E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘পুলিশ কাকু হৃদয়কে মেরে ফেলার কথা বলতে বলেছে’

২০২০ অক্টোবর ১৩ ১৮:০৮:২১
‘পুলিশ কাকু হৃদয়কে মেরে ফেলার কথা বলতে বলেছে’

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : “বৃহষ্পতিবার রাত ন’টায় প্যান্ট পরা ও খালি গায়ে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি। এ সময় পুলিশ আমার বাবা ও মাকে দিয়ে ডেকে তোলে। কিছু ক্থা জিজ্ঞাসা করবে বলে পুলিশ কাকুরা আমাকে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে মোড় এনে গাড়িতে তোলে। এ সময় আমার জ্যেঠু গামছা গায়ে গাড়িতে ওঠার কথা বললেও পুলিশ কাকুরা জ্যেঠুকে উঠতে দেয়নি। আমাকে নতুন গেঞ্জি ও প্যাণ্ট কিনে দিয়েছে। চকলেট ও ভাল, মাছ ও মাংস ভাত খাইয়েছে। সাদা জামা পরা পুলিশ কাকু কাকাত ভাই হৃদয়কে মেরে ফেলার কথা বলতে বলেছে। কিভাবে মেরে ফেলা হয়েছে সে সম্পর্কে একটি গল্প তাকে বলে দেওয়া হয়েছে। কোর্টে তার কথা মত বললে পরে আমাকে আরো খাবার, জুতো, হাতঘড়িসহ বিভিন্ন নতুন জিনিস কিনে দেবে বলেছে। এক পুলিশ কাকু গেঞ্জি কিনে আনলেও সাদা জামা পরা সেই পুলিশ কাকু তার নতুন গেঞ্জি পরিয়ে দেয়। থানায় নিয়ে গেলে বা ছবি দেখালে ওই সাদা জামা পরা পুলিশ কাকুকে চিনতে পারবো আমি।”
মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে সাতক্ষীরা সমাজসেবা অফিসের প্রবেশন অফিসার সুমনা শারমিন ও মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝিটকি গ্রামের নিহত হৃদয় মণ্ডলের বাড়িতে গেলে পুলিশের বানানো হত্যা মামলার প্রধান আসামী ঝিটকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র সৌমিক মণ্ডল এমনিভাবেই কথা বলে।

সুমনা শারমিনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সৌমিক বলে, বৃহষ্পতিবার বিকেল চারটায় প্রসেনজিৎ সরকারের কাছ থেকে প্রাইভেট পড়ে সে বাড়ি ফেরে। বাজি ফাটানোর জন্য সে তাদের গ্রামের ইসমাইলের ছেলে একই স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র মাসুদ রানার বাড়িতে যায়। সেখানে যেয়ে মাসুদ ও তার (সৌমকি) কাকার ছেলে হৃদয়কে বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে। এ সময় মাসুদের হাতে একটি মোটর লাগানো ছোট ফ্যান দেখেছিল। কয়েক মিনিট পর ঘর থেকে দু’টি পেরেক বের করে তার হাতে দিলে সে চলে আসে।

বাড়িতে এসে সে পুকুরে ছিপ দিয়ে একটি পুঁটি মাছ ধরে হাঁসকে খাওয়ায়। সন্ধা শুরুর আগেই প্রসেনজিৎ স্যারের বাড়িতে পড়তে যায় সে। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর কাকা বিকাশ মণ্ডল ছেলে হৃদয় কোথায় জানতে তার কাছে যায়। এ সময় হৃদয়কে বিকেলে মাসুদের বাড়িতে বসে থাকতে দেখার কথা বলে। শুক্রবার সকালে হৃদয় মারা যাওয়ার খবর পেয়ে মায়ের সাথে মাসুদের বাড়ির সামনে রাস্তায় উপর দাঁড়িয়ে ছিল সে। কয়েকজন বলেছিল ধানক্ষেতের মধ্যে উপুড় হয়ে জলের মধ্যে ভেসে আছে হৃদয়। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জামা খোলা ও প্যাণ্ট পরা অবস্থায় পুলিশ কাকুরা তাকে থানায় নিয়ে যায়।

সাদা জামা পরা পুলিশ কাকুৃ তাকে ভাই হৃদয়কে মারপিট করে পুকুরের জলে ফেলে মাথা চেপে ধরার কথা শিখিয়ে দেয়। পরে হৃদয়ের লাশ টানতে টানতে ধান ক্ষেতে নিয়ে যাওয়ার কথা ও বলে দেয় ওই সাদা জামা পরা কাকু। বাড়িতে এসে সে তার ভিজা প্যাণ্ট খুলে শুকনো প্যান্ট পরেছে বলে বলতে বলে। কাকুর শেখানো কথা সব জায়গায় বলার জন্য বলা হয়। শেখানো কথা সব বলতে পারলে তাকে থানায় রেখে দেওয়া হবে বলে জানায় ওই পুলিশ কাকু।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে মাসুদ রানার বাড়িতে নিয়ে এলে সুমনা শারমিনের সঙ্গে বৃহষ্পতিবার বিকেলে এ বাড়িতে হৃদয় ও মাসুদ কোথায় বসে ছিল তা দেখায় সৌমিক। কোন ঘর থেকে দু’টি পেরেক এনে দেয় মাসুদ তাও দেখায় সে। ১২ অক্টোবর সোমবার বিকেলে পুলিশ কাকুরা এসে তাকে হৃদয়ের লাশ কোন স্থানে পড়ে ছিল তা দেখিয়ে দেয়।

এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও সাতক্ষীরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন অফিসার সুমনা শারমিনের কাছে অভিযোগ করে নিহত হৃদয়ের বাবা, সৌমিকের বাবা, মা ও জ্যাঠা মহাশয় বলেন, পুলিশ মাসুদ পরিবারকে বাঁচাতে,সৌমিককে পরিকল্পিতভাবে ফাসিয়েছে। তারা হত্যার প্রকৃত ঘটনার ক্লু উদঘাটনে পিবিআই, সিআইডি বা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ঘরে থানা লকআপে রাখা বেআইনি বিধায় মাসুদ রানা, মারিফা ও মৌমিককে কোন কারণ ছাড়াই তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন অফিসার সুমনা শারমিন বলেন, মাসুদ রানা ও তার মা মারিফাকে জিজ্ঞাসা করলে তারা হৃদয় হত্যার ব্যাপারে মুখ খোলেনি তার কাছে। অথচ সৌমিক তার কাছে যে সব কথা বলেছিল সেকথা সৌমিক বলতে পারছে না। পুলিশ সৌমিককে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার পরদিন তার কাছে যে বক্তব্য ও ভিডিও চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিণ। হৃদয় হত্যার সঙ্গে সৌমিককে জড়ানোর আরো নেপথ্য জানতে হবে। কোন পুলিশ কাকু তাকে হৃদয়কে মারার কথা শিখিয়েছে সেটাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত বৃহষ্পতিবার বিকেলে একই গ্রাম ঝিটকির পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মাসুদ রানার বাড়িতে এসে আর নিজ বাড়িতে ফেরেনি ঝিটকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র হৃদয় মণ্ডল। পরদিন সকালে নূর মোহাম্মদের ধান ক্ষেতে ভাসমান অবস্থায় লাশ দেখতে পায় মাসুদের মা মারিফা। সকাল ১১টায় পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ইসমাইল হোসেন, তার স্ত্রী মারিফা , বড় ছেলে আল আমিন, ছোট ছেলে মাসুদ রানা, পার্শ্ববর্তী আলমগীর হোসেন ও আব্দুর রশিদের ভাড়াটিয়া আল আমিনকে ধরে নিয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে সুকুমার মণ্ডলের ছেলে সৌমিককে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় শুক্রবার রাতেই বিকাশ মণ্ডল বাদি হয়ে কারো নাম উল্লেখ না করে থানায় মামলা করেন।

শনিবার বিকেলে পুলিশ মারিফা ও তার দু’ ছেলেকে আসামী হিসেবে আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়। উপপরিদর্শক হাবিবুর রহমান হৃদয় হত্যার ঘটনায় সৌম্যককে শুক্রবার রাত ৯টা থেকে পরদিন ৮টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এবং আবারো তাকে জিজ্ঞাসাবদের জন্য থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তাদেরকে আসা সম্পর্কিত একটি লিখিত কাগজে কাকা অনুপকে সাক্ষর করতে বলেন। তা না করায় রাত ৮টার দিকে সৌমিক, মাসুদ রানা ও তার মা মারিফাকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পরদিন তাদরেকে আদালতে উপস্থাপন করিয়ে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি করানো হয়। ওইদিন কিশোর আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান দু’ শিশুর জামিন দেন।

যদিও সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, সৌমিক ও মাসুদ রানার জবানবন্দি অনুযায়ি তাদেরকে আসামী করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়মের সূযোগ নেই।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ১৩, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test