E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাগুরার শ্রীকোল ইউনিয়ন মৃত্যুপুরী

২০২০ অক্টোবর ১০ ১৮:০৮:৪৬
মাগুরার শ্রীকোল ইউনিয়ন মৃত্যুপুরী

দীপক চক্রবর্তী, মাগুরা :  একের পর এক  গ্রামীণ কাইজা বা সংঘর্ষে খুন, ভাংচুর আর লুটপাটে অসহায় হয়ে এক প্রকার জিম্মি জীবনযাপন করছেন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শ্রীকোল ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ। সামান্য ঘটনা নিয়েই এ ইউনিয়নের গ্রামগুলিতে প্রতিনিয়ত মানুষ জড়িয়ে পড়ছেন প্রাণঘাতি সংঘর্ষে।  ফলে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে পুরো এলাকাটি।  

চলতি বছরেই করোনা চলাকালিন সময়েও এ এলাকায় অন্তত দশটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দুপক্ষের সংঘর্ষে দরিবিলা গ্রামে মশিয়ার রহমান (৪৫) নামে এক ব্যক্তি খুনসহ অন্তত ২০জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যে ঘটনার পর হামলা, লুটপাট ও ভাংচুরের ঘটনায় লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। সাম্প্রতিক সময়ে এ ইউনিয়নে অসংখ্য কাইজার ঘটনায় অন্তত ৫টি খুন হয়েছে । কিন্তু কোন ঘটনারই সঠিক তদন্ত ও সুষ্ঠ বিচার না হওয়ায় এ অবস্থা চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উপরন্তু এসব ঘটনায় লাভবান হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণী।

সরেজমিনে দরিবিলা গ্রামে নিহত মশিয়ার এর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনার ৪দিন পরও নিহতের পরিবারে শোকের মাতম একটুও কমেনি। সাংবাদিকদের দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিহতের স্ত্রী লতিফা বেগম ও পরিবারের সদস্যরা। তার পরিবারের সদস্যরা দাবী করেন তারা রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সমর্থক হলেও গ্রাম্য সামাজিক দলে স্থানীয় আওয়ামীলীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান মুতাসসিম বিল্লাহ সংগ্রামের সমর্থক তারা। দীর্ঘদিন তাদের উপর নানা অত্যাচার হয়ে আসলেও ওইসব ঘটনার জন্য তারা পূর্ববর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া হামলা ভাংচুরের ঘটনায় কোন বিচার না পাওয়াকেই দায়ী করেন।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রীকোল ইউনিয়নের দরিবিলা, দাইরপোল এলাকা যেন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এক পরিত্যাক্ত জনপদ। হামলা মামলার ভয়ে গ্রামগুলি পুরুষশূণ্য হয়ে পড়ায় বাড়িগুলিতে নারী ও শিশুরা নিরাপত্তা হীনতায় ভূগছেন। ঘটনার পর এ গ্রামের তহুর মিয়ার বাড়ি থেকে প্রকাশ্যে পানির মটর ও টিউবয়েল খুলে নিয়ে গেছে লুটকারিরা। ওই সময় দরিবিলা গ্রামের শওকত ও মুন্তা বিশ্বাসের গরুর খামার থেকে ৩১ টি গরু, পার্শ্ববর্তী দাইরপোল গ্রামের মুক্তার এর ২টি, শহীদ এর ১টি, শিমুলের ২টি, বিল্লাল এর ২টি, মুক্তার ১টি, শহীদ শেখের ৩টি, মোহন শিকদারের ২টি গরুসহ অসংখ্য গৃহপালিত প্রাণি লুট করে নিয়ে গেছে মধ্যযুগীয় কায়দায়।

খুনের ঘটনার পরপরই প্রতিপক্ষ দরিবিলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গোলাম রসুল, বাহার মিয়া, মতিয়ার রহমান, আলিম, শিহাব বিশ্বাস, আমফান, চঞ্চল, ইসলাম মোল্যা, কফিল, কালু মোল্যা, হুমায়ুন মোল্যাসহ শতাধিক বাড়ি ভাংচুর এর ঘটনা ঘটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভূক্তভোগী জানান পার্শ্ববর্তী পূর্ব শ্রীকোল গ্রামের কুদু ডাকাত, রজীন, সজল, ডাবলু, লাভলু ও দাইরপোল গ্রামের জাহিদ, হারিদ, জামাল, রাসেল, বাসিদ, সাগর, তানসেন, সোহাদ, সাহাদ, সুবানেসহ ২০/ ২২ জনের একটি দল সংঘবদ্ধ হয়ে এ গ্রামগুলিতে লুটপাট চালিয়েছে।

একাধিক ভূক্তভোগীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, মূলত প্রতিটি হামলা ভাংচুর কিংবা হতাহতে ঘটনার পরই এ এলাকায় লুটতরাজ এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। এরফলে এলাকার নারী ও শিশুসহ সাধারণ মানুষ সব সময় আতংকের মধ্যে থাকে। সেই সঙ্গে প্রতিটি ঘটনার পরই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিরীহ ও এলাকার বাইরে থাকা মানুষদেরও মামলায় আসামী করা হয়।

অন্যদিকে লুটের মাল বিক্রি করে মামলার খরচ চালানো হয়। এর ফলে বিচারের পর্যায়ে গিয়ে মামলাগুলি স্বাক্ষ প্রমাণের অভাবে প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পায় না। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবারের ঘটনায় স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গোলাম রসুলের নাম মামলার ১ নং ও জেলার বাইরে কুষ্টিয়ায় সরকারি চাকরির দায়িত্বে থাকা মোঃ রনিকে মামলার ২ নং আসামীসহ একই পরিবারের ১০ জনকে আসামী করায় হত্যাকান্ডের ঘটনাটি এখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতের পরিবারের কায়েকজন সদস্য। যে কারণে মামলার বাদী হিসেবে নিহতের স্ত্রীকে না দিয়ে নিহতের একজন মামাতো ভাইকে রাখা হয়েছে। তাদের মতে মূলত এর ফলে লাভবান হবে এলাকার মাতব্বররা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হবে স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ নিহত মশিউরের পরিবার।

স্থানীয় রাজনৈতিক আধিপত্য ও সামাজিক দলাদলী নিয়ে শ্রীকোল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মুতাসিম বিল্লাহ সংগ্রাম ও সাবেক চেয়ারম্যান কুতুবুল্লাহ হোসেন কুটির সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এ বিরোধ চলে আসছে। যে বিরোধের কারণে সামান্য ঘটনা নিয়ে ওই ইউনিয়নে গত ১০ বছরে সংঘর্ষে জড়িয়ে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু, অসংখ্য আহত, কয়েক হাজার বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রান চান এলাকাবাসী।

এ ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী আহমেদ মাসুদ।

শ্রীকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুতাসসিম বিল্লাহ জানান- গ্রামীণ সংঘর্ষ এড়াতে বেশ কয়েকবার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা করেছি। কিন্তু গ্রাম্য দলাদলির কারণে সমস্যাগুলি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। অপর গ্রুপের নেতা কুতুবুল্লাহ হোসেন মিয়া আমেরিকা প্রবাসী হওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

(ডিসি/এসপি/অক্টোবর ১০, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test