E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কলারোয়ায় মুজিববর্ষে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

২০২১ ফেব্রুয়ারি ২০ ১৯:২৩:৫১
কলারোয়ায় মুজিববর্ষে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : মুজিববর্ষে  প্রধানমন্ত্রির দেওয়া সাতক্ষীরার কলারোয়ায় গৃহহীনদের বাস গৃহ নির্মানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে।  নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে এক একটি  ঘরের জন্য বরাদ্দকৃত এক লাখ ৭১ হাজার টাকা অর্ধেকটাই লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

শুক্রবার সকালে কলারোয়া উপজেলার ইলিশপুর গ্রামে গেলে শেখ বেলাল হোসেন বলেন, প্রধান মন্ত্রির দেওয়া এক লাখ ৭১ হাজার টাকার গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে তার পাওয়া ঘরটি গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর শুরু হয়। প্রথমে যে ইট দেওয়া হয়েছিল তা যথেষ্ট নিম্মমানের হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একজনকে অনুরোধ করলে ওই ইট পরিবর্তণ করে অপেক্ষাকৃত ভাল ইট দেওয়া হয়েছে। ঘরের দেয়াল প্লাস্টার করতে স্থানীয় নদীর বালি ৬ ঝুড়ির সঙ্গে এক ঝুড়ি ফ্রেস সিমেন্ট মেশানো হয়েছে। ভিত করতে মাটির তলায় একটি ইট বসানোর কথা বললে তিনি এক ট্রলী বালি, এক ট্রলী খোয়া ও ছয় বস্তা সিমেন্ট কিনে দিয়েছেন।

ঘরের চাল করার জন্য মেহগণি গাছের দেড় বাই দু’ইঞ্জি ফুলা কাঠ ব্যবহার হওয়ায় মিস্ত্রী আব্দুস সালাম পড়ে মারা যেতে পারেন এমন আশঙ্কা করে ফিরে যান। ঠিকাদার রামকৃষ্ণপুরের সুভাষ সরকার শুক্রবার এক মিস্ত্রী নিয়ে এলে তিনিও ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বোধ করায় বাড়িতে থাকা নারিকেলের আড়ায় ভর করে তিনি চালে কাজ করেছেন। রোববার নিজ খরচে উপজেলা থেকে ঢেউ টিন আনার জন্য বলা হয়েছে। ঘরের দরজা, জানালা, মেঝে ও চাল কবে লাগানো হবে তা নিয়ে চিন্তিত তিনি। সব মিলিয়ে সরকারি বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও তার ঘর নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।

কেরালকাতা ইউনিয়নের দরবাসা গ্রামের গৃহহীন পরিবারর সদস্য মেহের আলীর স্ত্রী খুকুমনি জানান, তার ঘর প্লাস্তার করতে ১০ বস্তা বেঙ্গল সিমেন্টের সঙ্গে চার ট্রলি স্থানীয় বালি মেশানো হয়েছে। একই ইউনিয়নের ফাজিলকাটি গ্রামের মোহর আলী জানান, ভাটার চার নং ইট, নিম্ন মানের ১৫ বস্তা সিমেন্টের সাথে তিন ট্রলী স্থানীয় বালি ও নিম্ন মানের মেহগণি কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে তার ঘরে। ঠিকাদার তাকে টয়লেটের স্লাব ব্যক্তিগতভাবে কিনতে বলেছেন।

যেনতেন প্রকারে সামান্য আঘাত করলেই ঘরের প্লাস্তার খসে পড়ে ইটের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়বে। পুটুনী গ্রামের রবিউল ইসলামের স্ত্রী মনজুয়ারা খাতুন প্রধান মন্ত্রীর বরাদ্দকৃত ঘর উপহার হিসাবে পাওয়ায় শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তবে একটি ইটের উপর ভিত তৈরি করে নিম্ন মানের ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘর নির্মাণ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। চালের (ছাউনী)’র জন্য মেহগনি কাঠ ব্যবহার করার নির্দেশ থাকলেও তা উপেক্ষা করে নারিকেল গাছের চিকন অসারী কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় দুর্বল অবকাঠামো নির্মাণ হওয়ায় ঝড়ে উড়ে ঘর ভেঙে বড় ধরণের দুর্ঘটা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকারি বরাদ্দকৃত গৃহহীন মানুষের নির্মাণধীন ঘরের জন্য নায্য মূল্য ইট ক্রয়ের সরকারি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কলারায়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মৌসুমী জেরীন কান্তা ব্যক্তিগত স্বার্থে কৌশল অবলম্বন করে উপজেলায় অবস্থিত ১৯ টি ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে চাপ প্রয়োগ করে প্রতি ভাটা থেকে ৭ হাজার করে ইট গ্রহণ করেছেন। যারা ইট দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তাদেরকে বাধ্যতা মূলক নগদ ৫০ হাজার টাকার ইউএনওকে দিতে হয়েছে। কিছু কিছু ইট ভাটার মালিকের কাছ থেকে সু-কৌশলে নায্য মূল্য না দিয়ে বাধ্যতামূলক ভাটা থেকে ইট বহন মূল্যসহ হাজার প্রতি ছয় হাজার ২০০ টাকা করে ৫০ হাজার ইট ক্রয় করেছেন।

কলারোয়ার গাজী ভাটার ম্যানেজার উত্তম মণ্ডল জানান, কলারোয়ার ইউএনও সাহেব কম টাকায় ইট ক্রয় করেছে। লোকসান এড়াতে ভাটা গৃহনির্মানের হেড মিস্ত্রির সাথে যোগাযোগ করে কৌশলে এক হাজার ইট ১ নং দিয়ে ৫ হাজার ইট ৩নং দিয়েছেন। চালাকি যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য বাড়িতে ইট ফেলার পরপরই তড়িঘড়ি করে গেঁথে প্লাাস্তার করা হয়েছে।

ইট ভাটার মালিক আয়ুব আলী মেম্বর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন ইটের বাজার মূল্য বহনসহ হাজার প্রতি ৮ হাজার টাকা । আরেক ভাটা মালিক ফারুক হোসেন জানান, তার ভাটায় পর্যাপ্ত ইট তৈরি সম্ভব না হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাতে অফের॥যোগ্য ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নের ভাটা মালিক আলমগীর হোসেন জানান বিনা মূল্যে প্রথম কোটায় ছয় হাজার এবং পরে এক হাজার ইট দরবাসা গ্রামের মেহের আলীর বাড়ি ও তিন হাজার ইট ফাজিলকাটি জবেদার বাড়িতে দিয়েছেন। অন্যত্র দিতে হয়েছে এক হাজার ইট।

বিনা টাকায় আর কত পারা যায়? না দিলে অভিযান চলবে। কেরালকাতা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে অবস্থিত রয়েট ভাটার মালিক কবির হোসেনের নিকট ইউএনও স্যারকে কত হাজার ইট দিচ্ছেন জানতে চাইলে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে তারা ঠিকমত ব্যবসা করতে না পারার কথা জানালে ইট না পেলে ভাটা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ইউএনও। বাধ্য হয়ে সাত হাজার ইট বিনা মূলে দিয়েছেন। এ অবস্থা শুধু তার নয়। অনেক ভাটা মালিককেই ইট দিতে হয়েছে অর্ধেক মূল্যে অথবা বিনা মূল্যে।

অভিযোগ রয়েছে, বিনা টাকায় বা কম মূল্য ইট না দিল উপজেলায় ভাটা চালাতে দেওয়া হবে না মর্মে ইউএনও হুমকি দেওয়ায় কয়েকটি ভাটার মালিক দাবিকৃত ইট গৃহনীর্মাণের জন্য নিজ খরচে বিভিন্ন স্থানে পৌছে দিয়েছেন।

সরকারি ঘর নির্মাণকারি কয়েকজন মিস্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, একটি ইটের উপর আলগাভাবে ভিত করায় যে কোন মুহুর্তে সামান্য ঝড়েই দেয়াল পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিকটে টিউবওয়েল না থাকায় বা টিউবওয়েল না বসিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করায় ইট গাঁথার আগে পানি দিয়ে ভেজানো হয়নি। পানি দেওয়া হয়নি প্লাস্তার করার পরও। সাদা রঙ করে তড়ি ঘড়ি করে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে অনেকের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের অসহায় মানুষের গৃহ নির্মাণের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছেন। এই টাকার মধ্যেই গৃহ নির্মান অনায়াসে শেষ করা যায়। সেখান কলারোয়ার ইউএনও ভাটা মালিকদর কাছ থেকে জোর পূর্বক ইট নিয়ে টাকা নিয়ে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে উপজেলা বাসীর মধ্য বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এতে এলাকার গরীব ও সাধাণ মানুষের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে সচেতন মহল মনে করেন।

গৃহ নির্মাণে অনিয়মের ব্যাপারে শুক্রবার বিকেলে কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী জেরীন কান্তার সাথে কথা বলেতে চাইলে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না বলে সাফ জানিয় দেন।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test