E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্কুলছাত্র হৃদয় হত্যা : আটকের পরও আসামি হননি কেউ, মেলেনি মুক্তি

২০২০ অক্টোবর ১১ ১৩:১১:২৫
স্কুলছাত্র হৃদয় হত্যা : আটকের পরও আসামি হননি কেউ, মেলেনি মুক্তি

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের ঝিটকি গ্রামের তৃতীয় শ্রেণীর স্কুল ছাত্র হৃদয় মণ্ডলকে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের পিতা ভ্যান চালক বিকাশ মণ্ডল বাদি হয়ে কারো নাম উল্লেখ না করে শুক্রবার রাতেই থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

এদিকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুক্রবার দুপুর ১২টায় আটককৃত ছয় জনের মধ্যে ঝিকরা গ্রামের ইসমাইল হোসেন, তার স্ত্রী মারিফা, তাদের ছেলে শিশু আল আমিন, শিশু আল মাসুদ ও কওছার আলীর ছেলে আলমগীর হোসেনকে ৩৪ ঘণ্টায়ও মুক্তি দেওয়া হয়নি বা গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়নি। একইভাবে নিহতের চাচাত ভাই তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র সৌম্যক মণ্ডলকে শুক্রবার রাত ৯টায় আটক করার ২৪ ঘণ্টায়ও মুক্তি দেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাকে সন্ধিগ্ধ হিসেবে আটক রেখে স্বজনদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য অভিভাবকের সাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পুলিশ। তবে ঝিটকা গ্রামের আব্দুর রশিদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আশাশুনি উপজেলা সদরের আব্দুল জলিলের ছেলে আল আমিনকে শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় থানা থেকে মুক্তি পেয়েছে।

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আটককৃতদের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে বৃহষ্পতিবার বিকেলে ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে তার ছেলে আল আমিন ও মাসুদের সঙ্গে খেলাধুলার একপর্যায়ে হৃদয়ের সঙ্গে বিরোধ হয়। এ বিরোধের একপর্যায়ে মাসুদ ও আল আমিন এর আঘাতে হৃদয় মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় হৃদয়কে দু’ ভাই মাটিতে চেপে ধরার একপর্যায়ে সে মারা যায়। বিষয়টি তাদের মা মারিফা জানার পরও প্রশাসন বা কাউকে না জানিয়ে লাশ গোপন করার চেষ্টা করে। পরিকল্পিতভাবে শুক্রবার সকালে শামুক কুড়ানোর গল্প করে হৃদয়ের লাশ দেখার গল্প লোকের কাছে বলে মারিফা। এরপর পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

সূত্রটি আরো জানান, ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় বাবা বিকাশ মণ্ডল বাদি হয়ে শুক্রবার রাতে কারো নাম উল্লেখ না করেই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় হৃদয়কে হত্যার ঘটনায় ইসমাইল হোসেনের পরিবার ও একই গ্রামের আলমগীর হোসেনের উপর সন্দেহের কথা উল্লেখ করা হয়। খেলাধুলার একপর্যায়ে মারপিট করলে ও মাটিতে চেপে ধরলে হৃদয় মারা যায় বলে আল আমিন ও তার সহোদর মাসুদ পুলিশের কাছে স্বীকার করে। এ ছাড়া মা মারিফা বাড়িতে এলে তাকে ঘটনা জানায় বলে দু’ সন্তান পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়। সে অনুযায়ি হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আল আমিন ও তার ভাই মাসুদকে গ্রেপ্তার এবং বিষয়টি জানার পরওে পুলিশকে না জানিয়ে তথ্য গোপন করার অভিযোগে মারিফাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার বিকেলে তিনজনকে আদালতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া আটককৃত সৌম্যক মণ্ডলসহ চারজনকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শনিবার রাত ৯টায় সূত্রটি আরো জানায়, আল আমিন ও আল মাসুদ শিশু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ এর আদেশ অনুযায়ি কার জিম্মায় রাখা হবে বা কোন নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠানো হবে কিনা তা নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় জেলা ও দায়রা জজ বিষয়টি দেখার জন্য সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বললেও আইনগত জটিলতা দেখা দেওয়ায় তিনি দায়িত্ব নিতে রাজী হননি।

একপর্যায়ে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রবেশন অফিসারকে শিশুদের জিম্মায় দেওয়ার কথা বলা হলেও ওই কর্মকর্তা সুমনা শারমিন আদালতের লিখিত নির্দেশ ছাড়া তাদেরকে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আব্দুর রশিদের ভাড়াটিয়া আল আমিনকে মুক্তি দিলেও ইসমাইল হোসেন, তার স্ত্রী মারিফা ও আলমগীর হোসেনের ভাগ্যে আটকের ৩৪ ঘণ্টা পরও কারাগার বা মুক্তি কেন জোটেনি তার সদুত্তর দিতে পারেননি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান।

এদিকে হৃদয় হত্যা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক তোহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সৌম্যককে তারা নতুন গেঞ্জি ও প্যান্ট কিনে দিয়েছেন। ক্যাটব্যারিসসহ খাওয়াচ্ছেন বিরানী। এখন সে আর থানা থেকে বাড়ি যেতে চায় না। এরপরপরই তিনি নিজের মোবাইলে ধারণকৃত সৌম্যক মণ্ডলের একটি সাক্ষাৎকার শোনান। তাতে নিহত ভাই হৃদয়ের মৃত্যুর পর তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় সে বডি ধরাধরি করেছিল বলে জানিয়েছে।

এদিকে বিকাশ মণ্ডল জানান, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে থানা ভারপ্র“াপ্ত কর্মকর্তা পূর্ব থেকে লিখে রাখা একটি এজাহারে সাক্ষর করতে বলেন। তাকে ভাইপো সৌম্যককে ২ নং আসামী হিসেবে উল্লেখ করা ছিল। তিনি তাতে সাক্ষর না করে তাদের(বিকাশ) উপস্থাপিত এজাহারটি সাক্ষর করে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়ে চলে আসেন।
অরুপ কুমার মণ্ডল বলেন, শুক্রবার রাত ৯টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সৌম্যককে হৃদয় হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সেজন্য পরিবারের সদস্যদের যে কোন সময় ডাকলে তাদের উপস্থিতিতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মর্মে একটি টাইপ করা কাগজে শনিবার বিকেল ৫টায় তাকে সাক্ষর করতে বলেন থানার সেকেণ্ড অফিসার হাবিবুর রহমান। তাতে সৌম্যক আসামী না ফরিয়াদি তা উল্লেখ না থাকায় পুলিশের চালাকি বুঝতে পেরে তিনি সাক্ষর করেননি। সৌম্যককে এজাহারভুক্ত আসামী করতে না পেরে পুলিশ নতুন কৌশলে তাকে আসামী করতে চেয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তবে উপপপরিদর্শক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি উর্দ্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ি সৌম্যকের ব্যাপারে লিখিত কাগজে তার অভিভাবককে সাক্ষর করতে বলেছিলেন।

সাতক্ষীরা আদালতের পুলিশ পরিদর্শক অমল কুমার রায় বলেন, বিকাশ মণ্ডলের দায়েরকৃত হত্যা মামলাটি শনিবার বিকেলে আদালতে পাঠানো হলেও কোন আসামীকে শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়নি।

হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. সত্যরঞ্জন মণ্ডল বলেন, তিন শিশুসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানা হেফাজতে রাখা ন্যয় বিচার ও আইনের পরিপন্থি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন আটককৃত ব্যক্তিকে আদালতে সোপর্দ বা মুক্তি না দিলে সেজন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামানের সঙ্গে শনিবার রাত ৯টায় কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি।

তবে উপপরিদর্শক সন্ধ্যা রানী সাহা শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, কিছুক্ষণ আগে আল আমিন ও আল মাসুদকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন অফিসার সুমনা শারমিনের মাধ্যমে সাতক্ষীরা সদর হামসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মাসহ দু’ শিশুকে আসামী হিসেবে রোববার আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

প্রসঙ্গত, বৃহষ্পতিবার বিকেলে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝিটকি গ্রামের ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে পেরেক কিনতে যায় একই গ্রামের বিকাশ মণ্ডলের ছেলে ঝিটকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র হৃদয় মণ্ডল ও তার কাকাত ভাই সৌমিক মণ্ডল। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সৌমিক ফিরে এলেও ফেরেনি হৃদয়। মসজিদ ও মন্দির থেকে করা হয় মাইকিং।

একপর্যায়ে শুক্রবার সকালে ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী মারিফার দেখা মতে তাদের বাড়ির পাশে নূর মোহাম্মদের ধান ক্ষেত থেকে পুলিশ হৃদয়ের লাশ উদ্ধার করে। এ এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুক্রবার ঝিটকি গ্রামের ইসমাইল হোসেন, তার স্ত্রী মাফিয়া, তাদের দু’ ছেলে আল আমিন ও মাসুদ, একই গ্রামের কওছার আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন, সুকুমার মণ্ডলের ছেলে সৌমিক মণ্ডল ও একই গ্রামের আব্দুর রশিদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আশাশুনি উপজেলা সদরের আব্দুল জলিলের ছেলে আল আমিনকে পুলিশ আটক করে।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ১১, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test