E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মা-মেয়ে হত্যার মূল নায়ক কনস্টেবল আলিমের নামে অভিযোগপত্র প্রস্তুত

২০২০ অক্টোবর ১৮ ২২:১৭:০৭
মা-মেয়ে হত্যার মূল নায়ক কনস্টেবল আলিমের নামে অভিযোগপত্র প্রস্তুত

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : অবশেষে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের মুছা মিয়ার স্ত্রী রিপ্না খাতুন ও তার মেয়ে মুন্নি আক্তারকে হত্যা করে লাশ সাতক্ষীরার সীমান্ত নদী ইছামতী নদীতে ফেলে দেওয়া মামলার অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করতে যাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। একই গ্রামের পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে দু’ এক দিনের মধ্যে এ অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে আব্দুল আলিমের সঙ্গে একই গ্রামের অহিদুল ইসলামের মেয়ে রিপ্নার সঙ্গে ছাত্রজীবন থেকে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। রিপ্না যখন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল তখন আলিম দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়াশুনা করাকালিন দু’জনে পালিয়ে যায়। রাতেই তাদেরকে আটক করে শালিসের মাধ্যমে জরিমানা করে আলিমকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আত্মীয় মুছার সঙ্গে রিপ্নার বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর মুন্নি নামে তাদের একটি মেয়ে সন্তান হয়। রিপ্নার সঙ্গে আলিমের সম্পর্ক নেই বলে মনে করতো মুছা। একপর্যায়ে আলিম পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে চাকুরি পায়। তখন রিপ্নার সঙ্গে অবারো মোবাইলে সম্পর্ক গড়ে তোলে।

সূত্রটি আরো জানানয়, ২০১৮ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর নাম করে ব্রাক থেকে তোলা স্বামীর ৭২ হাজার টাকা ও সোনার গহনাসহ চার বছরের মেয়ে মুন্নিকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন আবু মুছার স্ত্রী রিপ্না খাতুন(২২)। ১২ ফেব্র“য়ারি দেবহাটার ইছামতী নদীর ছুটিপুর ও ১৪ ফেব্র“য়ারি কালিগঞ্জের ইছামতী নদীর বসন্তপুর থেকে যথাক্রমে মেয়ে মুন্নি আক্তার ও মা রিপ্না খাতুনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১২ ফেব্রুয়ারি শিশু কণ্যার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রাম পুলিশ ফজর আলী দেবহাটা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী ও ১৪ ফেব্র“য়ারি কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ইসরাফিল বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা (জিআর-২৫/১৮ কালি) দায়ের করেন। দু’টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে সাতক্ষীরার রসুলপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়। ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ডাক্তার দেখাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা স্ত্রী ও সন্তানকে না পেয়ে সাধারণ ডায়েরী করেন মুছা মিয়া।

এ সময় তিনি পুলিশকে জানান যে, সাড়ে পাঁচ বছর আগে রিপ্না খাতুনের সঙ্গে তার বিয়ে হলেও একই গ্রামের আলীমের সঙ্গে তার ভালভাসা ছিল। ফেইসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবি দেখে মুছা নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে চিনতে পেরে সাতক্ষীরায় এসে তার স্ত্রী ও মেয়েকে সনাক্ত করেন। এ ঘটনার জের ধরে ইতিপূর্বে কালিগঞ্জ থানায় কাজ করার সুবাদে পূর্ব পরিচিত কোন ব্যক্তির বাড়িতে এনে ধর্ষণের পর মা ও মেয়েকে হত্যা করে নদীতে ফেলে লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে লাশ সনাক্তকালে পুলিশকে অবহিত করেন মুছা। পরে লাশ নিজের বাড়িতে নিয়ে দাফন করার জন্য আদালতে মামলা করলেও মেয়ের লাশ উত্তোলনের অনুমতি পেলেও স্ত্রীর লাশ উত্তোলনের অনুমতি পাননি মুছা।

আবু মুছা জানান, স্ত্রী ও মেয়ের লাশ সনাক্ত করে বাড়ি ফিরে তিনি বিষয়টি মহেশপুর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বর্তমানে সাতক্ষীরা পিবিআইএর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লস্কর জায়াদুল হককে অবহিত করেন। আলিম ঢাকার গুলশানে ডিপ্লোম্রেট্রিক সিকিউরিটি বিভাগে (কং নং- ৯৫২৮) কর্মরত আছে বলে জানানো হয়। ঘটনার বর্ণনা জেনে লস্কর জায়াদুল হক কৌশলে আলিমকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে তার ছুটির সিসি যাঁচাই ও মোবাইল কললিষ্ট যাঁচাই করে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সুধাংশু শেখর হালদারের কাছে তুলে দেন। কালিগঞ্জ থানা আলিমকে ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠান। আদালত তাকে তিন দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করলেও জিজ্ঞাবাদে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য উদঘাটন করতে পারেননি সুধাংশু শেখর হালদার। জামিন পেয়ে আলিম নিহত রিপ্নার স্বজনদের বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিতে থাকেন। বাধ্য হয়ে রিপ্নার মা ঝিনাইদহ আদালতে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ১০৭ ধারায় মামলা করেন আব্দুল আলিম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।

মামলা চলকালিন ধার্য দিনে রিপ্নার মা, স্বামী ও দেবর সাতক্ষীরা কোর্টে এলে তাদের উপর হামলা চালান আলিম, তার মামা শ্বশুরসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় সদর থানায় মামলা ও অভিযোগপত্র দাখিল হয়। আগামি ১১ নভেম্বর এ মামলার সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য আছে। হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় রিপ্নার মা ও স্বজনরা কালিগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার ও খুলনা রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের সঙ্গে দেখা করেন। সংবাদ সস্মেলন করেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে।

কালিগঞ্জ থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সুধাংশু শেখর সরকার, সোহরাব হোসেন, পুলিশ পরিদর্শক রাজীব হোসেন ও আজিজুর রহমানের হাত ঘুরে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার পান গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম। তদন্তে নেমে তিনি যাদবপুর গ্রামের লিটন ও তার স্ত্রী বীথির বাড়িতে যাতায়াতের সূত্র ধরে বীথির বোন ঝালোকাটির রাজাপুর গ্রামের ও বর্তমানে যশোরে অবস্থানরত মরিয়মের সন্ধান পান। একই সাথে রিপ্না ও মরিয়মের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল আলিমের। মরিয়মের যশোরে বিয়ে হলেও স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে আলিমের সঙ্গে আবারও অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয় মরিয়মের। এরমধ্যে কালিগঞ্জে চাকুরি করাকালিন আলিম শ্যামনগরের নূরনগর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের সোমাকে বিয়ে করে।

সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম বলেন, মামলার তদন্তভার পেয়ে মরিয়মের খোঁজ পান তিনি। মরিয়মের সঙ্গে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হন যে আলিমই মা ও মেয়ের হত্যাকারি। সে অনুযায়ি তিনি গত ১৫ মার্চ মরিয়মকে সাক্ষী হিসেবে সাতক্ষীরার জ্যেষ্ট বিচারিক হাকিম ইয়াসমিন নাহারের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি করান। জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির ঢাকা থেকে পরিবহনে ফেরার সময় আলিম ও রিপ্না কি কথা বলেছিল তা জানা যায়। মরিয়ম আদালতে জবানবন্দি দেওয়ায় জীবন নাশের হুমকি দেয় আলিম। এ নিয়ে থানায় জিডি করেন মরিয়ম।

এসব তথ্য সংগ্রহ করে তিনি (জহিরুল) গত পহেলা জুলাই আলিমের জামিন বাতিল ও রিমাণ্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। ১২ জুলাই আলিমকে আদালতে আনা হয়। ২০ জুলাই জামিন বাতিল করে জ্যেষ্ট বিচারিক হাকিম বিলাস মণ্ডল আলিমকে দু’ দিনের রিমাণ্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। রিমাণ্ড শেষে ২২ জুলাই আলিম বিচারিক হাকিম বিলাস মণ্ডলের কাছে রিপ্না ও মুন্নিকে বাড়ি থেকে ডেকে আনা, সাতক্ষীরা পুলিশ লাইন, কালিগঞ্জের নলতা ওরসের শেষ দিনসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে। তবে সে হত্যার বিষয়টি এড়িয়ে যায়।

উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম বলেন, আব্দুল আলিমকে এক মাত্র আসামী করে মা ও মেয়ে হত্যা মামলা দায়েরের দু’ বছর আট মাস পরে দু’ এক দিনের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দিতে যাচ্ছেন তিনি। অভিযোগপত্রে ৫৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে যেভাবে ডেকে আনা হয়েছে সাতক্ষীরায় তা প্রাথমিকভাবে হত্যার জন্য আলিমই দায়ী বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ১৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test