E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ওজন উচ্চতা মেপে চলে সংসার ও চিকিৎসা

২০২১ মার্চ ০২ ১৭:৫৯:০২
ওজন উচ্চতা মেপে চলে সংসার ও চিকিৎসা

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : আসলাম মিয়া। বয়স ৬৫। কয়েকটা রোগ শরীরে বাসা বাঁধলেও হাল ছাড়েন নি এখনো। সকাল হলেই ওজন ও উচ্চতা মাপার স্কেল মেশিন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হাটে-বাজারে ও জনবহুল এলাকায়। সারাদিনে যা রোজগার হয় তা দিয়ে নিজের ও স্ত্রীর ওষুধ কিনে বাকি টাকায় চালডাল নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তখন তার মন থাকে ক্লান্তি ও দুঃশ্চিন্তায় অস্থির।

স্ত্রীর দুটো কিডনিই বিকল। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। সপ্তাহে দুই বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। নিজেরও রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ভাঙা পায়ের যন্ত্রণা। দুই ছেলে থাকলেও তারা পিতামাতার দেখভাল করে না। বড় ছেলেকে বাড়ির জমি লিখে দেবার পর তিনি ঘরছাড়া। থাকেন ভাড়া বাসায়।

জামালপুর শহরের বোষপাড়া এলাকার বাসিন্দা আসলাম। বোষপাড়া এলাকায় দীর্ঘদিন তিনি দোকান করতেন। বাড়িছাড়া হবার পর স্ত্রীকে নিয়ে ওই এলাকাতেই বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। স্ত্রী মাসখানেক ধরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকায় ভাড়া বাসায় এখন তিনি একা। সারাদিনের রোজগার শেষে বাড়ি ফিরে নিজের কাজ তার নিজেকেই করতে হয়।

তার চার সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে ৭ বছর আগে। বিয়ে হয়ে গেছে দুই মেয়েরও। তার দেখভাল করার কেউ না থাকায় ৫ বছর আগে স্ত্রী ও নিজের মুখের আহার জুটাতে তিনি বেছে নেন এই পেশা। যখন তিনি ঘরছাড়া হন তখন এক দরদী লোক তাকে কিনে দেন ওজন ও উচ্চতা মাপার স্কেল মেশিন। সেই মেশিনই এখন তার রোজগারের একমাত্র মাধ্যম।

জামালপুর পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) শিল্প মেলার প্রবেশপথে কথা হয় তার সাথে। তখন দুপুর। ক্লান্তিতে তিনি হাঁপাচ্ছিলেন আর ওজন মাপছিলেন। ভাঙা পা নিয়ে তিনি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারেন না, চলতেও ভীষণ কষ্ট হয়। তবুও তিনি তার কাজ মনযোগ দিয়ে করছেন। পথচারীদের ডাকাডাকি করছেন, ‘৫ টাকায় ওজন মাপেন, উচ্চতা মাপেন।’ তার কষ্ট হচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করতেই তিনি কেঁদে উঠেন। বলেন, ‘মুন্দ কফাল। কী আর করমু চাচা, পেটে তো ভাত দিওন নাগবো।’

কথায় কথায় তিনি এমনটাই জানালেন তার কষ্টগাঁথা জীবন কাহিনী। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার (স্ত্রী) মমিসিং হাসপাতালো ভর্তি। দুইডে কিডনিই নষ্ট। তারে টেকা দিওন নাগে আবার পেটের ভাতও জোগাড় করন নাগে।’

আপনার ছেলেমেয়ে নেই? জিজ্ঞেস করতেই তিনি হো হো করে হেসে পরক্ষণেই কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘পুলা-মাইয়া থাইকেউ নাই। পোলা আছে দুইডে, বিয়ের করাইয়ে বউগরে দিয়ে দিছি আর দুইডে মাইয়া বিয়ে দিয়ে জামাইগরে দিয়ে দিছি। এহন আমার কেউ নেই বাপ।’

হাতের গাদায় চোখ মুছে তিনি আরো বলেন, ‘আমার এডা দোহান আছিল। আমার ভাই আর আমি চালাইতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়ে বালাই চলতাছিলাম। বড় পোলারে বাড়ির জমি নেইখে দেওনের পর আমার ভাই চালাকি কইরে দোহানডাও নিয়ে নিছে। তারপর আমারে বাড়িছাড়া করছে।’

এমন অসহায়ত্ব নিয়েও হাল ছাড়েন নি আসলাম। ১৭ বছর বয়সে ট্রেন থেকে পড়ে পা ভাঙে এবং পায়ের তিনটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক খরচাপাতি করে তখন সেই পা ভালো হলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখা দেয় নানা সমস্যা। চলতে ফিরতে কষ্ট হয়। টাকার অভাবে পায়ের সঠিক চিকিৎসাও করাতে পারেন না। এ বয়সে এসে পায়ের ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে স্কেল মেশিনে ওজন-উচ্চতা মেপে চালান সংসার ও চিকিৎসা খরচ। পান নি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা। তিনি জানেন, স্ত্রীকে আর বেশিদিন চিকিৎসা করাতে পারবেন না। নিজের চিকিৎসার আশাও ছেড়ে দিয়েছেন। ভাড়া বাসায় থাকা-খাওয়ার খরচ যুগাতেই তার এখন হিমশিম অবস্থা। সারাদিন ঘুরেঘুরে ২ থেকে আড়াই শ টাকা রোজগার হয়। এ বাজারে এই টাকা দিয়ে চলা খুবই কষ্টকর। জীবন সায়াহ্নের কাছাকাছি এসে তার চোখজোড়া বিষাদ ও হতাশায় মুহ্যমান। এখন একটু শান্তিতে মরার উপায় খুঁজছেন তিনি।

(আরআর/এসপি/মার্চ ০২, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test