ গত কয়েক বছর ধরে ক্রিকেটসহ অনলাইনে জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে কয়েক লাখ টাকা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। রবিউলের দাবি করে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি সে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ১৬ হাজার টাকা চুরি করেছিল। বিষয়টি ধরা পড়ার পর ইউএনওকে সে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। যাতে তার চাকরি নিয়ে কোনও সমস্যা না হয়। ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ইউএনও তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না বলে কথা জানিয়েছিলেন।কিন্তু, ১৫ জানুয়ারি ইউএনও টাকা চুরির বিষয়টি উল্লেখ করে রবিউলের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা দায়েরের পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। রবিউলের দাবি, এ কারণেই সে ইউএনও’র ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। ক্ষোভ থেকেই সে পরিকল্পনা করে হামলা ও টাকা চুরি করতে যায়।

আলমারিতে ছিলো ৪০ লাখ টাকা

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের বাসায় নগদ প্রায় ৪০ লাখ টাকা ছিল। ছিল স্বর্ণালঙ্কারও। কিন্তু হামলাকারী রবিউল ইসলাম নিয়ে যায় মাত্র ৫০ হাজার টাকা। বাকি টাকা আলমারিতে থাকায় রবিউল নিতে পারেনি। খোয়া যায়নি স্বর্ণালঙ্কারও।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহানুর রহমানের উপস্থিতিতে ঘোড়াঘাট থানার ওসি আজিম উদ্দিন,পরিদর্শক (তদন্ত) মমিনুল ইসলাম ও মামলার বাদী ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ উদ্দিন মিলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইউএনও’র বাসার আলমারি খুলে দেখেন সেখানে রাখা নগদ প্রায় ৩৫ লাখ টাকা, পাঁচ হাজার ইউএস ডলার, স্বর্ণালঙ্কার, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও জমা রসিদ এবং জমির দলির সব অক্ষত রয়েছে। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে নগদ টাকা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মামলার বাদী ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ উদ্দিনের হেফাজতে দিয়ে দেন।
ঘোড়াঘাট থানার ওসি আজিম উদ্দিন বলেন, ‘বাসা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা ছিল,তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভাই মামলার বাদী নিয়ে গেছেন। এগুলো যেহেতু মামলার কোনও আলামত নয়, ফলে এসব নিয়ে আমাদের কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’

সেদিন ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বাড়ির কাছের একটি স্থানে ১০ মিনিট অতিবাহিত করেছিল রবিউল। এর কারণ হিসেবে সে জানায়, তার প্যান্টে কাঁটা তারে আটকে গিয়েছিল। ফুটেজে দেখা গেছে- তার হাতে লাঠি ছিল। কিন্তু হামলা করেছে হাতুড়ি দিয়ে, তাহলে লাঠি ছিল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, রাস্তায় গভীর রাতে কয়েকটি কুকুর থাকে। কুকুরের আক্রমণ থেকে বাঁচতেই সে লাঠি নিয়েছিল। গভীর রাতে ঘোড়াঘাটের ওই রাস্তায় গিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আসলেই সেখানে কয়েকটি কুকুর থাকে। এমনি তথ্য জানিয়েছেন,ওই আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা।

জোরপূর্বক জবানবন্দী

এদিকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে হত্যা চেষ্টা মামলায় গেস্খফতারকৃত রবিউলের স্বীকারোক্তি জোরপূর্বক নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। একইসঙ্গে স্থানীয়দের দাবি, একটি মহলকে আড়াল করতেই রবিউলকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। তাই এ মামলায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি দাবী করেছেন তারা।

রবিউলের পরিবারের অভিযোগ, ৯ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ রবিউলকে এবং পরদিন রবিউলের স্ত্রী, ভাই, ও মাকে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। পরদিন তাদের ছেড়ে দেয়। ডিবি পুলিশ তাদের উপর বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপ প্রয়োগ করে ইউএনওকে হত্যার চেষ্টা করেছে, এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। পরিবারের সদস্যরা স্বীকারোক্তি দিলে রবিউলকে ছেড়ে দিবে বলে ডিবি পুলিশ জানায় রবিউলের পরিবারের লোকজন।

স্থানীয় কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, দুই তারিখ রাতে তারা রবিউলের সাথে মাগরিবের নামাজ, এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ আদায় করেছে। রবিউল কোনো সংগঠন কোরে না। মেশেও না যার তার সাথে। ২ সেপ্টেম্বর রাতে ও পরদিন সকালেও তারা রবিউলকে গ্রামে দেখেছেন। তাই.তাদের দাবী, মামলাটি সাজানো।

স্থানীয় ৭ নং বিজোড়া ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন জানান, এই ছেলে (রবিউল) এ ধরনের কাজ করতে পারে না। প্রায় ৩৬ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদে মোম্বার ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে রবিউলের পরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে একটিও অভিযোগও পাইনি। তারা ভালো মানুষ। জানিনা, কেনো রবিউলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ।

অন্যদিকে মামলার চৌকষ তদন্তকারী কর্মকর্তা দিনাজপুর ডিবির ওসি ইমাম জাফর জানান, যারা বলছে, এলাকায় ছিল। বলুক। আমরা বলছি, রবিউল ঘোড়াঘাট গিয়েছিল। রবিউলের শুধু মুখের কথা নয়,আমাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ বিষয়ে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও বলেন, ঘটনার দিন রবিউল সেখানে ছিল। তার সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।

প্রসঙ্গতঃ ২ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)ওয়াহিদা খানম এবং তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের উপর হামলা করে হত্যার প্রচেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আহত দু'জনকেই রংপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে ইউএনও ওয়াহিদাকে এয়ার এম্বুল্যান্স করে নেয়া হয় ঢাকার নিউরোসাইন্স মেডিকেল হাসপাতালে। এর পর জরুরি ভিত্তিতে করা হয় অস্ত্রোপচার। এখনো তিনি সেখানে চিকিৎসকধীন। তিনি,সুস্থ্য আছেন, বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

এ ঘটনায় ঘোড়াঘাট থানা যুবলীগের বহিস্কৃত আহবায়ক জাহাঙ্গীল আলম,যুবলীগ নেতা আসাদুল, রংমিস্ত্রি নবীরুল,সান্টু,নৈশ্য প্রহরী পলাশসহ কমপক্ষে ৩০ জনকে আটক করা হয়। পরে ৪ সেপ্টেম্বর র‌্যাব-১৩ সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিং এ ইউএনওর উপর হামলার ঘটনা নিছক চুরির ঘটনা থেকে হয়েছে। চুরি’র ঘটনা দেখে ফেলায় অন্যতম আসামী আসাদুল এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তার স্বীকারোক্তি মতো ঘটনার সময় পরিহিত লাল রংগের টিশার্ট উদ্ধার এবং জড়িত আরো দু’জন নবীরুল এবং সান্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও র‌্যাব প্রেস ব্রিফিং এ জানায়। মামলাটি পরে ডিবি পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। এই মামলায় আসামী আসাদুল,নবীরুল ও সান্টুকে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে প্রত্যোককে ৭ দিনের বিমান্ড নেয়।

এ ঘটনায় ঘোড়াঘাট থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.আমিরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
অবশেষে ১২ সেপ্টেম্বর মামলারটি অন্যদিকে মোড় নেয়, রংপুর পুলিশের ডিআইজি দেবদাস ভট্রাচার্যের এক প্রেস ব্রিফিং এর মধ্যেমে। তিনি জানান, এ মামলার মূল আসামী ইউএনও’ন বাসার মালি রবিউল ইসলাম। রবিউল তা স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তাই, তাকে রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। পরে এই মামলার অন্যতম আসামী রবিউলের ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।

ইউএন ওয়াহেদা খানমকে হত্যা প্রচেস্টা মামলায় ৬ দিনের রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার,মামলার অন্যতম আসামী ইউএনও’র বাড়ির সাময়িক বরখাস্ত মালি রবিউল ইসলামকে আদালতের মাধ্যমে আরো ৩ দিনের রিমান্ড নিয়েছে পুলিশ। কড়া নিরাপত্তা মধ্যে বৃহস্পতিবার সাড়ে ১১টায় দিনাজপুর আদালতে হেলমেন্ড পরিয়ে রবিউল ইসলামকে নিয়ে আসে পুলিশ। আসামী রবিউল ইসলামকে পুলিশ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দিতে বললে রবিউল অপারগতা জানায়। পরে ৬ ঘন্টা পর পুলিশ বিকেল সাড়ে ৫ টায় সিনিয়র জুডিশিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রিট আদালতের বিচারক আনজুমান আরার আদালতে রবিউলকে হাজির করে আরো ৭ দিনের রিমান্ড চায়। অদালতের বিচার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এভাবেই গল্প এগিয়ে চলছে। তা সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে।

(এস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test