E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গণধর্ষণ মামলা তুলে না নেয়ায় ধর্ষিতার ভাইকে অপহরণ করে নির্যাতন 

২০২০ নভেম্বর ১৮ ১২:৪৩:২৫
গণধর্ষণ মামলা তুলে না নেয়ায় ধর্ষিতার ভাইকে অপহরণ করে নির্যাতন 

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : মামলা তুলে না নেওয়ায় গণধর্ষিতার ভাইকে পুলিশ পরিচয়ে রাস্তা থেকে অপহরণের পর নির্যাতন চালিয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় বস্তাবন্ধি করে ফেলে রেখে গেছে প্রতিপক্ষরা। মঙ্গলবার দিবাগত রাত দু'টোর দিকে শ্যামনগরের সোয়ালিয়া ব্রীজ নাম স্থান থেকে ওই যুবকের হাত, পা ও মুখ বাঁধা বস্তা বন্দি অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে ফ্রেণ্ডশিপ হাসপাতাল ও পরে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় বুধবার সকাল ১১টার  দিকে তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, একটি জুতাসহ সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই যুবক (৩০) জানান, চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহের পর দীর্ঘ ১০ মাস সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হোসনে আরা আক্তার আদালতে না আসায় তার বোনের দায়েরকৃত মামলা(নাঃশিশু-৪৯/১৮) তুলে নেওয়ার জন্য আসামী ও তাদের স্বজনরা তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিল। সবশেষে প্রধান আসামী আবু বক্কর ছিদ্দিকের মেয়েকে দিয়ে ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে দেওয়া পরিকল্পিত ধর্ষণের মামলা(নাঃ শিশু-৬৬/১৯) গত বছরের ২১ জুলাই খারিজ হয়ে যায়। এতে ক্ষুব্ধ ছিল তার বোনের দায়েরকৃত মামলার আসামীরা।

এরই জের ধরে মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে অসুস্থ মায়ের জন্য ঔষধ কিনে ভ্যানযোগে যাদবপুর মোড়ে নামার পর তাকে তিনজন মাস্ক পরিহিত ব্যক্তি পুলিশ পরিচয়ে তার গতিরোধ করে। তারা একটি ব্যাগে থাকা কিছু জিনিসপত্র দেখতে বলার সময় পিছন দিক থেকে তাকে একজন লাথি মারে। পরে তার মুখ চেপে ধরে পার্শ্ববর্তী আজিবরের মিল ঘরের পিছনে বাগানে নিয়ে যায়। সেখানে একে একে চলে আসে বোনের দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলার আসামী গোলাম মোস্তফা, আবু বক্কর ছিদ্দিক ও সুকুমার মণ্ডল। গোলাম মোস্তফার হাতে থাকা ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে একে একে তার মুখ, দু’ হাত ও দু’ পা বেঁধে ফেলে নির্যাতন চালায়। তার গলায় দা ধরে বাম হাতের রিষ্ট জয়েন্টের কাছে পরপর দু’টি ইনজেকশান দেয়। এরপর কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলার পর তাকে একটি ইঞ্জিন চালিত গাড়িতে করে সোয়ালিয়া ব্রীজের পাশে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে দ্বিতীয় দফায় নির্যাতনের পর একটি বস্তায় ভরে ব্রীজের উপর নিয়ে যাওয়ার সময় দূর থেকে একটি পিকআপের আলো দেখতে পেয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।

খবর পেয়ে বোন, প্রতিবেশি সালাউদ্দিন, শেখ শাহজাহান, হারুণ অর রশীদ, মফিজুল ইসলাম, শাহীনুরসহ কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বেসরকারি হাসপাতাল ফ্রেণ্ডশিপ ও পরে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। বোনের দায়েরকৃত মামলায় নিশ্চিত শাস্তি জানতে পেরে পরিকল্পিতভাবে মামলার সাক্ষী হিসেবে তাকে আসামী ও তাদের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে অপহরণের পর হাত- পা ও মুখ বেঁধে নির্যাতনের পর বস্তাবন্দি করে হত্যার জন্য ফেলে রেখে গেছে বলে অভিযোগ করেন ওই যুবক।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক হাবিবুর রহমান জানান, ওই যুবকের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। গলায় কাপড় জািড়য়ে শা¦সরোধ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া শরীরে বিষাক্ত কোন তরল পুশ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। প্রসাব ও রক্ত পরীক্ষা না করা পর্যন্ত কি ধরণের তরল তা বলা যাবে না।

তবে জানতে চাইলে ধর্ষণ মামলার আসামী আবু বক্কর ছিদ্দিক, সুকুমার মণ্ডল ও গোলাম রসুল বলেন, এ ধরণের ঘটনা তাদের জানা নেই।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা জানান, পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শ্যামনগর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের খোকন মণ্ডলের ছেলে সুকুমার মণ্ডল ও দেবীপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক গোলাম রসুল একই এলাকার এক নারীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ফুলবাড়ি গ্রামের আব্দুল মোমিনের ছেলে আবু বক্কর ছিদ্দিকের ঘেরের বাসায় নিয়ে যায়। ওই দিন বহু প্রতিশ্র“তি দিয়ে হুজুর ডেকে ছিদ্দিকের সঙ্গে ওই নারীর কাল্পনিক বিয়ে পড়ানো হয়। স্বামী স্ত্রী হিসেবে সময় পার করার একপর্যায়ে ওই নারী দু’মাসের অন্তঃস্বত্বা হয়ে পড়লে ওই বছরের ১১ জুন সকালে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে খুলনায় একটি বাড়িতে আটক রাখা হয়। সেখানে পাঁচদিন যাবৎ ছিদ্দিক, সুকুমার ও গোলাম রসুল পালাক্রমে ধর্ষণ করে ওই নারীকে। ১৬ জুন রাইসা ক্লিনিকে ওই নারীর গর্ভপাত ঘটানো হয়।

পরে তাকে বিভিন্ন স্থানে রেখে ২৫ জুন ছিদ্দিকের বোন রোজিনার মাধ্যমে বাড়ির পাশে নিয়ে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। থানা মামলা না নেওয়ায় ওই বছরের ২৬ জুলাই ওই নারী বাদি হয়ে সাতক্ষীরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ওই তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা তুলে নেওয়ার হুমকির ঘটনায় ওই বছরের ৮ আগষ্ট ধর্ষিতা নারী আদালতে ১০৭ ধারায় তিন আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৮ আগষ্ট ও ২৫ অক্টোবর সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন করেন। আদালতের নির্দেশে থানা মামলা নিলেও আসামীদের দারা প্রভাবিত হয়ে তদন্তকারি কর্মকর্তা শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক লিটন মিঞা ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর আদালতে সকল আসামীদের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পুলিশের সোর্স বাধাঘাটার রেজাউলকে(বন্দুকযুদ্ধে নিহত) দিয়ে ধর্ষিতার ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ ও একটি মানবপাচারের মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। যা’ পরবর্তীতে খারিজ হয়ে যায়।

পুলিশের চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ওই নারী ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে না- রাজির আবেদন জানালে বিচারক তা আমলে নিয়ে করে তিন আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে আসামীদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০০০ সালের সংশোধিত ২০০৩ এর ৯(৩)/৩০ ধারায় অভিযোগ গঠণ করা হয়। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর রায় এর দিন ধার্য করেন। ওই দিন রায় না হওয়ায় পরদিন ধর্ষিতার বাড়ির জানালা ভেঙে লুটপাট করা হয়। আসামী আবু বক্কর ছিদ্দিকের মেয়েকে দিয়ে ধর্ষিতার ভাইয়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ধর্ষণ মামলাটি গত বছরের ২৮ নভেম্বর খারিজ হয়ে যায়। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ধর্ষিতার ভাইকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ০১৯২৪-৫৭৮২৬৪ নং মোবাইল ফোন এবং ১০ থেকে ১১ জানুয়ারি ০১৭৬৬-৩৪২২৬৮ নং মোবাইল থেকে কয়েকবার হুমকি দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন বিচারক না থাকায় ও বদলী জনিত কারণে গত ১৪ নভেম্বর গণধর্ষণের মামলার রায় হয়নি।

(আরকে/এসপি/নভেম্বর ১৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test