E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘চালপড়া’ খাইয়ে সহকর্মীর টাকা চুরির অপবাদ, শিক্ষিকার আত্মহত্যার চেষ্টা

২০২১ ফেব্রুয়ারি ২৬ ১৬:১৮:৫২
‘চালপড়া’ খাইয়ে সহকর্মীর টাকা চুরির অপবাদ, শিক্ষিকার আত্মহত্যার চেষ্টা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : হুজুরের কাছ থেকে আনা ‘চালপড়া’ খাইয়ে সহকর্মীর টাকা চুরির অপবাদ দেওয়া হয়েছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপাজেলার শরাফপুর ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হিন্দু ধর্ম শিক্ষক চঞ্চলা রানী দাসের নামে। গত রবিবার চালপড়া খাওয়ার পর তিন দিনের মধ্যে ওই টাকা ফেরৎ দিয়ে ক্ষমা না চাইলে তা বেতন থেকে কেটে নেওয়ার কথা বলায় ওই শিক্ষকা অপমানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সুষ্টি হয়েছে।

শরাফপুর ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক আবু তাহের হোসেন জানান, গত ১৭ ফেব্র“য়ারি সকাল ১০টার দিকে বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষক মনিরউদ্দিনকে পাঁচ হাজার ও শিক্ষক ফারুক হোসেনকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে টেবিলে বসে এএফটি ফর্ম পূরণ করছিলেন তিনি। সকাল ১১টার দিকে তিনি ইসলামী ব্যাংকের ব্যাংদহা এজেন্ট শাখায় ডিপিএসএর ১০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার পর প্রফিডেণ্ট ফাণ্ডের টাকা পকেটে খুঁজে পাননি। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রায় সকল শিক্ষক স্কুলে আসেন। কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রধান শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া তাকে ও দপ্তরী শহীদুল ইসলামকে সরাফপুর জামে মসজিদের ইমাম ইব্রাহীম ফকিরের কাছে চালপড়া আনতে পাঠান। চালপড়া নিয়ে এসে সকল শিক্ষকদের খাওয়ানো হয়। চালে থুথু বেশি না পাওয়ায় হিন্দু ধর্মের শিক্ষক চঞ্চলা রানী দাসের উপর অনেকের সন্দেহ হয়। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষক চঞ্চলা দাসকে ১৫ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য মানবিক হতে বলেন।

চঞ্চলা রানী দাস জানান, ২০০০ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি শরাফপুর ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হিন্দু ধর্মের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। গত ১৭ ফেব্র“য়ারি শিক্ষকরুমে তিনি ও আবু তাহের হোসেনসহ কয়েকজন শিক্ষক অবস্থান করছিলেন। কিছুক্ষণ পর আবু তাহেরের উপস্থিতিতে তিনিসহ কয়েকজন শিক্ষক বাড়ি চলে আসেন। পরদিন তিনি জানতে পারেন যে তাহের হোসেনের কিছু টাকা হারিয়ে গেছে। ২০১৬ সালে সপ্তম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর হারিয়ে যাওয়া টাকা, প্রধান শিক্ষকের বাড়ির গোলা থেকে আব্বার হারিয়ে যাওয়া ধানসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র হুজুরের চালপড়া খাইয়ে উদ্ধার করা হয়েছে এমন কথা শিক্ষদের সামনে উপস্থাপন করে ২১ ফেব্র“য়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আবু তাহের হোসেন ও দপ্তরী শহীদুল ইসলামকে সরাফপুর জামে মসজিদের ইমামের কাছে চাল পড়া আনতে পাঠান।

পরবর্র্তীতে ওই চালপড়া এনে তাদেরকে খেতে বলা হয়। একপর্যায়ে চিবানো চালে থুথু কম থাকায় তাকে টাকা চুরির জন্য অপবাদ দেওয়া হয়। বিষয়টি সভাপতি রাজ্যেশ্বর দাসকে জানান প্রধান শিক্ষক। একপর্যায়ে তাকে সন্দিগ্ধ চোর হিসেবে তিন দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে মাসিক বেতন থেকে ওই টাকা কেটে নেওয়ার জন্য সভাপতির বরাত দিয়ে প্রধান শিক্ষক তাকে অবহিত করেন। বিষয়টি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করেন শিক্ষক মনিরউদ্দিন ও শিক্ষক অজিত সরদার। এরপরও শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের কাছে চোর হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার পর লজ্জায় অপমানে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। পরদিন তিনি এ ঘটনায় আশাশুনি থানায় ১০২৭ নং সাধারণ ডায়েরী করেন। এরপর থেকে তিনি আর লোকলজ্জায় বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না।

তিনি আরো বলেন, ২০০৪ সালে তিনি ছয় মাসের অন্তস্বত্বা থাকাকালিন তার বেতনের টাকা দিয়ে মহাদেব দাস নামের এক শিক্ষককে খণ্ডকালিন শিক্ষক হিসেবে দিয়ে মাতৃত্বকালিন ছুটি নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি পূর্ণ বিশ্রামে ছিলেন । প্রধান শিক্ষক তাকে কয়েকটি কাগজে সাক্ষর করার জন্য জানালে তিনি কোন দপ্তরীর কাছে ওই কাগজপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। প্রধান শিক্ষক ওই কথায় রাজী না হয়ে তাকে যে কোন মূল্যে স্কুলে যেতে বলেন। একপর্যায়ে তিনি পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার পথে সভাপতির বাড়ির সামনে পৌঁছালে তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। খবর পেয়ে তার স্বামী এম্বুলেন্সযোগে তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে গর্ভস্ত সন্তান মারা গেছে বলে জানানো হয়। এরপর অপারেশনের ফলে তিনি সন্তান গর্ভধারণে অক্ষম হয়ে যান।

২০১৯ সালে তাকে আশাশুনি উপজেলার শেষ্ঠ শিক্ষকা হিসেবে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেও প্রধান শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি রাজ্যেশ্বর দাস সভা ডেকে তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে সভাপতি রাজ্যেশ্বর দাস তাকে বলেন যে তার (চঞ্চলা) মত শিক্ষককে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দিলে অন্য শিক্ষকদের অমর্যাদা হবে। তাকে প্রধান শিক্ষকের জন্য তাকে বারবার অমর্যদা হতে হচ্ছে বলে জানান চঞ্চলা।

ব্যাংদহা গ্রামের সমীর দাস বলেন, চুরির অপবাদ সইতে ২২ ফেব্র“য়ারি তার স্ত্রী চঞ্চলা দাস আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে কোন রকমে বাঁচানো হয়। ডিজিটাল যুগে চালপড়া খাওয়ানোর মধ্যেমে একজন শিক্ষককে চোর বানিয়ে তার সামাজিক সম্মান নষ্ট করা বেআইনি চঞ্চলা যাতে নতুন করে জীবনহানির চেষ্টা না করে সেজন্য বাড়ির মধ্যে নজরদারি অব্যহত রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, প্রধান শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া জামায়াতের অর্থযোগানদাতা। তিনি ২০১৩ সালের কয়েকটি নাশকতার মামলার আসামী। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা রাজ্যেশ্বরকে ভুল বুঝিয়ে তিনি একের পর এক জামায়াতের মিশন সফল করে চলেছেন। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

জানতে চাইলে সরাফপুর ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া তার বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে কয়েকটি নাশকতার মামলা থাকার কথা স্বীকার করেই বলেন, বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তিনিসহ সহকারি প্রধান শিক্ষক অনুপ কুমার সরদার, দু’জন সদস্য আলমগীর হোসেন ও আব্দুর রহমান, ব্যাংদহা বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম হোসেন বৃহষ্পতিবার জেলা প্রশাসকের কাছে যেয়ে ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে তারা শিক্ষিকা চঞ্চলা রানী দাসের বাড়িতে যেয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তাকে আবারো স্কুলে যাওয়ার অনুরোধ করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য অনুরোধ করেছেন তারা। তবে তিন দিনের মধ্যে ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ না করলে তার বেতন থেকে কেটে নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন তিনি।

সরাফপুর ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি রাজ্যেশ্বর দাস সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি প্রথমে তিনি বিস্তারিত জানতে পারেননি। সবকিছু জানার পর তিনি সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন।

আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম কবীর জানান, চঞ্চলা দাসের সাধারণ ডায়েরী তদন্ত করার জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। চালপড়া খাইয়ে চোর ধরার পদ্ধতি বর্তমান যুগে কাজে লাগালে সরকারকে এত বেশি পুলিশ নিয়োগ দিতে হতো না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা একটা অমানবিক কাজ। ওই শিক্ষকা যাতে তার মনোবল ভেঙে না ফেলেন সে জন্য তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, শিক্ষিকা চঞ্চলা রানী দাসকে মানন্ধাতার আমলে চালপড়া খাওয়ানোর নামে চুরির বদনাম দিয়ে সম্মানহানি করা হয়েছে তা আইন সম্মত হয়নি।। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাকে পরামর্শ ও সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test