E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

রানা প্লাজা ধসের আট বছর 

রাণীশংকৈলের স্বজনহারা তিন পরিবার ভুলতে পারেনি দুঃস্বহ স্মৃতি

২০২১ এপ্রিল ২৪ ১৫:৩১:১৭
রাণীশংকৈলের স্বজনহারা তিন পরিবার ভুলতে পারেনি দুঃস্বহ স্মৃতি

খুরশিদ আলম শাওন, রাণীশংকৈল : ঘরের বারান্দায় বসে মেয়েকে পাশে নিয়ে স্বামী আলতাফ হোসেনের জন্য কাঁদছেন মাসুদা। সাভারের রানা প্লাজা ধসে আলতাফ (৩৫) মারা গেছেন। সে সময় মাসুদা নিজেও আহত হয়েছিলেন। মাসুদার বয়স এখন চল্লিশের কাছাকাছি। আজ ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের আট বছর পূর্তি। এত বছরেও সেই দুঃসহ স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেননি। স্বামীর বাঁচার সেই আকুতি আজও মাসুদাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বলিদ্বারা গ্রামের বাসিন্দা মাসুদা। রানা প্লাজা ধসে আলতাফ ছাড়াও একই গ্রামের শিল্পী আক্তার (২৩) ও আঞ্জু বেগম (২৬) নামের আরও দুই নারী পোশাককর্মী নিহত হন। সম্প্রতি কথা হয় স্বজন হারানো ওই তিন পরিবারের সঙ্গে। এ সময় তাঁদের কথায় উঠে আসে সে ভয়াবহ দিনটির কথা।

বলিদ্বারা গ্রামে গিয়ে আলতাফের নাম বলতেই লোকজন বাড়ি দেখিয়ে দিল। বাড়িতে ঢুকেই দেখা মিলল বাড়ির উঠোনে মেয়ে রুপাকে (১৫) নিয়ে আনমনে বসে থাকা মাসুদা। পরিচয় দিয়ে কথা বলি তাঁর সঙ্গে। মাসুদা বলেন, আজ ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের দিন। সেদিনের কথা কীভাবে ভুলি! বলতে বলতেই ছুটে গেলেন ঘরে। হাতে তুলে নিলেন আলতাফের একটি ছবি। ততক্ষণে আলতাফের ছেলে মাসুদ রানা (১৮) এসেছেন সেখানে। এই ছেলের কথাই এরপর মাসুদা বলতে লাগলেন। জন্মের পর থেকেই ছেলের হৃদরোগ ধরা পড়ে।

স্থানীয়ভাবে সব কিছু শেষ করে সর্বাত্নক চেষ্টা করেও ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। তাই ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে দুজনেই স্থানীয় একজনের সহায়তায় সাভারের রানা প্লাজায় পোশাক কারখানায় কাজ নেন। ছেলেমেয়েকে দাদা-দাদির কাছে রেখে তাঁরা সাভারে যান। স্বামী-স্ত্রী মিলে মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করতেন। খরচ শেষে বাকিটা পাঠাতেন বাড়িতে।

স্বামী আলতাফ হোসেন রানা প্লাজার সপ্তম তলায় আর মাসুদা কাজ করতেন তৃতীয় তলায়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে নয়টায় ভবনধস হয়। বেলা একটার দিকে উদ্ধার হন মাসুদা। বুকে আঘাত পাওয়া মাসুদাকে নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু স্বামীর চিন্তায় অস্থির হয়ে দুই ঘণ্টা পর হাসপাতাল ছেড়ে আবারও ধ্বংসস্তূপের সামনে আসেন মাসুদা। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলেন না স্বামীকে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে অজ্ঞান হয়ে যান আহত মাসুদা। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ধরে তাঁর ভাড়া বাসায় দিয়ে আসেন। সেখানে রাত আটটার দিকে মাসুদার মুঠোফোনে ধসে পড়া ভবনের ভেতরে আটকে পড়া একজন শ্রমিকের কল আসে। তিনি মাসুদাকে বলেন, হাতে-পায়ে বিম চাপা অবস্থায় আটকে আছেন আলতাফ। সেখান থেকে তিনি শুধু বারবারই মাসুদার নাম বলছেন। আটকে পড়া ওই শ্রমিক মাসুদাকে অনুরোধ করেন, তাঁকে ও আলতাফকে উদ্ধারের জন্য।

সেদিন ধ্বংসস্তূপে ছুটে গিয়ে এক সেনা সদস্যের সহায়তায় ধসে পড়া ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন মাসুদা। স্বামীর অবস্থান জেনে ডাকাডাকি শুরু করেন। একসময় স্বামীও সাড়া দেন। সে সময় চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন আলতাফ। আলতাফ তখন কেঁদে বলেন, ‘হাত-পা কাটপার হলেও কাটো। মুই ভিক্ষা করি খাইম। তাও ছাওয়ালাক তো দেখতে পাম।’কাছে গিয়ে মাসুদা স্বামীর মুখে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

উদ্ধারকর্মীরা মাসুদাকে বারবার বের হয়ে যেতে তাড়া দিচ্ছিলেন। তখন আলতাফ তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মুখে একটু পানি দিয়ে যেতে। মাসুদা মুখে পানি দিয়ে উদ্ধারের আশ্বাস এরপর উদ্ধারকর্মীদের তাগাদায় ফিরে আসেন মাসুদা। ২৫ এপ্রিল মারা যান আলতাফ। ২৬ এপ্রিল উদ্ধার হয় তাঁর মৃতদেহ।

কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে শুরু করেন মাসুদা। তাঁর সঙ্গে কাঁদতে শুরু করেন মাসুদ ও রুপাও। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মাসুদা বলতে লাগলেন, আলতাফ সব সময় ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু ছেলেটার আর লেখাপড়া হলো না। সংসারের কষ্ট দেখে নিজেও রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেছেন। আর মেয়েটাকে পড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় রুপা একটি সেলাই মেশিন দেখিয়ে বলল, ‘কাপড় সেলাই শিখেছি। অবসরে কাপড় সেলাই করে কিছু টাকা আয় হয়।’ এরপর সে বলে, ‘এখন দশম শ্রেণিতে পড়ছি। আর কয়টা বছর। এরপর একটি চাকরি নেব। তখন আর মাকে কাজ করতে দেব না।’

মাসুদা জানান, আলতাফের লাশ নেওয়ার সময় ২০ হাজার টাকা আর পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছে পরিবারটি।

মাসুদার বাড়ি থেকে উঠে যাই রানা প্লাজা ধসে নিহত এই গ্রামেরই শিল্পী আকতার ও আঞ্জু আক্তারের বাড়ি। তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও দুঃসহ দিনটির কথা ভুলতে পারেননি। শিল্পীর মা শেফালি বেগম (৪৫) বলেন, কারখানার কাজের ফাঁকে ডিগ্রি পড়ছিলেন শিল্পী। প্রথম বর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাসও করেছিল। এলাকার একজন পরিচিত রানা প্লাজা ধসে পড়ার খবর জানিয়েছিল। শুনেই ঢাকার গাড়িতে চড়ে বসেন শিল্পীর বাবা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেয়েকে না পেয়ে আবার ফিরে আসেন তিনি। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শেফালি। কান্না থামিয়ে আবার বলতে লাগলেন, রানা প্লাজা ধসের পর ১৬ দিন পর গ্রামের একজন তাঁকে মুঠোফোনে জানান, শিল্পীর মোবাইল নম্বর খোলা আছে। তখনই মেয়ের নম্বরে ফোন দেন তিনি। একজন নারী ফোন ধরেন। নারীকণ্ঠ শুনে তিনি ভেবেছিলেন শিল্পী বেঁচে আছে।

এ সময় কথা কেড়ে নিয়ে শিল্পীর বাবা ফাইজুল ইসলাম (৫৫) বলেন, হামি বললাম, শিল্পী, তুই কই? ওপার থেকে নারীকণ্ঠ বলে, “আমি শিল্পী না। শিল্পীর লাশ মিলেছে। পরে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে শিল্পীর লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’ ফাইজুল বলেন, তত দিনে শিল্পী প্রায় কঙ্কাল হয়ে গেছে। লম্বা লম্বা চুল ও পায়ের আংটি দেখে চিনতে পেরেছি। মেয়েটা এতই লক্ষ্মী ছিলো,তাকে কিছুতেই ভুলতে পারি না।

শিল্পীর ছোট ভাই সোহেল (২১) বলেন, তখন আমি খুব ছোট। কিন্তু বোনের এভাবে চলা যাওয়ার কষ্ট ভুলতে পারি না।শিল্পীর মা শেফালী বলেন,মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় সরকার এক লাখ টাকা দিয়েছে। তাই দিয়ে ছেলের জন্য কিছু বন্ধক নিয়েছেন।

এদিকে বিয়ের কয়েক বছর পর বনাবানি না হওয়ায় স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আঞ্জু বেগমের। ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে তাদের বাবার বাড়িতে রেখে পোষাক কারখানায় কাজ করতে যান তিনি। প্রতি মাসে বেতনের একটা অংশ পাঠাতেন। সে টাকাতেই চলতো সংসার। রানা প্লাজার ধসের দিনই আঞ্জুও মারা যান।

তার বোন বুলি বেগম(৪০) বলেন, আঞ্জুর পাঠানো টাকাতেই চলতো পুরো পরিবার। সে মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারে অভাবে নেমে আসে। অভাবের কথা ভেবে আঞ্জুর মেয়ে মৌসুমী(১৫) পোষাক কারখানায় কাজ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে গেছেন। ছেলে রাজু(১১) বলে, মায়ের মুখ খানি মনে রাখতে বার বার মায়ের ছবিটা দেখি। এই পরিবারটিও দাফনের জন্য বিশ হাজার টাকা ।

পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছে বলে জানান, আঞ্জুর বাবা আব্দুল মান্নান(৬০)। তিনি বলেন, মোর কুনো ব্যাটা নাই। আঞ্জুই আমার কাছত ব্যাটা আছিল বলতে বলতে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন তিনি, তার আঙুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।

(কেএস/এসপি/এপ্রিল ২৪, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test